নিউজ ডেস্ক: ‘সেফ হোম’ বা নিরাপদ আবাসন কেন্দ্রে রাখা হয় বিভিন্ন স্পর্শকাতর মামলার ভিকটিম নারী-শিশু-কিশোরীদের। জেলখানায় অপরাধীদের সংস্পর্শে শারীরিক বা মানসিকভাবে এই ভিকটিমরা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে—এমন আশঙ্কা থেকে তাদের সেফ হোমে রাখা হয়। নিরাপত্তার প্রয়োজনে আদালতের নির্দেশে সরকারি ব্যবস্থাপনায় সেফ হোমে রাখা হয় তাদের। সেফ হোমে থাকাকালীন ব্যয়ভার বহন করে সরকার। দেশে সরকারি ব্যবস্থাপনায় সাতটি সেফ হোম রয়েছে। কালের কন্ঠ
এর মধ্যে একটি গাজীপুর মোগরখাল এলাকার সেফ হোম। এই সেফ হোমে থাকা ১৪ জন ভিকটিম গত ২৪ মার্চ গভীর রাতে পালিয়ে গেছে। তাদের মধ্যে রয়েছে নারী, শিশু, কিশোরী ও প্রতিবন্ধী। এর আগে ২০১৮ সালে পালিয়েছিল ১৭ জন।
প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, যে ভিকটিমদের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে সেফ হোমে রাখা হয়, সেখান থেকে তারা পালাচ্ছে কেন? ভিকটিমদের জন্য সেফ হোমে পর্যাপ্ত খাবার, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, শিক্ষা, চিত্তবিনোদন, নজরদারির ব্যবস্থা আছে তো?
পালানোর নেপথ্যে : খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতিবন্ধী, মানসিক ভারসাম্যহীন নারী, শিশু ও কিশোরীদের সেফ হোমে পাঠানো হলেও সেখানে সংকট রয়েছে মনোচিকিৎসক, প্রশিক্ষক, মেডিক্যাল অফিসারের। সঙ্গে রয়েছে অপ্রতুল খাবার এবং সুষ্ঠু নজরদারির অভাব।
গাজীপুর সেফ হোমের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ফরিদা খানম বলেন, ‘এখানে যারা আসে তাদের বেশির ভাগ থাকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। অনেকে ব্লেড, জানালার গ্রিল দিয়ে হাত কাটার চেষ্টা করে। বগুড়া থেকে সম্প্রতি একটি মেয়ে এসেছে বিকৃত মানসিকতা নিয়ে। সেফ হোমে থাকা অন্য মেয়েরা তার দ্বারা হয়রানির শিকার হচ্ছে। অথচ এখানে মানসিক বিকারগ্রস্ত কাউকে পাঠানোর কথা না। আমাদের এখানে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার জন্য একজন চিকিৎসক নেই। কিন্তু আদালতের নির্দেশে তাদের পাঠানো হচ্ছে। তাদের গাজীপুর কোনাবাড়ী কিশোরী উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠালে ভালো হতো। আমরা আপত্তি জানিয়েছিলাম। তখন আদালত উল্টো শোকজ করেন।’
আবার নীতিমালা অনুযায়ী প্রতি মাসে একজন প্রাপ্তবয়স্ক নারী কিংবা কিশোরীর খাবারের জন্য বরাদ্দ চার হাজার টাকা, শিশুদের জন্য তিন হাজার টাকা থাকার কথা থাকলেও দেওয়া হচ্ছে দুই হাজার টাকা। ফলে প্রয়োজনীয় খাবারের ব্যবস্থা করা যাচ্ছে না।
সেফ হোমের কর্মকর্তারা বলছেন, এই দুই হাজার টাকা থেকে ভ্যাট কেটে নেওয়ার পর পাওয়া যাচ্ছে এক হাজার ৭৫০ টাকা। এর থেকে আবার সাবান, তেল, শ্যাম্পু বাবদ কেটে রাখার পর থাকে এক হাজার ৬০০ টাকা। এই টাকা দিয়েই পুরো মাসের খাবার খরচ, যা মোটেও যথেষ্ট নয়।
