শিরোনাম
◈ জুলাই অভ্যুত্থানের সেই ঐক্য কোথায়? ◈ ব্রিটিশদের ‘নাকানিচুবানি’ দিতে ইরানের এক দশকের ‘ছায়া যুদ্ধ’: যেভাবে চলছে যুক্তরাজ্যের ভেতরে গোপন তৎপরতা ◈ চট্টগ্রাম কাস্টমস কমিশনার জাকির হোসেন বরখাস্ত, আরও কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা ◈ এবার অঝোরে কাঁদলেন মিসাইল ম্যান কিম জং উন (ভিডিও) ◈ জুলাই নিয়ে ‘আপত্তিকর’ ফেসবুক পোস্ট: পুলিশের বিরুদ্ধে ছাত্রদের অবরোধ-বিক্ষোভ ◈ নতুন উচ্চতায় রেমিট্যান্স: ২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রবাসী আয়ের সর্বোচ্চ প্রবাহ ◈ ডলারের দরপতনে রেকর্ড, ১৯৭৩ সালের পর সবচেয়ে বড় পতনে বিশ্ববাজারে আস্থার সংকট ◈ “৭১-এর মুক্তিযোদ্ধাদের মতোই চব্বিশের যোদ্ধাদেরও জাতি ভুলবে না” — তারেক রহমান ◈ গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে ঐক্য বজায় রাখার আহ্বান খালেদা জিয়ার ◈ শ্রীলঙ্কার বিরু‌দ্ধে বুধবার  সি‌রি‌জের প্রথম ওয়ানডে ম‌্যা‌চে  মু‌খোমু‌খি  বাংলাদেশ

প্রকাশিত : ০১ মে, ২০২১, ০১:৪৪ দুপুর
আপডেট : ০১ মে, ২০২১, ০১:৪৪ দুপুর

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

টলেডোতে মুসলমানদের হারানো ঐতিহ্য খুঁজতে...

আসাদুজ্জামান সম্রাট: চিনে যখন করোনা শণাক্ত হয় তখন আমি ইউরোপ ভ্রমণে। কাতার এয়ারওয়েজের একটি বিমানে দোহায় ট্রানজিট শেষ করে যখন মাদ্রিদে পৌছি তখন অবাকই হই। ইউরোপে এতো আলো ঝলমলে দেশ থাকতে পারে তা আমার ধারনার মধ্যে ছিলনা। বিমান বন্দরে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত পুলিশের সাবেক প্রধান হাসান মাহমুদ খন্দকার বললেন, আফ্রিকা লাগোয়া এই দেশটিই ইউরোপের সবচে’ আলোকউজ্জ্বল দেশ। যার সঙ্গে ইউরোপের অন্য দেশগুলোকে মেলানো যাবেনা। এর আগে ফ্রান্স, জার্মানি, বেলজিয়াম, ইতালি, লুক্সেমবার্গ ভ্রমণে অনেক সপ্তাহ গেছে সুর্যের মুখ দেখিনি।

কপ-২৫ সম্মেলনে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, মন্ত্রিপরিষদের অনেক সদস্যসহ সরকারি বেসরকারি কর্মকর্তা, এনজিও ব্যক্তিত্ব ও মিডিয়ার অনেক প্রতিনিধি অংশ নেন। বরাবরের মতো আমিও এসেছি সম্মেলন কভার করতে। মাদ্রিদের উপকণ্ঠে সবচে’ বড়ো এক্সিবিশন সেন্টার ‘ফিয়েরা দ্যা মাদ্রিদে’ দু’সপ্তাহের এ আয়োজনে সাপ্তাহিক ছুটির দু’দিনে স্পেনের সাবেক রাজধানী টলেডো এবং কর্ডোভা যাওয়ার পরিকল্পনা করলাম। পরিকল্পনা অনুযায়ী স্পেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রিজভী আলম ও সাংবাদিক ফখরুদ্দিন রাজী গাড়ি নিয়ে হাজির হলেন। প্রথমেই আমরা গেলাম মাদ্রিদ থেকে প্রায় ৭০ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত টলেডোতে। এক সময় এখানে মুসলমানদের আধিপত্য থাকলেও তা চলে গেছে খ্রিস্টান ও ইহুদির দখলে, তবে হারায়নি এখানকার সৌন্দর্য ও জৌলুস। আর এই সৌন্দর্য দেখার জন্য প্রতিদিন ভিড় জমায় পুরো বিশ্ব থেকে আসা হাজার হাজার দর্শণার্থী।

