শিরোনাম
◈ নির্বাচনী দায়িত্বে অপরাধের সাজা বাড়ছে: অধ্যাদেশের খসড়া অনুমোদন ◈ দেওয়ানি ও ফৌজদারি আদালত সম্পূর্ণভাবে পৃথক করলো সরকার ◈ অহেতুক চাপ সৃষ্টি করতে জামায়াতের কর্মসূচি: মির্জা ফখরুল ◈ জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি ও পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের দাবিতে রাজপথে সাত দল ◈ স্ত্রী আসলেই নারী কি না প্রমাণ দেবেন ম্যাখোঁ ◈ আগামী বছরের বইমেলার সময় পরিবর্তন ◈ সৌদি-পাকিস্তান প্রতিরক্ষা চুক্তি, যা জানালো ভারত ◈ সরকারি কর্মচারীদের জন্য বড় সুখবর: অবসরে বাড়ছে সুযোগ-সুবিধা, কমছে অপেক্ষাকাল ◈ আগামীকাল ৮ ঘণ্টা গ্যাস থাকবে না যেসব এলাকায় ◈ সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে সন্ত্রাসীদের হামলায় যমুনা টিভির সাংবাদিকসহ আহত ৫

প্রকাশিত : ২৮ এপ্রিল, ২০২১, ০২:২১ দুপুর
আপডেট : ২৮ এপ্রিল, ২০২১, ০২:২১ দুপুর

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

ভালোবাসা বন্দীর ব্যাকুলতা...

আসাদুজ্জামান সম্রাট: সত্যিই কী ভালোবাসা বন্দী করা যায়? কিভাবে সে প্রশ্নের উত্তর নিয়ে হয়তো গবেষণা হয়েছে বিস্তর। কিন্তু একটি তালা দিয়ে ভালোবাসা বন্দীর আকুলতা দেখে এসেছি প্যারিসের সিন নদীর এক ব্রিজে। শুধু একটি কী ব্রিজেই নয়-নদীর অন্য ব্রিজগুলো ঝা[াও যেখানে যা পেয়েছে তাতেই প্রেমিক-প্রেমিকার নামের প্রথম অক্ষর লিখে তালা লাগিয়ে চাবিটা সিন নদীতে ফেলে দিচ্ছে নানা বয়সের তরুন-তরুণী থেকে বয়স্কার । প্রেমকে অমর করে রাখার এ এক অন্য ব্যাকুলতা।

ইউরোপ ভ্রমণে পৃথিবীখ্যাত ল্যুভর মিউজিয়ামে মোনালিসার সাথে সাক্ষা’ করে বের হতেই সিন নদীর তীর। সেই তীর ধরে হাটতে হাটতেই পাওয়া গেলো পন্ট ডেস আর্টস। এটি পিকনিক এবং ওপেন-এয়ার আর্ট স্টুডিওর জন্য একটি জনপ্রিয় স্পট। সিন নদী এবং ল্যুভরের বরাবর এই সেতুর অবস্থান ফটোগ্রাফারদের জন্য একটি জনপ্রিয় স্থান হিসাবে তৈরি করেছে। এখানে দাড়িয়ে ছবি তুললে একদিকে যেমন ল্যুভরের লুক পাওয়া যাবে অন্যদিকে দেখা যাবে দিগি¦জয়ী বীর নেপোলিয়ানের বাড়ি। পন্ট ডেস আর্টস প্যারিসের ‘লাভ লক ব্রিজ’ নামেই সর্বাধিক পরিচিত। সেতুর দর্শনার্থীরা এর রেলিংয়ের সাথে তালাগুলো দেখে বিস্ময় নিয়ে। সুযোগ পেয়ে আমিও তার ব্যতিক্রম কিছু করলাম না। একটি ছোট্ট তালায় আমার আর লিনার নাম লিখে ঝুলিয়ে দিয়ে এসেছিলাম সেই ২০১৫ সালে। তারপরে নিজেরা অনেক যুদ্ধ-বিগ্রহ করলেও এখনও ছাড়াছাড়ির পর্যায়ে যায়নি। আর এ কারনেই হয়তো মাঝে মাঝে নিজেরও এই অবৈজ্ঞানিক তত্ত্বটাকে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে।

No description available.