আবাসন কেন্দ্রের অতিরিক্ত হোস্টেল সুপার আবদুর রহমান মোল্লা বলেন, ১৯৯৭ সাল থেকে টাকার এই বরাদ্দ চলে আসছে। ২৪ বছরে তা আর পাল্টায়নি। অথচ এই ২৪ বছরে খাদ্যদ্রব্যের দাম বেড়েছে অনেক গুণ। ১৯৯৭ সালে চালের কেজি ছিল সাত-আট টাকা। বর্তমানে ৫৫ থেকে ৬০ টাকা। এই বাজেটে আমাদের পক্ষে কোনোভাবেই ভালো খাবার দেওয়া সম্ভব না। খেলাধুলার ব্যবস্থা থাকলেও প্রশিক্ষকের অভাবে যে যার যার মতো থাকে।
নামমাত্র ‘তদন্ত কমিটি’ : এদিকে ভিকটিমদের পালানোর পরদিন মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব সায়েদুল ইসলাম ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে দেন। সাত দিনের মধ্যে ওই তদন্ত কমিটিকে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। কিন্তু তদন্ত কমিটির প্রধান করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ায় মুখ থুবড়ে পড়ে তদন্ত।
সেফ হোম থেকে ভিকটিমদের পালানোর কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের মহাপরিচালক রাম চন্দ্র দাস বলেন, একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এখনো রিপোর্ট পাওয়া যায়নি। পেলে আসল কারণ জানা যাবে।
ভিকটিমদের পালানোর দুই মাস আগে জামালপুর উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তাকে ওই সেফ হোমের তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে নিয়োগ দিলেও তিনি যোগ দেননি। পরে তাঁকে শোকজও করা হয়েছিল।
দায় এড়াতে অসম্ভব গল্প : গত ২৪ মার্চ ১৪ জন ভিকটিম পালানোর ঘটনা নিয়ে শোনা গেল সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কাছে অসম্ভব এক গল্প। নাম প্রকাশ না করা শর্তে একজন কর্মকর্তা জানান, খাটের মোটা কাঠ দিয়ে ভিকটিমরা জানালার গ্রিল ভেঙে বিছানার চাদর দিয়ে ঝুলে তিনতলা থেকে দোতলার (রান্নাঘরের) ছাদে নামে। সেই ছাদ থেকে সীমানাপ্রাচীর (বাউন্ডারি) ছয়-সাত ফুট দূরে। এই সীমানাপ্রচীর প্রায় ২৫ ফুট উঁচু। সেখানে খালি জায়গায় খাট ফেলে ব্রিজের মতো বানিয়ে তারা দেয়াল টপকে পালিয়ে গেছে। এই গল্পের বর্ণনা থেকেই বোঝা যায় সেখানকার নিরাপত্তাব্যবস্থা কত দুর্বল। আর স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন দেখা দেয়, এই সিনেমা স্টাইলে শিশু ও প্রতিবন্ধীদের কি পালানো সম্ভব?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক জিয়াউর রহমান বলেন, এগুলো নিছক গল্প ছাড়া কিছু না। শিশু, প্রতিবন্ধীর পক্ষে এভাবে পালানো সম্ভব নয়। পালিয়ে গেলে অবশ্যই পরিচালনা কমিটির দায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠবে।
তিনি আরো বলেন, সেফ হোমে ভিকটিমদের জন্য যে সুযোগ-সুবিধা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশ দরকার তার কোনোটাই সেখানে নেই। তাদের বিনোদন, কাউন্সেলিং, ইনকাম জেনারেটিং অ্যাক্টিভিটিস, ভিকটিমের ট্রমা থেকে বেরিয়ে আসতে যেসব উদ্যোগ নেওয়া দরকার তার কিছুই করা হয় না।