একটা প্রাইভেট কারে করে মাদ্রিদের শহরতলীর সৌন্দর্য দেখতে দেখতে আমরা এগিয়ে যাই টলেডোর দিকে। পথে আমরা সেভিলা যাওয়ার এ্যারো মার্ক দেখলাম। সেভিলার দিক নির্দেশক সাইনবোর্ডের সঙ্গে বড়ো দুই শিংওয়ালা ষাড়ের ছবি দেখিয়ে রিজভী আলম বলছিলেন, বুল ফাইটের জন্য বিখ্যাত সেভিলা। স্পেনের বিভিন্ন শহরে ঐহিত্যবাহী এ খেলা অনুষ্ঠিত হলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পশু প্রেমীরা এটি বন্ধের দাবি জানিয়ে আসছে। শহরতলীর এমন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতে দেখতে আমরা পৌছে যাই ইতিহাস ও ঐতিহ্যের শহরে।

দূর থেকে অনেকটা দুর্গের মতো মনে হয় টলেডো শহরকে। এর প্রবেশ পথে গেট, পাহাড়ী রাস্তা, পাশেই বয়ে চলা শীর্ণ নদী, নানা প্রজাতির পাখির কলকাকলীতে এক অপরূপ শিহরণ জাগালো। ইউরোপের ব্যস্ততম জীবনে নিজেদের কাজ রেখে আমাকে সঙ্গ দেয়ার জন্য বার বার ধন্যবাদ জানাচ্ছিলাম রিজভী ও রাজীকে। রিজভী আলম এমনিতেই ভালো একজন সংগঠক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রাজনীতি করে এসেছেন। মাদ্রিদে প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীও তিনি। আমার এক সময়ের বার্তা সম্পাদক আহমেদ ফারুক হাসানের ভাগ্নে ফখরুদ্দিন রাজী। এ সুবাদে আমিও তার মামা। সব কাজ রেখে বিমান বন্দরে যেভাবে ছুটে গেছেন তেমনি দর্শনীয় স্থানগুলোতে নিয়ে যেতেও তাদের চেষ্টার কমতি নেই। টলেডা শহরের প্রবেশ করতে করতেই চোখের সামনে ভেসে উঠলো লেবানিজ ইতিহাসবিদ প্রফেসর পি কে হিট্টির টলেডোতে মুসলিম শাসনামলের বর্ণনা। এই শহরের অনেক কিছুই মুসলমানের হাতে গড়া। অথচ খুবই নির্মমভাবে এখান থেকে বিতাড়িত হতে হয়েছিল মুসলিমদের।

শুধুমাত্র টলেডোই নয়, পুরো স্পেনের উন্নয়ন ও পূনর্গঠনে মুসলিমদের অবদান অন্যতম। ইতিহাস আজও তা স্বাক্ষ্য দেয়।। তিনদিকে সমুদ্র দ্বারা বেষ্টিতে স্পেনের পূর্ব দিকে ভূমধ্যসাগর, দক্ষিণে জিব্রাল্টার প্রণালী ও পশ্চিমে আটলান্টিক মহাসাগর। স্পেনের সঙ্গে ফ্রান্সের যে ভূখণ্ড সংযুক্ত তা প্রায় তিনশত মাইল পূর্ব-পশ্চিমে বিস্তৃত পিরেনিজ পর্বতমালা। মুসলমানদের শাসনামলে স্পেনের নাম ছিলো আন্দালুস। ইসলামপূর্ব সময়ে চির সৌন্দর্যময় এ ভূখণ্ডের রাজনৈতিক অবস্থা ছিলো অত্যন্ত শোচনীয়। তখন গথিক রাজাদের শাসন চলছিলো স্পেনে। তাদের সময়ে শাসক আর শোষিত-দুটি শ্রেণীর অস্তিত্ব পাওয়া যেতো। গথিক রাজাদের ৩০০ বছরের শাসিত সময়ে স্পেনের জনসাধারণের কোনোরূপ কল্যাণ সাধিত হয়নি। বরং তারা শাসক শ্রেণির দ্বারা নিয়মিত নির্যাতনের শিকার হতো। নানা সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যায় জর্জরিত।