এনিয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই যে, পৃথিবীর সবচেয়ে রোমান্টিক শহর প্যারিস। প্রেমিক-প্রেমিকাদের স্বপ্ননগরী বলেও খ্যাতি আছে প্যারিসের। প্যারিসকে বলা হয় কৃষ্টি ও সংস্কৃতির শহর। এ নগরীকে দেখে প্রেমে পড়েননি এমন মানুষ নেই। প্রেম-ভালোবাসায় মাখামাখি এ শহরের প্রতিটি সড়ক, স্থাপনা আর ক্যাফে। নবদম্পতিরাও ছুটে আসেন এ শহরে। রাতের প্যারিসের সৌন্দর্য লিখে বর্ণনা করা সম্ভব নয়। সুনসান নীরবতায় রাতের প্যারিসে হেঁটে চলার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। প্যারিসের মতো গোছানো শহর খুব কমই রয়েছে। এজন্যই হয়তো পর্যটকদের প্রিয় এই শহর। পরিচ্ছন্ন ও স্বচ্ছ বাতাসে ঘুরে বেড়ানো মানুষের মনে মুহূর্তেই আনন্দের জোয়ার ওঠে এ শহরে এসে। যারা সংস্কৃতিপ্রেমী তাদের জন্য প্যারিস যেন কল্পনার নগরী। এত সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ শহর গোটা দুনিয়ায় আর একটিও নেই বলে আমার বিশ্বাস।

ফিরো যাই ‘লাভ লক ব্রিজের’ গল্পে। বিষয়টি হাস্যকর, অদ্ভুত, দৃষ্টিকটু মনে হলেও প্যারিসে সিন নদীতে এই তালা সেতুটি মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। প্রতি বছর হাজার হাজার পর্যটক এসে সেখানে ভালোবাসার চিহ্নস্বরূপ তালা ঝুলিয়ে রাখে এবং পরে নদীতে ঐ চাবিগুলো ফেলে যায়। এসব তালাগুলো বিভিন্ন দেশ থেকে নিয়ে আসে। বিষয়টি ভাবতে অদ্ভুত মনে হলেও দীর্ঘকাল ধরে চলে আসছে তালা ভালোবাসার রীতি। বাহারী তালাগুলো দেখতে একেকটা একেক রকম। এই এলাকায় ভাসমান হকারদের কাছে লাভ আকৃতির তালা আছে। ৫ থেকে ১০ ইউরোর মধ্যে কিনতে পারেন আপনিও। তাতেই মনে কথা লিখে স্কচটেপে মুড়িয়ে লাগিয়ে দিতে পারেন। আমিও এমনটা করেছিলাম বলে সহকর্মী দুই বন্ধু হেসেছিল।

No description available.

লাভ লক ব্রিজ এর মর্মার্থ হলো, ভালোবাসায় তালা মেরে চাবিটা ছুড়ে ফেলুন সেইন নদীতে। যে তালার চাবি কেউ খুঁজে পেলেও তালা কোনটি তা খুঁজে পাওয়া অসম্ভব। ফলে কোনোদিন খুলবেনা তালা। আর ভাঙবেনা তাদের প্রেম। আলাদা হবে না প্রেমের জুটি! এমন সরলপ্রাণ বিশ্বাসেই প্রতি বছর প্যারিসের সেতুগুলোতে ‘লাভ লকস’ বা ‘ভালোবাসার তালা’ ঝুলিয়ে দেয় প্রায় সাত লাখ জুটি। তরুণ কপোত-কপোতীদের জন্য এটা অনেকটা যেন ‘শিল্প আর প্রেমের রাজধানী’তে নিজেদের ভালোবাসার স্বাক্ষর রেখে যাওয়া। নিজেদের জন্য এক স্মৃতির জানালা খুলে রেখে যাওয়া। সাম্প্রতিক সময়গুলোতে বিতর্ক উঠেছে, এটা যেমন নান্দনিক নয়, তেমনি প্যারিসের স্থাপত্যগুলোর জন্যও তা ঝুঁকিপূর্ণ। তাই প্যারিসে এই ভালোবাসার তালা নিষিদ্ধের জন্য শুরু করেছেন ‘নো লাভ লকস’ প্রচারাভিযান। এজন্য ২০১৫ সাল থেকে প্যারিসের সেতুতে তালা ঝোলানো নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু কেউই তা মানছে না। নগর কর্তৃপক্ষ সময়ে সময়ে এসব তালা অপসারণ করছে।

