ডেস্ক রিপোর্ট: আসন্ন ঈদুল ফিতর ঘিরে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বৃদ্ধির আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
তারা বলেন, অনেকেই ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ করছেন। রাস্তাঘাট, ফুটপাত, বাজারসহ বিভিন্ন স্থানে স্বাস্থ্যবিধি লঙ্ঘন হচ্ছে। এ অবস্থায় আজ থেকে জেলার সীমানায় গণপরিবহণ চালু হচ্ছে। এতে মানুষ দল বেঁধে গাড়ি বদল করে গ্রামে ফেরা শুরু করলে প্রাণঘাতী ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়বে। ফলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে পারে। যার প্রকাশ ঘটবে ঈদের দুই সপ্তাহ পর।
এছাড়া প্রতিবেশী দেশ ভারতে করোনার ভয়াবহতা দেখা দিয়েছে। দেশে তার প্রভাব পড়াও অস্বাভাবিক নয়। এসব কারণে যেখানে সাবধান হওয়ার কথা, ঘরে থাকার কথা, সেখানে মানুষ মাস্ক ছাড়াই বাইরে যাচ্ছে, জনসমাগম হয় এমন স্থানে যাতায়াত বাড়িয়ে দিয়েছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইউরোপের দেশ ইটালিতে প্রথম যখন ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়েছিল; পাশের দেশ স্পেনের মানুষ তখন ভেবেছিল- এটা ইটালির সমস্যা। তাদের কিছু হবে না। এরপর একটা সময় দেখা গেল ইটালির চাইতে স্পেনের অবস্থাই বেশি খারাপ হয়েছ। ফ্রান্স যখন তাদের নাগরিকদের হাসপাতালে জায়গা দিতে পারছিল না। প্রতিদিন শয়ে শয়ে মানুষের মৃত্যু হচ্ছিল; পাশের দেশ ইংল্যান্ড তখন ভেবেছিল- এটা ফ্রান্সের সমস্যা। তাদের কিছু হবে না।
ঠিক ২ সপ্তাহ পর ইংল্যান্ডের অবস্থা ফ্রান্সের চেয়ে খারাপ হয়ে যায়। আমেরিকার অবস্থা খারাপ হওয়ার পর তার পাশের দেশ মেক্সিকোর অবস্থা এখন এতটাই খারাপ, ওরা শেষকৃত্য করার জায়গা পর্যন্ত দিতে পারছে না। অথচ সপ্তাহ দুয়েক আগে সতর্ক হয়ে সঠিক প্রস্তুতি নিলে এসব দেশে যারা মারা গেছেন তার অর্ধেক মানুষকে বাঁচানো সম্ভব হতো। বর্তমানে ভারতে প্রতিদিন মৃত্যুর তালিকা দীর্ঘ হচ্ছে। হাসপাতালগুলো অক্সিজেন দিতে পারছে না।
দলে দলে মানুষ হাসপাতালের সামনে বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছেন। ভারতের পাশের দেশ হিসাবে আমরা যদি ভেবে থাকি- আমাদের কিছু হবে না; তাহলে আমরা বোকার স্বর্গে বাস করছি। ভাইরাস পরিস্থিতি যে দেশেই অনেক খারাপ হয়েছে; পরে তার পাশের দেশে এর প্রভাব পড়েছে তার চেয়ে ভয়াবহ। কারণ তারা নিজেরা প্রস্তুতি না নিয়ে অবহেলা করেছে।
তারা বলেন, তাই সময় থাকতে পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নিতে হবে। অক্সিজেন সরবরাহ বাড়ানোর চেষ্টা করতে হবে। পৃথকভাবে কিছু মানুষকে পরিস্থিতি সামাল দিতে স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে তৈরি করতে হবে। ভারতীয় নতুন ভ্যারিয়েন্টের ঢেউ যদি শেষ পর্যন্ত না আসে তাহলে ভালো। তবে এসে পড়লে সেটি হবে আরও ভয়াবহ। কারণ এ পর্যন্ত করোনার যতগুলো ভ্যারিয়েন্ট তার মধ্যে অন্যতম বিপজ্জনক ভারতের ধরনটি।
এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, ভারতের করোনার ধরন ঠেকাতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে বলেছে সরকার। কিন্তু তা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে না। ভারতের সীমান্ত এখনো পুরোপুরি বন্ধ করা হয়নি। যারা ভারত থেকে দেশে আসছেন, তাদের অনেকের ঠিকমতো কোয়ারেন্টিন হচ্ছে না। ভারতের করোনা রোধে দেশের যথাযথ প্রস্তুতি নেই উল্লেখ করে জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির এ সদস্য বলেন, ভারত থেকে আসার পর যাদের রিপোর্ট নেগেটিভ আসবে তাদের কোয়ারেন্টিন করার পর ছেড়ে দিতে হবে। আর যাদের পজিটিভ আসবে তাদের কোয়ারেন্টিন এবং চিকিৎসা সুরক্ষা বাস্তবায়ন করাতে হবে।