স্পেনে বসবাসরত ইহুদিদের সদা ভূমিদাস, কৃতদাস আর বর্গাদার হয়ে থাকতে হতো। মনিবের অনুমতিক্রমে বিয়ে করতে পারলেও সন্তান জন্ম দেয়ার অধিকার ছিলোনা। এমন কষ্ট সইতে না পেরে তারা মনিব থেকে পালিয়ে গিয়ে জড়িয়ে পড়তো দস্যুবৃত্তিতে। ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সহিষ্ণুতা বলতে গেলে ছিলোই না। ৬১৬ খ্রিষ্টাব্দে ৯০ হাজার ইহুদীকে বলপূর্বক খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষিত করা হয়। ঘোষণা করা হয়, খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করতে হবে নতুবা দেশ ত্যাগ করতে হবে। সমগ্র ইউরোপ ছিলো শিক্ষা-দীক্ষায় অনগ্রসর, হীনমন্য এবং জ্ঞান-বুদ্ধিতে জড় এক আড়ষ্ট জনপদ। গৃহযুদ্ধ আর অন্তর্কলহ তদানীন্তন স্পেনের রাজনীতিকে পঙ্গু করে দিয়েছিলো। তাদের ভেতরকার এসব খারাপ পরিস্থিতিই মূলত স্পেনে মুসলমানদের প্রবেশের দ্বার উন্মুক্ত করেছিল।

মুসলমানদের বিজয়ের পূর্বে গথিক রাজা রডারিক পূর্ববর্তী রাজা উইটিজাকে হত্যা করে সিংহাসন দখল করে। ফলে উইটিজার ভাই,ছেলে আর জামাতা সবাই রডারিকের বিরোধী হয়ে ওঠে। অপরদিকে কাউন্ট জুলিয়ানের কন্যা ফ্লোরিডা রাজা রডারিক কর্তৃক ধর্ষণের শিকার হয়। এতে রাজা কাউন্ট জুলিয়ান ক্ষিপ্ত হয়ে রডারিকের প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য উত্তর আফ্রিকার মুসলিম গভর্ণর মুসা বিন নুসাইরকে (রা.) স্পেন আক্রমনের অনুরোধ করে। মুসা বিন নুসাইর (র.) খলিফার অনুমতিক্রমে তারেক বিন জিয়াদের (রা.) নেতৃত্বে ৩০০ আরব এবং ৭০০০ বার্বার সৈন্যের সমন্বয়ে গঠিত একটি ছোট দলকে স্পেন অভিযানে প্রেরণ করেন। এরপরে এ সৈন্যসংখ্যা বারো হাজারে উন্নীত হয়। অপরদিকে রডারিকের সৈন্যসংখ্যা ছিলো ১ লাখেরও উপরে। তারিক বিন জিয়াদ (র.) জিব্রাল্টার প্রণালী অতিক্রম করে স্পেনের পার্বত্য অঞ্চলে অবতরণ করেন। তিনি যে স্থানে ঘাটি স্থাপন করছিলেন, তা আজও ‘জাবালুত তারিক’ নামে পরিচিত। এই অংশটি এখনও ব্রিটিশ শাসিত এলাকা। ৭১১ সালের ১৯ জুলাই ওয়াদি লাস্কের নিকটবর্তী সারিস বা জেরেখে মুসলিম ও গথিক বাহিনীর মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ হয়। এ যুদ্ধ ইতিহাসে ‘ওয়াদি লাস্কে’র যুদ্ধ নামে পরিচিত। এ যুদ্ধে রাজা রডারিক শোচনীয়ভাবে পরাজিত ও নিহত হন। ফলে স্পেনের ভবিষ্যৎ রাজধানী কর্ডোভার এবং মূল রাজধানী টলেডোর পতন ঘটে। মুসলিম সৈন্যরা একে একে বিভিন্ন শহর জয় করতে থাকেন।