ব্রিজের ইতিহাস বলে, প্যারিস শহরে এই নদী পারাপারে এক সময় সেতু ছিল না। ৮৪৫ সালে ভাইকিংসদের এর মাধ্যমে বস্তা ফেলে নদীর ওপর সেতু নির্মাণ করা হয়েছিল। এই কৌশলটি কার্যকর হলেও নদীর জাহাজগুলি ব্রিজগুলি পেরিয়ে যেতে পারছিল না। পরে এটি সংস্কার করে জাহাজ চলাচলের উপযোগী করা হয়। বর্তমানে প্যারিসের শহর সীমানার মধ্যে নদী পারাপারের জন্য সাতত্রিশটি ব্রিজ রয়েছে। এর মধ্যে কেবল পাঁচটিই পথচারী সেতু হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এদের মধ্যে প্যারিসে সর্বাধিক আইকনিক ব্রিজ পন্ট ডেস আর্টস বা লাভ লক ব্রিজ। ১৮০৪ সালে সালে নেপোলিয়নের রাজত্বকালে এটি পুরোপুরিভাবে নির্মিত হয়েছিল। মূল পন্ট ডেস আর্টস প্রথম এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় দুটি বিমান হামলা চালিয়েছিল এবং একই সাথে একটি জাহাজের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়। ১৯৭৯ সালে ভেঙে যাওয়ার আগে অসংখ্য সংঘর্ষ হয়েছিল। বর্তমান ব্রিজটি ১৯৮৪ সালে সালে নির্মিত হয়েছিল। ইউনেস্কো সিন নদীর পাশাপাশি এই ব্রিজকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসাবে ঘোষণা করেছে।

No description available.

তালা ঝুলানোর অদ্ভুত কাণ্ড শুধুমাত্র প্যারিসে সীমাবদ্ধ নেই। আলজেরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, আয়ারল্যান্ড, ইতালি, জার্মানি, ব্রাজিল, জাপানসহ নানা দেশেই এমন ব্রিজের দেখা মেলে। প্রায় ১০০ বছর হতে চলল, লাভ লক বা প্রেমের তালা জুড়ে দেওয়ার এই চর্চা করে আসছে প্রেমিক-প্রেমিকারা। সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের ঢাকা শহরের হাতিরঝিলে এই ‘লাভ লক’ লাগানোর প্রবণতা শুরু হয়েছে। মহানগর প্রকল্পের সামনের ব্রিজের রেলিংগুলোতে অসংখ্য তালা চোখে পড়বে যাতে ভালোবাসার বিভিন্ন কথা লেখা আছে। ভালোবাসার তালায় তালায় হয়তো একদিন এ ব্রিজ থেকেও তা সরানোর জন্য নগর কর্তৃপক্ষকে এগিয়ে আসতে হবে।

বিশ্বব্যাপী এই প্রবণতার শুরুটা হয়েছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে প্রচলিত গল্প রয়েছে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় নাডা নামের এক সার্বিয়ান বালিকা প্রেমে পড়েছিল স্থানীয় এক অফিসার যুবকের। সেই যুবকের নাম ছিল রেলজা। কিন্তু কিছুদিন পরই রেলজা যুদ্ধ করতে চলে যায় গ্রিসে। গ্রিসে গিয়ে রেলজা সেখানকার এক মেয়ের প্রেমে পড়ে। ভুলে যায় নাডাকে। সেই বিরহেই প্রাণ যায় প্রেমিকা নাডার। এই হৃদয় বিদারক ঘটনা আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ে সার্বিয়ায়। এরপর থেকে সার্বিয়ার বানজার এলাকার মেয়েরা একটি তালার মাঝে প্রেমিক-প্রেমিকা দুজনের নামের প্রথম অক্ষর লিখে সেটি ঝুলিয়ে দিত বানজারের একটা ব্রিজে। এই ব্রিজে বিকাল হলেই নাডা এবং রেলজা দেখা করত। এই ইতিহাস পরে ছড়িয়ে যায় সারা পৃথিবীতে। দেশে দেশে ব্রিজের ওপর লাভ লকের গল্প হয়তো এখান থেকেই শুরু।

