জনকণ্ঠ: ছয় জটিল রোগের চিকিৎসায় সহায়তা করার লক্ষ্যে আগামী বাজেটে আর্থিক বরাদ্দ বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রকোপ প্রতিরোধে জরুরী চিকিৎসা সরঞ্জামাদি আমদানি আরও সহজ করা হবে। করোনাসহ ভাইরাসজনিত রোগের টিকা, ওষুধ এবং ওষুধের কাঁচামাল উৎপাদনে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে আগামী বাজেটে বরাদ্দ বাড়াবে সরকার। করোনা রোগীর সেবা দিতে গিয়ে অনেক সময় ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরা মারা যাচ্ছেন। এসব পরিবারকে সরকারের পক্ষ থেকে আর্থিক ক্ষতিপূরণ দেয়ার বিষয়টিও আগামী বাজেটেও রাখা হচ্ছে।
জানা গেছে, ক্যান্সার, কিডনি, লিভার সিরোসিস, স্ট্রোকে প্যারালাইজড, জন্মগত হৃদরোগ এবং থ্যালাসেমিয়ার মতো ছয় জটিল রোগের চিকিৎসা সহজ করতে বিশেষ উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। সামাজিক সুরক্ষার আওতায় দরিদ্র মানুষ চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে এই সহায়তা পাবেন। চলতি বাজেটে এককালীন চিকিৎসা সহায়তা হিসেবে জনপ্রতি ৫০ হাজার টাকা করে দেয়া হচ্ছে। আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে এই বরাদ্দ বাড়ানো হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। এ প্রসঙ্গে অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক উর্ধতন কর্মকর্তা বলেন, আগামী বাজেটেও সবচেয়ে বেশি জোর দেয়া হচ্ছে করোনা চিকিৎসায় এবং এরপরই মরনাপন্ন ছয় জটিল রোগের চিকিৎসায় আর্থিক সহায়তার পরিমাণ বাড়ানোর চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। তিনি বলেন, দেশে ক্যান্সার, কিডনি এবং লিভার রোগে আক্রান্ত রোগীদের সংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু এসব রোগের চিকিৎসা ব্যয় বেশি। এর ফলে দরিদ্র মানুষ সবচেয়ে বেশি বেকায়দায় পড়ছে। এসব দিক বিবেচনায় নিয়ে জটিল এসব রোগের চিকিৎসায় আর্থিক বরাদ্দ বাড়ানো হবে।
জানা গেছে, করোনাভাইরাস সম্পর্কিত জীবন রক্ষাকারী ওষুধ, চিকিৎসা সরঞ্জামাদি ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় চিকিৎসা উপকরণ আমদানির জন্য পাঁচ লাখ মার্কিন ডলার বা এই পরিমাণ অন্য বিদেশী মুদ্রার অগ্রিম প্রদানের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন রয়েছে। জুন মাসে এই অনুমোদনের মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছিল করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) প্রতিরোধে জরুরী চিকিৎসা সরঞ্জামাদি আমদানির জন্য রিপেমেন্ট গ্যারান্টি ছাড়াই পাঁচ লাখ মার্কিন ডলার বা এই পরিমাণ অন্য বিদেশী মুদ্রার অগ্রিম প্রদান ‘তাৎক্ষণিক কার্যকরের’ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। করোনাভাইরাস সম্পর্কিত জীবন রক্ষাকারী ওষুধ, চিকিৎসা সরঞ্জামাদি ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় চিকিৎসা উপকরণ আমদানির জন্য এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
জানা গেছে, করোনাভাইরাসের প্রকোপ নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই অনুমোদনের মেয়াদ আরও বাড়ানো হবে। প্রসঙ্গত, করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রকোপ বাড়ায় স্বাস্থ্য খাত নিয়ে নতুন উদ্যোগ রয়েছে সরকারের। প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে আক্রান্ত ও সংক্রমণের হার বেড়ে যাওয়ার কারণে বাংলাদেশেও করোনা নিয়ে অস্থিরতা বাড়ছে। আগামী বাজেটে তৃতীয় অগ্রাধিকারে থাকছে স্বাস্থ্য খাত। এ খাতে অতিরিক্ত বরাদ্দ, প্রণোদনা এবং ক্ষতি পূরণের অর্থ সংস্থানে সব ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। চলতি বাজেটে ২২ হাজার ৮৮৪ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে স্বাস্থ্য খাতে। আসন্ন বাজেটে এ বরাদ্দ আরও বাড়ানো হচ্ছে। এরই মধ্যে করোনা মোকাবেলায় স্বাস্থ্য খাতে অস্বাভাবিক ব্যয় বেড়েছে। বিশেষ করে চিকিৎসা সরঞ্জাম কেনাকাটা ও টিকা আমদানি করতে হচ্ছে।