এভাবে মাত্র দুই বছরে পুরো স্পেন জয় হয়ে দামেস্কের শাসনভার উমাইয়া খিলাফতের অধীনে চলে আসে। মুসলমানদের আগমনের কারণে স্পেনে বয়ে যায় শান্তি-সুখের হাওয়া। বঞ্চিত জনসাধারণ ফিরে পায় তাদের হারানো স্বাধীনতা। মুসলমানদের অনুপম আদর্শ দেখে মানুষ দলে দলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে থাকে। বিশেষ করে দাস এবং নিম্নবর্ণের লোকেরা ইসলামের সাম্য সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হয়ে সবচেয়ে বেশি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। সমস্ত ধর্ম এবং বর্ণের মানুষেরা পায় নিজ ধর্ম পালন আর মুক্ত জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার অধিকার। প্রকৃতপক্ষে এ সময় থেকেই ইউরোপে মুসলিম রেনেসাঁর সূত্রপাত হয়। মুসলমানগণ ৭১১ সাল থেকে ১৪৯২ সাল পর্যন্ত স্পেন শাসন করেন। প্রথমদিকে মুসলিম শাসকদের খোদাভীতি আর ন্যায়পরায়ণতায় স্পেনে কুরআনি হুকুমত প্রতিষ্ঠিত হয়। সকল প্রকার অশান্তি, পেরেশানি, দ্বন্দ্ব-বিবাদ, বিদ্রোহ থেকে মুক্তি পায় সাধারণ মানুষ। উমাইয়া শাসনামলে এই টলেডোতে নির্মাণ করা হয় মসজিদসহ বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।

কিন্তু শেষের দিকে মুসলিম শাসকদের আন্তঃকলহ, বিরোধিতা, ক্ষমতার লোভ, গানবাদ্য, নারী, ভোগ-বিলাসে মত্ততা, নৈতিকতার অবক্ষয়, বিরোধী শক্তিদের একাত্মতা, ষড়যন্ত্র, ইসলাম বিদ্বেষিতা, বিদ্রোহী শক্তির একাত্মতা, বিদ্রোহ দমনে ব্যর্থতা সব মিলিয়ে মুসলিম খিলাফত দুর্বল হয়ে পড়ে। মুসলমানদের রাজ্য ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। শত্রুদের বিরুদ্ধে ক্ষণে ক্ষণে লড়াই অব্যাহত থাকে। আবার মুসলমানরাও নিজেদের মধ্যে গৃহযুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়ে। এই সুযোগে মুসলমানদেরকে স্পেন থেকে সমূলে উৎখাত করতে পর্তুগিজ রাণী ইসাবেলা পার্শ্ববর্তী খ্রিষ্টান রাজা ফার্দিনান্দকে বিয়ে করেন। বিয়ের পর দু’জন মিলে নেতৃত্ব দেয় মুসলিম নিধনের। খ্রিষ্টানদের সম্মিলিত বাহিনী হাজার হাজার নারী-পুরুষকে হত্যা করে, গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়ে উল্লাস করতে করতে ছুটে আসে রাজধানী গ্রানাডায়। সেদিন ছিলো ১৪৯২ সালের ১ এপ্রিল। খ্রিষ্টানদের বিশ্বাসঘাতকতায় বলি হয় গ্রানাডার হাজার হাজার মুসলিম নারী-পুরুষ। নিরাপত্তার জন্যে মুসলমানরা আশ্রয় নেয় মসজিদে। কিন্তু খ্রিষ্টানরা মসজিদে তালা লাগিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। মুহূর্তেই পুড়ে ছাই হয়ে যায় মুসলমানরা। চিরতরে হারিয়ে যায় তাদের আটশত বছর স্পেন শাসনের গৌরবময় স্মৃতি। স্পেন থেকে মুছে যায় ইসলামের শেষ চিহ্নটুকুও। এরপরে আর ঘুরে দাড়াতে পারেনি মুসলমানরা। ১ এপ্রিল মুসলমানদের বলা হয়েছিল, যারা মসজিদে আশ্রয় নেবেন। তাদের ক্ষমা করে দেওয়া হবে। দলে দলে সেদিন মুসলমানরা মসজিদে আশ্রয় নিয়ে প্রাণ হারিয়েছিল। সেদিন থেকে এই দিনটিকে ‘এপ্রিল ফুল’ হিসেবে পালন করে আসছে। ইতিহাস না জেনে আমরা এখনও মানুষকে ধোকা দেয়ার জন্য মজা করে হলেও এদিনটিকে বেছে নেই। অথচ এর ইতিহাস মুসলমানদের জন্য কতো নির্মম ও বেদনাদায়ক।

