অজয় দাশগুপ্ত: জন্মগত পরিচয় হিন্দু হওয়ার কারণে লেখালেখি করতে এসে যতো গালি শুনেছি তার সিংহ ভাগ ভারতকে জড়িয়ে। দেশবিভাগের দাঙ্গার পর পিতৃকূল ও মাতৃকূলের প্রায় সবাই চলে গেলেও আমার মা-বাবা জন্মভূমি ছেড়ে যাননি। তারা দুজন ঘুমিয়ে আছেন চট্টগ্রামে। একাত্তরে শরণার্থী হয়ে প্রথম ভারত যাই। বাংলাদেশ তখন রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে লড়ছে। আসাম, নাগাল্যান্ড, ত্রিপুরা হয়ে কলকাতা পৌঁছানো আমরা কোথাও শরণার্থী বলে অপমানিত হইনি। পুরো নয় মাসজুড়ে পশ্চিমবঙ্গ ও ভারতের মানুষ দিয়েছিলো প্রাণখোলা অকুণ্ঠ সমর্থন। তখনকার প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী না থাকলে বাংলাদেশ কতোদিনে স্বাধীন হতো বা আদৌ মুক্ত হতে পারতো কিনা এ সংশয় থেকেই যায়।
এক কোটি শরণার্থীকে খাইয়ে পরিয়ে যুদ্ধ করে বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে পাশে দাঁড়িয়েছিলো ভারত। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে শিল্প, সংস্কৃতি বাণিজ্য, খেলাধুলা সব মিলিয়ে নিবিড় যোগাযোগ গড়ে ওঠে। কয়েক বছর পরপর কলকাতা যাওয়া তখন নেশা। সিডনি চলে আসার পর বহুদেশ বহুজাতি ভ্রমণে অভ্যস্ত হওয়ার পরও মনে হয় ভারত না গেলে যাত্রা পূর্ণতা পায়নি। কারণ ইতিহাস, কারণ অতীত ঐতিহ্য ও সংযোগ। অমৃতসরের স্বর্ণ মন্দির দেখতে গিয়ে জালিওয়ানাওয়ালা বাগে না গেলে হয়? ভারতবর্ষের স্বাধীনতার নান্দীপাঠ রক্ত মাখা সে ঘটনায় রবীন্দ্রনাথ ছেড়ে দিয়েছিলেন তার নাইট উপাধি। সাউথ ইন্ডিয়া গেলেই মনে পড়ে বিবেকানন্দের কন্যা কুমারিকা।
বাঙালি মনীষা দার্শনিক ঋষি অরবিন্দের পন্ডিচেরী না ঘুরে এলে কী তীর্থ হয়? বাংলার মানুষ প্রেম পড়লেই যে জিনিসটা গড়ে তোলে তার নাম তাজমহল। মনে তার যমুনার ঢেউ। দিল্লি যাবেন জামে মসজিদ দেখবেন না? কুতুব মিনার না দেখে উপায় আছে? রোজ দরকার পড়ে জয়তীর রবীন্দ্র সঙ্গীত, সুমন, নচিকেতা হয়ে রূপংকরের গান। ভারত মানেই তো রবীন্দ্রনাথ, চুরুলিয়ার নজরুল, গান্ধী, বিদ্যাসাগর, রামমোহন রায়, সত্যজিত রায়, বিভূতি ভূষণ, মানিক, সুনীল, শঙ্খ ঘোষ। আজ ভারত মহামারীর যুদ্ধে পরাস্ত হওয়ার পথে। প্রতিদিন চিতার আগুন কবরের মাটিতে কাঁদছে ভবিষ্যৎ। যতো সমস্যা, যতো অভিমান, যতো রাগ, অভিযোগ থাকুক সে হিসেব পরে। এখন একটাই প্রার্থনা, উঠে দাঁড়াক ভারত। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ভারতকে সেই স্বর্গে করো জাগরিত, করোনামুক্ত হোক প্রতিবেশী।