সেলিম জাহান: পয়ষট্টি বছর আগের কথা। সেই প্রথম শুনি, ‘বৃষ্টি পড়ে টাপুর-টুপুর, নদেয় এলো বান’। তারপর পড়ি ‘আমাদের ছোটনদী চলে বাঁকে বাঁকে।’ ক’দিন পরেই আবৃত্তি করি, ‘মনে কর, যেন বিদেশ ঘুরে, মাকে নিয়ে যাচ্ছি অনেক দূরে’। সেই শুরু- সেই প্রথম আমার সঙ্গে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরিচয়। আজ কবিগুরুর জন্মদিন।
প্রথম সেই পরিচয়ের পরেই রবীন্দ্রনাথ আমার হৃদয়ে সেঁধিয়ে গেলেন। আর সেই যে সেঁধুলেন, তাঁর হাত থেকে আমি আর ছাড়া পেলাম না। আস্তে আস্তে তিনি আমাকে গ্রাস করলেন - তাঁর কবিতা-গান, তাঁর দর্শন-জীবনবোধ, তাঁর চিন্তা-চেতনা দ্বারা। রবীন্দ্রনাথ আমার কাছে হয়ে উঠলেন সর্বগ্রাসী রবীন্দ্রনাথ।
তাঁকে ছাড়া আমার চলে না একদিনও এবং সত্যি কথা বললে প্রতিদিনের যেকোনো অংশই তার প্রভাবে ঠাসা। না, ছাড়া পাই না তাঁর কাছ থেকে কোনো অবস্থাতেই। সাধারণ জীবন-যাপনে, কর্মকাণ্ডে, চিন্তা-চেতনায়। আমার দুঃখে আমি তাঁর কাছে ফেরত চাই, আমার হতাশায় তিনি আমাকে টেনে তোলেন, আমার আনন্দে আমি তাঁকে পাশে পাই। জীবন-জগতের প্রতিটি মুহূর্ত সম্পর্কে তিনি কিছু বলেছেন ও লিখেছেন, যা আমাদের পথ দেখায়, সামনে এগিয়ে নিয়ে যায়, বাঁচতে সাহায্য করে।
আমার দুঃখে, আনন্দে, বিষণ্নতায়, খুশিতে আমি বারবার রবীন্দ্রনাথে ফিরে গেছি। শক্তি আর প্রণোদনা পেয়েছি ‘আমার সকল দুঃখের প্রদীপ’ থেকে ‘সদা থাকো আনন্দে’। আমার জীবনের এমন কোনো দিক নেই যেখানে তিনি কিছু ভাবেননি বা বলেননি। আমার প্রায়শই মনে হয়, এক রবীন্দ্রনাথের মধ্যে একশ’ রবীন্দ্রনাথ যেন একসারি বই হয়ে আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। সময় আর সুযোগ বুঝে কেবল হাত বাড়িয়ে টেনে নেয়া আর তারপর ঠিক পৃষ্ঠাটি ওল্টানো।
আমার দৃষ্টিভঙ্গি, মূল্যবোধ ও মানসিকতা গড়নে রবীন্দ্রনাথের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাবের কথা কি করে অস্বীকার করি? এই যে একটি বৈশ্বিক বীক্ষণের দৃষ্টি, বিজ্ঞানমনস্কতা, যুক্তিবাদীএকটি মন গড়ে তোলার তাগিদ তো রবীন্দ্রনাথই দিয়েছেন। বিশাল বিশ^ আর প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের যে নিবিড় একটি যোগসূত্র আছে, তার খেইওতো তিনি ধরিয়ে দিয়েছেন আমাকে।
ছোটবেলায় ‘আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকের ‘কাল থেকেই রবীন্দ্রনাথ আমার মুখে ভাষা দিয়েছেন। তাঁর কাছ থেকেই শব্দশৈলী, কথার প্রাঞ্জলতা, সংযত কিন্তু সংহত বলা শিখেছি। তিনি যে প্রতিনিয়ত ‘জলের মতো ঘুরে ঘুরে কথা কন’। তাঁর কাছ থেকে ধার করেই তো আমি বেড়ে উঠেছি। সেই সঙ্গে ঋদ্ধ হয়ে উঠেছি একটি গভীর জীবন বোধে, একটি মুক্ত বুদ্ধি ও মুক্ত চিন্তায়, একটি মানবিকতায়। এই যে এখন লিখতে বসেছি, তাঁর দ্বারস্থ হওয়া ছাড়া আমার তো আর কোনো উপায় নেই। নিজেকে নিজের মতো করে রাখতে চেষ্টা করি অনুক্ষণ, কিন্তু কেমন করে যেন আমার চিন্তা-চেতনার ফাঁক-ফোকর দিয়ে তিনি ঢুকে পড়েন আমার মনে; সরাসরিভাবে উঠে আসেন আমার বক্তব্যে, কথার যোগান দেন আমার শব্দ-চয়নে ও ভাষায়।
মাঝে মাঝে কি যারপরনাই বিরক্ত হই নি রবীন্দ্রনাথের ওপরে? হয়েছি এবং ভেবেছি, এতো মহা যন্ত্রণা তাঁকে নিয়ে। আমার জীবনের যে কোনো বিষয়ের কথাই বলি না কেন, সেখানেই তিনি কিছু বলে ফেলেছেন। কাঁঠালের আঁঠা হয়ে তিনি যেন লেগে আছেন আমার জীবনের সর্বত্র। তাঁকে ছাড়ানো যায় না- আমার জীবনের প্রতি পদে পদে তার বিস্ময়কর অর্থবহুল উপস্থিতি। একটা পর্যায়ে কিন্তু মনে হয়েছে যে, রবীন্দ্রনাথ না হলে আমার চলছে না। রবীন্দ্রনাথের কাছে আমার ঋণের শেষ নেই।
বাতাসের মাঝে বাস করে আমরা যেমন ভুলে যাই আমরা বাতাসের মধ্যে আছি, তেমনি রবীন্দ্রনাথোর মধ্যে থেকে আমি ভুলে যাই যে আমি রবীন্দ্রনাথের অতি নিকটে আছি। আজ রবীন্দ্রনাথের জন্মতিথি সারা বিশ্ব পালন করবে। কিন্তু সব কিছু মনে রেখে আমার ‘কথা সামান্যই’। ভাগ্যিস্, রবীন্দ্রনাথ জন্মেছিলেন, আর তাইতো আমি বেঁচে গেলাম। লেখক : অর্থনীতিবিদ