আগেই বলেছি, টলেডো আসার আগেই জেনে এসেছিলাম এখানে উমাইয়া আমলের প্রতিষ্ঠিত একটি মসজিদ রয়েছে। আমরা টলেডোতে প্রবেশ করে নদী পার হয়ে উত্তরাংশের একটি উচু ক্যাফেতে যাই। যেখান থেকে পুরো টলেডোকে দেখা যায়। সেই ক্যাফের ব্যালকনিতে প্রচন্ড ঠান্ডার মধ্যে কফিতে চুমুক দিতে দিতে টলেডোকে দেখি। দেখি বয়ে যাওয়া শীর্ণ নদীটিকে। যেদিন মুসলমানদের পরাজয় হয় সেদিন এই নদীর পানি আর মুসলমানদের রক্ত প্রায় সমান হয়ে গিয়েছিল। এতো বেশি মানুষকে হত্যা করে এ নদীতে ফেলা হয়েছিল যে, ব্রিজের গার্ডারের সঙ্গে মুসলমানদের মৃতদেহ আটকে নদীর প্রবাহই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। আমরা ক্যাফের ব্যালকনিকে বসে কফি পান করতে করতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। স্পট লাইটের আলোয় আলোকিত হয়ে আছে দূরের ইহুদিদের উপাসনালয় সিনেগগ, খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের উপাসনালয় গীর্জা। সুশোভিত গীর্জা ও সিনেগগ দেখার জন্য বহু পর্যটক এখানে ভীর করেছে। আমরা কফি খেয়ে উমাইয়া শাসনামলের মসজিদটি খুঁজতে যাই। পাহাড়ী উচু-নিচু শহরের প্রাণকেন্দ্র থেকে কিছুটা নিচে নামতে হয়। আমরা হেটেই সেই মসজিদের সামনে যাই। সেটা একটি অংশে খ্রিস্টানরা গির্জা নির্মাণ করলেও মসজিদটিকে অক্ষুন্ন রেখেছে। নির্দিস্ট দর্শনীর বিনিময়ে তা পরিদর্শন করা যায়। আমাদের যেতে যেতে সন্ধ্যা হয়ে যাওয়ায় মসজিদের ভেতরটা দেখা না হলেও বাইরে থেকে ছবি তুলে চলে আসি।

টলেডো শহরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা দোকানগুলোতে সাজানো আছে মধ্যযুগীয় সভ্যতার দৃষ্টিনন্দন সামগ্রী। টলেডোতে নানা কারুকার্জ খচিত তরবারিসহ বিভিন্ন শোপিস পাওয়া যায়। আমরা বেশ কয়েকটি দোকানে ঘুরে কিছু স্যুভেনির কিনেছি। এর আগে খোলা প্রাঙ্গনে রাস্তার পাশে আমাদের দেশের কাঠালের বিচির মতো দেখতে একটা ফল আগুনে সেকে বিক্রি করছে দেখে ফখরুদ্দিন রাজি কিনে নিয়ে আসলো। খেতে বেশ ভালোই, মুখরোচক। স্বাদ অনেকটা কাঠালের বিচির মতো হলেও এটি নাকি খুবই স্বাস্থ্যকর একটি খাবার। ফখরুদ্দিন রাজি জানাচ্ছিলেন, ইউনেস্কো ১৯৮৬ সালে টলেডোকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ হিসেবে ঘোষণা করে। বিভিন্ন সময়ে মুসলিম, খ্রিস্টান ও ইহুদিদের আধিপত্য থাকায় একে তিন সংস্কৃতির শহরও বলা হয়ে থাকে। আমরা সেন্ট মেরীস ক্যাথেড্রাল, এল গ্রেকো টেইল, সেন্ডা ইকোলজিকা দেখতে পারলেও। সন্ধ্যা হয়ে যাওয়ায় সান্তা ক্রুজ মিউজিয়াম দেখতে পারিনি। যে কোনো দেশ বা শহর ভ্রমণে আমার মিউজিয়ামের প্রতি আগ্রহ থাকলেও টলেডোতে এসে তা পূরণ করতে পারিনি। ইতিহাস বলছে, টলেডোতে ব্রোঞ্জ সভ্যতার সময়ে বসতি গড়ে ওঠে। ১৫৬৩ সালের আগ পর্যন্ত এটি স্পেনের রাজধানী ছিল এটি। পুরানো ভবন ও দেয়ালে ঘেরা এই শহরের আঁকাবাঁকা রাস্তায় মধ্যযুগীয় সভ্যতার চিহ্ন পরিস্কার।