এর আগে ১৮ থেকে ২৪ এপ্রিল যশোরের বেনাপোল বন্দর দিয়ে ভারত থেকে আসা সাতজন করোনা রোগী কোয়ারেন্টিন না করে পালিয়ে যান। ভারতে করোনাভাইরাস পরিস্থিতি ভয়াবহ হওয়ায় এ বিষয়টি সারা দেশে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। কারণ এর আগে গত বছরের মার্চে ইতালি থেকে আসা কিছু মানুষ কোয়ারেন্টিন না মেনে বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে যান। পরে ওই কয়েকজন মানুষের কারণেই সারা দেশে রোগটা ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে।
এ প্রসঙ্গে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মুশতাক হোসেন বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ, ভিড় সৃষ্টি করা, ফেরিতে গাদাগাদি করে ওঠা এবং ঈদের জামাতে স্বাস্থ্য বিধি না মানলে ঈদের ২ সপ্তাহ পরে সংক্রমণ আবার বাড়বে। তিনি বলেন, স্বাস্থ্যবিধির শিথিলতার কারণে বিশেষ করে (নির্বাচন, হোলি, কুম্ভুসহধর্মীয় অনুষ্ঠান) ইত্যাদির কারণে ভারতে ভাইরাসের ভয়াবহতা দেখা যাচ্ছে। আমাদের দেশেও মার্চে একই কারণে সংক্রমণের হার বেড়েছিল। নিয়মতান্ত্রিকভাবে কিছু বিধিনিষেধ মানায় সেটি অনেকটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে।
ড. মুশতাক বলেন, ভারতীয় বা অন্য যে ভ্যারিয়েন্টাই হোক না কেন ভাইরাস রোধ করার নিয়ম একই। করোনা ঠেকাতে যে পদক্ষেপগুলো নেওয়া হয়েছে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। ভারতের করোনা ঠেকাতে বর্ডারের যাতায়াত বন্ধ করে দিতে হবে। যারা আসছে তাদের বাধ্যতামূলক ১৪ দিন কোয়ারেন্টিন করাতে হবে। জনগণকে সচেতন করতে হবে। তিনি বলেন, ভারতে থেকে অনেক লোক অনানুষ্ঠানিকভাবে দেশে আসেন। এক্ষেত্রে সীমান্তে স্থানীয় লোকদের ভূমিকা পালন করতে হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, গত বছরের মার্চে দেশে শনাক্তের হার ছিল ৩ দশমিক ১৮ শতাংশ, এপ্রিলে ১২ দশমিক ৮ শতাংশ, মে মাসে ১৬ দশমিক ১৭ শতাংশ, জুন মাসে ২১ দশমিক ৪৯ শতাংশ, জুলাই মাসে ২২ দশমিক ৪৬ শতাংশ, আগস্টে ২০ দশমিক ১৮ শতাংশ, সেপ্টেম্বরে ১২ দশমিক ৭০ শতাংশ, অক্টোবরে ১১ দশমিক ৩৮ শতাংশ, নভেম্বরে ১৩ দশমিক ১২ শতাংশ, ডিসেম্বরে ১০ দশমিক ৬৮ শতাংশ, জানুয়ারিতে ৫০ দশমিক ১০ শতাংশ, ফেব্রুয়ারিতে দুই দশমিক ৮২ শতাংশ, মার্চে ১০ দশমিক ৩৯ শতাংশ এবং চলতি এপ্রিলে ১৮ দশমিক ৫০ শতাংশ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, কমপক্ষে দুই সপ্তাহ যদি সংক্রমণের হার ৫ শতাংশের নিচে না নামে তাহলে কোনো দেশে করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রিত হয়েছে বলা যাবে না।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সফিউল্লাহ মুন্সি বলেন, ঈদের সময় যদি পরিস্থিতি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়, তাহলে সংক্রমণ প্রশমন করা অসম্ভব হবে। কারণ মার্চে আমরা যে পরিস্থিতি দেখেছি সেটা কিন্তু অনেকটাই কমে এসেছে। ঈদে যদি বিপুলসংখ্যক মানুষ গ্রামে না যান, তাহলে করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হবে। সূত্র: যুগান্তর