২০১৯ সালর ডিসেম্বরে বেড়াতে গিয়েছিলাম ভাসমান শহর হিসেবে পরিচিত ভেনিসে। ইতালির এ শহরটির মতো নান্দনিক শহর পৃথিবীতে খুব কমই আছে। পুরো শহরটির বুক চিরে বয়ে গেছে স্বচ্ছ জলের প্রবাহ। পরিষ্কার জলের এ লেকগুলো এতটাই স্বচ্ছ যেন গা-ঘেঁষে মাথা উঁচু করে থাকা দালানগুলোর প্রতিবিম্ব আর আকাশে ছুটে চলা মেঘ যেন নেমে এসেছে পানিতে। এ শহরে ঘুরে বেড়ানোর জন্য রয়েছে বিশেষ ধরনের নৌকা। এসব নৌকায় করে আপনি দালানের ভিড়ে চলতে পারবেন এক স্থান থেকে অন্য স্থানে। এ শহরে নেই কোলাহল, নেই যান্ত্রিক ব্যস্ততা। শুধু প্রশান্তি যেন বিছিয়ে আছে পুরো শহরটিতে। পর্যটকদের পদচারণায় মুখর থাকে বছরের বেশির ভাগ সময় ভেনিস। সেখানে অসংখ্য ছোট ছোট ব্রিজ ও নদীর পাড়ের রেলিংয়ে ঝুলে আছে অসংখ্য তালা। শুধু এ শহরেই নয় বর্তমানে প্রেমের তালাগুলো নিউ ইয়র্কের ব্রুকলিন ব্রিজ, জার্মানির কোলনের হোহেনজোলারেন ব্রিজ ও জাপানের এনোশিমা দ্বীপে এ লাভ-লক গুলো বেশি দেখা যায়। আয়ারল্যান্ডের রাজধানী ডাবলিনের হা পেনি সেতুটিও এই ভালোবাসার তালা বা ‘লাভ লক’ ঝোলানোর জন্য বিখ্যাত। ২০১২ সালে ডাবলিনের সিটি কাউন্সিল সেতুতে ভালোবাসার তালা ঝোলানো নিষিদ্ধ করে এবং শহরের যে কোনো সেতুতে এমন তালা দেখা গেলেই তা সরিয়ে ফেলার ঘোষণা দেয়। তবে, জনগণের তোপের মুখে কোলনের সেতুতে ‘লাভ লক’ নিষিদ্ধের চেষ্টা থেকে বিরত হয় নগর কর্তৃপক্ষ।

লাভ লক ব্রিজ থেকে আমরা চলে যাই প্যারিসের আইকন হিসেবে পরিচিত আইফেল টাওয়ার দেখতে। এর আগে আমি দু’বার আইফেল টাওয়ার দেখেছি, দু’বারই রাতে। রাতের আইফেল টাওয়ারের সৌন্দর্য্য অন্যরকম। যা বর্ণনা করা যায়না। প্রথম দেখাতে আমার কাছে এটিকে আমাদের বিদ্যুতের খুটির মতো মনে হয়েছিল। কাছে গিয়েই বুঝলাম এর মহত্ত্ব। কেনো আইফেল টাওয়ার বর্তমানে বিশ্বের কাছে বিস্ময় হিসেবে রয়ে গেছে। প্রথমবার এই টাওয়ার দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলেন প্যারিস প্রবাসী আওয়ামী লীগ নেতা মো. আতিকুজ্জামান। প্যারিসে সন্ত্রাসী হামলা হয়েছিল কিছুদিন আগে। এর প্রতিবাদ স্বরূপ তখন রাতে আইফেল টাওয়ারের বাতিগুলো জ্বালানো হয়নি। দ্বিতীয়বার দূর থেকে দেখেছি বন্ধু মাহাবুব হোসাইনের বাসায় যেতে যেতে। দিনের বেলায় গেলাম বন্ধু দোলনের সঙ্গে। ওর ডিএসএলআর ক্যামেরায় বেশ কিছু ছবিও তুলে দিয়েছিল।

No description available.