ইতিহাস বলছে, আন্দালুসিয়ায় উম্মিয়া খিলফত বিলুপ্ত হলে বানু যুনুনুন বংশ টলেডোতে ক্ষমতাসীন হয়। তারা ছিলেন উত্তর আফ্রিকার বারবার বংশোদ্ভূত মুসলমান অভিজাত বংশ। এর আগে তারা সামরিক বাহিনীতে কর্মরত ছিলেন। এরা ৪২৭ হিজরী বা ১০৩৫-৩৬ সালে টলেডোর স্থানীয় ক্ষমতায় আসেন। ঐতিহাসিক সৈয়দ আমীর আলীর মতে, তারা ছিলেন খুবই শান শওকতের অধিকারী। তবে এই বংশের পরবর্তী শাসক ইয়াহিয়া আল-কাদির বিন-ইসমাইলের সময় মিত্রদের বিশেষ করে গুরুত্বপূর্ণ সেভিল শহরের শাসকের দ্বারা পরিত্যক্ত হলে উঠতি খ্রিস্টান রাজা ক্যাসটাইল ও লিওনের ষষ্ঠ আলফনসো-এর মিত্রতা গ্রহণে তিনি বাধ্য হন। তবে কর প্রদানে বাধ্য করা হয় আল-কাদিরকে। বিদেশি চাপে কর বৃদ্ধি হতে থাকে। আল-কাদির তখন প্রয়োজনে কর বাড়ালে জনসাধারণ বিদ্রোহী হলে করারোপ বন্ধ হয়। তবে তিনি কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তিকে বিদ্রোহের কারণে প্রাণদন্ডে দন্ডিত করলেন। এতে জনগণ বিদ্রোহ করলে তিনি টলেডো ছেড়ে চলে যান।

১০৭৭ খ্রিস্টাব্দে টলেডো রাজ্যভার বাদাজোসের ক্ষুদ্র আফতাসীয় রাজা আল-মুতাওয়াক্কিল গ্রহণ করেন। তবে কিছুকালের ভিতর খ্রিস্টান রাজা ষষ্ঠ আল ফনসো তার নামমাত্র মিত্র বিতাড়িত মুসলিম শাসক আল কাদিরের সঙ্গে মিলে আল কাদিরের জন্য টলোডো জয় করলেন। কিন্তু এটা ছিল খ্রিস্টান রাজার একটা ফাঁদ। ২৭ মুহাররাম, ৪৭৮ হিজরী তথা ২৫ মে, ১০৮৫ সালে ক্যাসটাইল-লিওনের খ্রিস্টান রাজা আলফনসো আল কাদিরের সঙ্গে একটি সন্ধি চুক্তি করেন। আলফনসো এর বাহানায় নিজেই টলেডো দখল করলেন আল-কাদিরকে না দিয়ে। সেই যে ১০৮৫ সালে মুসলমানরা টলেডো হারালো আর কেউই টলেডো পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হননি। ১৩৯১ খিস্টাব্দে টলেডোর ইহুদিদের উপর খ্রিস্টানরা চড়াও হয়ে শত শত জনকে হত্যা করল। ১৪৯২ খ্রিস্টাব্দে রানী ইসাবেলা রাজা ফার্ন্দিনান্দের হুকুমে টলেডোসহ সমগ্র স্পেন থেকেই ইহুদিরা বিতাড়িত হয়ে আরব ও তুর্কী মুসলিম দেশগুলোর আশ্রয়ে গেল। অন্যদিকে টলেডো তথা স্পেন থেকে মুসলিম বিতাড়নও শুরু হলো। যেসব মুসলমানকে বাধ্য করে খ্রিস্টান করা হয়েছিল তারাও তাদের ধর্ম গোপনে পালন করার সময় ধরা পড়ে হয় আগুনে পুড়ে নিহত, না হয় বিতাড়িত হোল। টলেডোর দুর্দিন তখন থেকেই শুরু হোল। টলেডো আর তার সুদিনে ফিরতে পারেনি।