বিশেষ করে কোভিড-১৯ মোকাবেলায় এ বছরও ১০ হাজার কোটি টাকার একটি তহবিল থাকছে। এছাড়া টিকা আমদানি, রোগ নিয়ে গবেষণা, টিকা উৎপাদন এবং অন্যান্য সরঞ্জামাদি আমদানিতে সরকারকে বিপুল অঙ্কের অর্থ ব্যয় করতে হবে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অন্য একটি সূত্র দাবি করেছে উন্নয়ন, অনুন্নয়ন ব্যয় এবং করোনা চিকিৎসা সংক্রান্ত ব্যয় যোগ করলে এ খাতে বরাদ্দের পরিমাণ ৭৫ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। এ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সম্প্রতি বাজেট সংক্রান্ত এক বৈঠক শেষে বলেন, করোনা থেকে মানুষের জীবন বাঁচাতে এ মুহূর্তে সরকার সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। এ কারণে করোনার টিকা আমদানি, টিকা উৎপাদন এবং অন্যান্য সরঞ্জামাদি সংগ্রহে সবচেয়ে বেশি জোর দেয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, করোনার টিকা ক্রয়ে প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থানে একটি আলাদা প্রকল্প করা হয়েছে। ওই প্রকল্পে উন্নয়ন সহযোগীরা বিপুল পরিমাণ অর্থের জোগান দিতে কাজ করছে।
জটিল ছয় রোগের চিকিৎসায় সহায়তা ॥ ক্যান্সার, কিডনি, লিভার সিরোসিস, স্ট্রোকে প্যারালাইজড, জন্মগত হৃদরোগ এবং থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত ছয় রোগের চিকিৎসায় সহায়তা দেয়া হবে। এ লক্ষ্যে রোগীদের আর্থিক সহায়তা কর্মসূচী বাস্তবায়নে একটি নীতিমালা করেছে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়াধীন সমাজসেবা অধিদফতর ‘হাসপাতাল সমাজসেবা কার্যক্রম’-এর মাধ্যমে দুস্থ ও অসহায় রোগীদের আর্থিক সহায়তা প্রদান করে থাকে। ইতোপূর্বে ক্যান্সার, কিডনি, লিভার সিরোসিস রোগে আক্রান্ত রোগীদের এককালীন ৫০ হাজার টাকা হারে আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। আর্থিক সহায়তা গ্রহণে আগ্রহী আবেদনকারীগণ নির্ধারিত ফরমে আবেদনপত্র পূরণ করে যথাযথ প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট কাগজপত্রের কপি সংযুক্ত করে পরিপূর্ণ আবেদন সংশ্লিষ্ট উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয়, শহর সমাজসেবা কার্যালয়ে জমা দিতে পারবেন। আগামী বাজেটে এই সহায়তা বাড়ানো হবে বলে জানা গেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জটিল এসব রোগের চিকিৎসায় ৫০ হাজার টাকায় চিকিৎসা ব্যয় মেটানো অসম্ভব হয়ে পড়ছে। এছাড়া সারাদেশে অসংখ্য দুস্থ ও অসহায় মানুষ এই সুবিধার বাইরে থাকছেন। এ কারণে বেশি সংখ্যক মানুষকে এই সুবিধার আওতায় আনতে আগামী বাজেটে আর্থিক বরাদ্দ ও উপকারভোগীর সংখ্যা বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
চিকিৎসা গবেষণায় বরাদ্দ বাড়ানো হবে ॥ করোনাসহ ভাইরাসজনিত রোগের চিকিৎসা সহজ করতে চিকিৎসা গবেষণায় বরাদ্দ বাড়ানো হবে। এছাড়া ওষুধের কাঁচামাল দেশে উৎপাদনে বিশেষ নজর দেয়া হবে। দেশে ওষুধের বাজারের আকার বেড়েছে। মোট চাহিদার ৯৮ শতাংশ ওষুধ এখন দেশে উৎপাদিত হয়ে রফতানি হচ্ছে ১৫০টি দেশে। ওষুধ কোম্পানিগুলো ভ্যাকসিন, ক্যান্সারের প্রতিষেধক, ইনসুলিনসহ বিভিন্ন ধরনের জটিল ও আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ওষুধ তৈরি করছে। দেশে এসব ওষুধের কাঁচামাল উৎপাদন হলে তা আরও সহজলভ্য হতো। কিন্তু মোট ৯৭ শতাংশ পর্যন্ত কাঁচামাল আমদানি করতে হয়। সেক্ষেত্রে দেশে কাঁচামাল উৎপাদিত হলে ওষুধ আরও সহজলভ্য হবে। পাশাপাশি বিশ্বের সঙ্গে প্রতিযোগিতাও আরও সহজ হবে। এ কারণে ওষুধ উৎপাদনে গবেষণা ও এ শিল্পের কাঁচামাল উৎপাদনে বিশেষ সহায়তা দেয়া হবে বলে জানা গেছে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, সঠিক পরিকল্পনা ও বাজেটে কম বরাদ্দের পাশাপাশি বছরের পর বছর হাসপাতালে চিকিৎসা সামগ্রীর সঙ্কট, নানা অব্যবস্থাপনাসহ স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতির কারণে এখনও ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি স্বাস্থ্য খাত। চিকিৎসা না পেয়ে মানুষের অব্যাহত মৃত্যুতে করোনাকালে স্পষ্ট হয়ে উঠেছেÑ স্বাস্থ্য খাতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। তাদের মতে, আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে করোনার চিকিৎসায় বড় অঙ্কের বিশেষ বরাদ্দ রাখা দরকার। কারণ, এবার করোনার টিকা ক্রয় ও চিকিৎসাসেবার পাশাপাশি করোনা পরীক্ষাসহ রোগ নির্ণয়ে প্রচুর পরিমাণ টাকার প্রয়োজন হবে। আর এই খাতে বড় বাজেট দিলে দেশের গরিব ও মধ্যবিত্তরা রাষ্ট্রীয় টাকায় করোনা সঙ্কটের প্রভাব থেকে রেহাই পাওয়ার সুযোগ পাবেন।