আমার মতোই প্যারিসবাসী একসময় ভেবেছিল, লোহার টাওয়ারটি শহরের সৌন্দর্য নষ্ট করবে। বিশাল এই টাওয়ার নির্মাণের পরিকল্পনাটিকে প্যারিসের সকল অধিবাসীরা প্রথমে ভালোভাবে নেয়নি। অনেকেই এটিকে শহরের জন্য বেহুদা এবং বিকট, দৃষ্টিকটু, উদ্ভট হবে বলে মনে করেছিলেন। এমনকি প্যারিসের ৩০০ জন গণ্যমান্য ব্যক্তি টাওয়ারটি নির্মাণের পরিকল্পনা বাতিলের জন্য প্রকাশ্যে বিরোধীতা করেছিলেন। নির্মাণের পরেও উঁচু এ টাওয়ারটি অনেকেরই চক্ষুশূল হয়েছিল। সে সময় বিভিন্ন সংবাদপত্রে পাঠকদের পাঠানো চিঠিপত্রে দেখা যায়, তারা একে শহরটির অন্যান্য স্থাপনার সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ বলে মনে করছিলেন। কিন্তু শিল্প ও বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব এই নিদর্শন দ্রুতই গর্বের বিষয় হয়ে ওঠে। বর্তমানে প্রতি বছর বিশ্বে সবচেয়ে বেশি পর্যটককে আকৃষ্ট করে থাকে আইফেল টাওয়ার। প্রতি বছর এ টাওয়ার দেখতে প্রায় ৭০ লাখ দর্শনার্থী আসে, যাদের ৭৫ ভাগই আসে বিদেশ থেকে। বিশ্বে অর্থের বিনিময়ে দেখা স্থাপনার শীর্ষে রয়েছে এ টাওয়ার। ওয়ার্ল্ড ট্যুরিজম-এর প্রকাশিত সর্বশেষ পরিসংখ্যানে, বর্তমান বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্যটন কেন্দ্র ফ্রান্স। আর ফ্রান্সের সর্বোচ্চ জনপ্রিয় স্থাপনা এই আইফেল টাওয়ার।

১৮৮৯ সালে সর্বপ্রথম মেলার উদ্দেশ্যে নির্মাণ করা হয়েছিল এই টাওয়ারটি। কথিত আছে, আইফেল টাওয়ার নির্মাণ করতে সর্বমোট ২ কোটি ৫০ লাখ নাট ব্যবহার করা হয়েছিল। মূলত এই নাটগুলো আইফেল টাওয়ারের ১৮,০৩৮টি পৃথক ধাতবখণ্ডকে একত্রে সংযুক্ত করার কাজে ব্যবহৃত হয়েছিল। আর আইফেল টাওয়ারের এই নির্মাণ কাজে সর্বমোট ১৩২ জন দক্ষ কর্মীকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। তাদের অক্লান্ত পরিশ্রমেই মাত্র ২ বছর ২ মাস ২ দিনে নির্মাণ করা সম্ভব হয়েছিল এই টাওয়ারটি। যদিও পরবর্তীতে এই টাওয়ারটির বেশ কিছু সংস্কার করা হয়। এ সময়ে টাওয়ারটির নিচের অংশের আংশিক পরিবর্তনের জন্য প্রায় ৩০ মিলিয়ন ইউরো ব্যয় করা হয়েছিল। তাছাড়াও টাওয়ারটির চাকচিক্য ধরে রাখতে প্রতি ৭ বছর পর পর পুনরায় একবার করে রং করা হয় টাওয়ারটিকে। যা খুবই ব্যয়বহুল। বিশাল আকৃতির সুউচ্চ এই টাওয়ারটিতে সর্বমোট ১২০টি তরঙ্গায়িত এন্টেনার অস্তিত্ব রয়েছে। তাছাড়াও রাতের আঁধারে টাওয়ারটিকে আলোকসজ্জায় সজ্জিত করার জন্য এতে স্থাপন করা হয়েছে ৩৩৬টি প্রজেক্টর, সেই সঙ্গে টাওয়ারটির প্রতি পাশে ৫,০০০টি করে ব্যবহার করা হয়েছে মোট ২০,০০০ লাইট। ফ্রান্সের আইন অনুযায়ী রাতের আঁধারে আলোকসজ্জায় সৌন্দর্যমণ্ডিত অবস্থায় টাওয়ারটির ছবি ধারণ করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। লোহার তৈরি এই টাওয়ারটি পর্যটকদের পরিদর্শনের জন্য মূলত তিনটি স্তরে বিভক্ত। টাওয়ারটির একেবারে চূড়ায় আরোহণের জন্য প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্তর মিলিয়ে সর্বমোট ১৬৬৫টি সিঁড়ির ধাপ রয়েছে। তবে আপনার কাছে সিঁড়ি কষ্টসাধ্য ব্যাপার হলে বিকল্প পদ্ধতি হিসেবে লিফট ব্যবহার করতে পারেন। বেশিরভাগ দশনার্থী টাওয়ারটির চূড়ায় উঠার জন্য লিফটকেই বেশি প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। আমরাও তার ব্যতিক্রম নই। আইফেল টাওয়ারের চ’ড়া থেকে পাখির চোখে দেখা গেলো শিল্প ও সংস্কৃতির শহরকে।

No description available.