প্রফেসর পি কে হিট্টির মতে টলেডো শহরের অনেক কিছুই মুসলমানদের হাতে গড়া। মুসলমানরা এখানে উন্নত তরবারি তৈরি পদ্ধতি নিয়ে যায়। দামাস্কাসের ন্যায় টলেডোর ইস্পাত ও জগদ্বিখ্যাত হয়ে উঠে। ইস্পাত ও অন্যান্য ধাতব পদার্থে সোনা, রুপা দিয়ে ফুলের মতো করে সাজসজ্জা করার পদ্ধতি দামাস্কাস থেকে টলেডো ও অন্যান্য স্পেনীয় ও ইউরোপীয় শহরে ছড়িয়ে পড়ে। এমনকি ‘দামাস্কাস’ শব্দটা পর্যন্ত পাশ্চাত্যের ভাষায় ঢুকে পড়ে, ইংরেজি ‘দামাসসেন’ ‘দামাসকেন’, ফরাসী। ‘দামাসকুইনের’, ইটালিয়ান ‘দামাসকিনো’ হোল এই সব শব্দ যার মূল হল ‘দামাস্কাস’। টলেডো ও সেভিলের ধাতব দ্রব্য খুব নাম করা ছিল। চামচ ও অন্যান্য রন্ধনশালার সামগ্রী, তরবারি, এস্ট্রোলেব ছিল জনপ্রিয়। দামাস্কাসের পরেই টলেডোর তরবারি পৃথিবী বিখ্যাত। টলেডো শহর মুসলিম আমলে তৈজসপত্র প্রস্তুতে বিখ্যাত ছিল। সেখানকার চীনামাটির দ্রব্যাদি ছিল খুবই উন্নত। এখনও তার প্রচলন আছে। টলেডোতে এসব জিনিপত্র বিক্রি হয় স্যুভেনির হিসেবে। বিদেশী পর্যটকরা এগুলো কিনে নিয়ে যান। টলেডোতে মুসলিম জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা সমুদ্রের নাবিকদের ব্যবহারের উপযোগী এস্ট্রোলেব যন্ত্র তৈরি করতেন। এসব যন্ত্র ছাড়া সে যুগে সমুদ্র পরিবহন অসম্ভব ছিল। “দি লিগেসি অব ইসলাম” বইয়ে এ এইচ ক্রিস্টি লিখেছেন যে, একটা এস্ট্রোলেব তৈরি করেছিলেন টলোডোর ইব্রাহিম ইবনে সৈয়দ ১০৬৬-৬৭ খ্রিস্টাব্দে। টলেডো খ্রিস্টানদের হাতে চলে গেলেও দু’শতাব্দী পর্যন্ত আরবী ভাষা সেখানে আইন ও ব্যবসার ভাষা হিসাবে ব্যবহৃত হয়। টালেডোর খ্রিস্টান রাজা ষষ্ঠ আলফনসো ও তার কয়েক উত্তরাধিকারী তাদের মুদ্রায় আরবী ছাপ দিতেন। উল্লেখ্য যে আরাগনের প্রাথমিক এক রাজা প্রথম পিটার শুধুমাত্র আরবী লিখতে পারতেন।

ইতিহাসবিদ আর্নেস্ট বার্কার লেখেন, টলেডো যখন খ্রিস্টানদের হাতে পুনর্দখল হলো টলেডো মসজিদের লাইব্রেরিও তাদের দখলে গেলে তা থেকে তারা ফায়দা হাসিল করে। টলেডো থেকেও মুসলমানদের চিকিৎসা বিজ্ঞানসহ অন্যান্য জ্ঞান-বিজ্ঞান ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। টলেডোতে বসে ক্রিমোনার গেরার্ড ও মিকায়েল স্কট আরবী থেকে অনুবাদ করে জ্ঞানকে ছড়িয়ে দিচ্ছিলেন ইউরোপে। টলেডো শহর অনুবাদ কর্মের একটা বড় কেন্দ্র হওয়ার কারণ হল টলেডো মুসলমানদের হাত ছাড়া হয়ে গেলেও স্পেনের বাকি মুসলিম এলাকার এটি খুব নিকটবর্তী ছিল। গ্রানাডা থেকে মুসলমানরা উৎখাত হল ১৪৯২ সালে। বাকি ইউরোপ তখনও অন্ধকারে। তাই মুসলমানদের উপর সামরিক আঘাত হানলেও খ্রিস্টানরা ইউরোপ মুসলমানদের উন্নত জ্ঞান-বিজ্ঞান আহরণের চেষ্টা করলো। মুসলিম এলাকার লাগোয়া তখনকার খ্রিস্টান টলেডো গ্রন্থ সংগ্রহের অনুবাদ কর্মের কেন্দ্রে পরিণত হলে।