আইফেল টাওয়ারের নামকরণ করা হয়েছে মূলত গুস্তাভো আইফেল-এর নামানুসারে। গুস্তাভো আইফেল ছিলেন এই টাওয়ারটির নকশা প্রণয়নকারী। তাই তার নামানুসারেই রাখা হয়েছে এই টাওয়ারটির নাম। এর বাইরের তিনি আমেরিকার ‘স্ট্যাচু অব লিবার্টি’র নকশা করেছেন। দু‘টি দেশের আইকনিক দু‘টি স্থাপনা নির্মাণের আর্কিকেক্ট পৃথিবীতে আর দ্বিতীয় কেউ নেই। প্রকৃত আইফেল টাওয়ারটির উচ্চতা মূলত ৩০০ মিটার। তবে আইফেল টাওয়ারের ওপর ৪ মিটার উচ্চতা বিশিষ্ট একটি এন্টেনা রয়েছে। আর এই এন্টেনাসহ আইফেল টাওয়ারের মোট উচ্চতা ৩২৪ মিটার কিংবা ১০৬৩ ফুট। যাকে অনেকেই টাওয়ারটির প্রকৃত মোট উচ্চতা হিসেবে বিবেচনা করে থাকে। এক সময় এই টাওয়ারটি বিশ্বের সর্বোচ্চ স্থাপনা হিসেবে বিবেচিত ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে ১৯৩০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরে যখন ক্রিসলার ভবনটি নির্মাণ করা হয়, তখন আইফেল টাওয়ার সর্বোচ্চ পরিকাঠামোর মর্যাদা হারায়। ক্রিসলার ভবনটি নির্মিত হওয়ার আগ পর্যন্ত দীর্ঘ ৪১ বছর যাবৎ আইফেল টাওয়ারই ছিল পৃথিবীর একমাত্র সুউচ্চ পরিকাঠামো।

আইফেল টাওয়ারের সৌন্দর্য্য ও স্থাপত্য শৈলি আমাকে মুগ্ধ করলেও আমার মনে বার বার উঁকি দিচ্ছিলো ‘লাভ লক ব্রিজ’। নানা বয়সের মানুষ লাভ লক ব্রিজে তালা ঝুলিয়ে ভালোবাসা বন্দী করার যে ব্যাকুলতা আমি দেখেছি তা আমাকেও ছুঁয়ে গেছে। সেখানে অনেক বয়সের মানুষের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছি। বেশিরভাগ মানুষ ইংলিশ বোঝেনা। এস্তোনিয়া থেকে আসা এক তরুণ দম্পতির সঙ্গে কথা হয়। কিছুক্ষণ আগে তারা তালা ঝুলিয়ে ছবি তুলেছে। জানালাম নগর কর্তৃপক্ষ তো এই তালা অপসারন করে ফেলবে। তাহলে এখানে তালা লাগিয়ে কী লাভ? লোকটি হেসে বললেন, ‘এটা ভালোবাসা আর বিশ্বাসের বহিঃপ্রকাশ ছাড়া কিছুই নয়। আপনি এখানে এসে ভালোবাসার যে স্মৃতি গেঁথে গেলেন, সেটা নিশ্চয়ই ওরা অপসারণ করতে পারবেনা।’ ভালোবাসার বন্ধন কিংবা বিশ্বাস হয়তো এমনই। ভালোবাসা বন্দী করার এই ব্যাকুলতা হয়তো রয়ে যাবে শত-সহস্ত্র বছর। সৃষ্টির আদি থেকে যা চলে এসেছে। সেই বিশ্বাসের প্রতি সম্মানরেখেই বলতে হয়, ‘ভালোবাসার মৃত্যু নেই।’

লেখক: আসাদুজ্জামান সম্রাট, নগর সম্পাদক-দৈনিক আমাদের অর্থনীতি ও সম্পাদক-পার্লামেন্ট জার্নাল

 

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়