প্রফেসর পি কে হিট্টি লেখেন, ১০৮৫ খৃস্টাব্দে টলেডো খ্রিস্টানরা দখলে নিলেও এর মুসলিম শিক্ষা কেন্দ্রগুলো রয়ে যায়। ব্রিটেন থেকেও বিদ্যোৎসাহীরা টলেডোতে ভিড় জমিয়েছিল জ্ঞান আহরণের জন্য। এর মধ্যে ছিলেন স্কটল্যান্ডের মিকায়েল স্কট ও চেষ্টারের রবার্ট ছিল উল্লেখযোগ্য। ১১৪৫ সালে রবার্ট আলুখারিজমির এলজেবরার অনুবাদ করলেন। ১১৪৩ সালে তিন হারমান দি ডালমাসিয়ানের সঙ্গে মিলে কোরআনের প্রথম ল্যাটিন অনুবাদ করেন। এমনকি মুসলমান ও ইহুদিদের ভিতর খ্রিস্টানী মতবাদ প্রচার করতে ১২৫০ খ্রিস্টাব্দে ‘অর্ডার অব প্রিচারস’ নামক এক গোষ্ঠীর দ্বারা ইউরোপের প্রথম প্রাচ্য বিষয়ক স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয় টলেডোতে। টলেডোতে থাকাকালীন মিকায়েল স্কট অনেক গ্রন্থের সঙ্গে আল-বিটরুজির জ্যোতির্বিদ্যার গ্রন্থ ‘আল-হায়া’, ইবনে রুশদের ব্যাখ্যাসহ এরিস্টটলের কিতাব অনুবাদ করেন। তবে ক্রিমোনার গেরার্ড সবচেয়ে বেশি বই অনুবাদ করেন টলেডোতে বসে।

আমরা সেসব ঐতিহাসিক জায়গাগুলো খুঁজে দেখার চেষ্টা করেছি। ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি ও প্রচণ্ড শীতের কারনে স্থানীয় অনেক লোক ঠিকভাবে বিষয়গুলো যেমন বোঝেননি তেমনি আমাদের বোঝাতেও পারেননি। তারপরেও একদিনের সফরে ইসলামের হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য খোঁজার চেষ্টায় আমাদের কমতি ছিলনা। ফেরার পথে খুব আফসোস হচ্ছিলো সে সময়ের মুসলিম শাসকদের উপর। ভোগ বিলাসে মত্ত না থেকে জ্ঞান বিজ্ঞানের যে চর্চা তারা শুরু করেছিলেন তা অব্যাহত রেখে চললে আজকে পুরো বিশ্বে মুসলিমদের এক অন্য পরিচয় হতো।

আর এ কারনেই হয়তো স্পেনের শেষ মুসলিম শাসক আবু আব্দুল্লাহ যখন রাজধানী ছেড়ে চলে যাচ্ছিলেন তখন তার মা তাকে বলেছিল, ‘আনন্দ বিলাসে সময় না কাটিয়ে ইসলামের সৌন্দর্য ও মহত্ত প্রচার করে শাসনভার পরিচালনা করলে আমার আজ এ দৃশ্য দেখতে হতো না। ইসলামী হুকুমত থেকে দূরে চলে যাওয়া তোমাকে জন্ম দেয়াই ছিল আমার পাপ।’ লেখক জে রেড তার বই ‘দি মুরস ইন স্পেন এ্যান্ড পর্তুগাল’ বইয়ের ২১৯ পৃষ্ঠায় আবু আব্দুল্লাহ’র প্রতি তার মায়ের শেষ উক্তি যুক্ত করেছেন, ‘যেহেতু পুরুষের মতো দাঁড়িয়ে রক্ষা করতে পারোনি, নারীর মতোন ফুঁপিয়ে কাঁদো।’ স্পেন তথা ইউরোপের মুসলমানদের সেই কান্না এখনো শেষ হয়নি। কখনো সন্ত্রাসবাদ, জঙ্গীবাদ কিংবা শুধুমাত্র ‘মুসলিম’ এই পরিচয়ে নানা লাঞ্চনা ও বঞ্চনার শিকার হতে হচ্ছে এখনো।

লেখক: আসাদুজ্জামান সম্রাট, নগর সম্পাদক-দৈনিক আমাদের অর্থনীতি ও সম্পাদক-পার্লামেন্ট জার্নাল।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়