ড. মঞ্জুরে খোদা: আমার এক হিন্দু বন্ধু বলেছিলেন, আমরা সংখ্যালঘু নয়, আমরা এখনো সংখ্যাগুরু, দেশবিভাগ বা সীমানার ধারণনাই আমাদের সংখালঘুতে পরিণত করেছে। নেতারা দেশকে ভাগ করেছে আমাদের সম্মতি না নিয়ে, তাদের ক্ষমতার সমীকরণে। মাঝখানে আমরা ভুক্তভূগি। দেশের সীমানার সাথে মানুষের দেশপ্রেমেরও পরিবর্তন ঘটে। আমরা যখন ভারতের অংশ ছিলাম তখন তাকেই ভালোবাসা ছিল আমাদের দেশপ্রেম। আমরা যখন পাকিস্তান হলাম তখন পাকিস্তানের প্রতি ভালবাসাই ছিল আমাদের দেশপ্রেম, আমরা যখন বাংলাদেশ হলাম তখন এই দেশটির প্রতি ভালবাসাই আমাদের দেশপ্রেম। এভাবেই সময়ের ব্যবধানে ও প্রয়োজনে পরিবর্তন হয় মানুষের দেশপ্রেমবোধ ও তার সংজ্ঞা। ‘মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ শুধুমাত্র ইসলামের কথা বলে পাকিস্তান সৃষ্টি করেছিলেন। পাকিস্তানের কোনো রূপরেখা তাদের সামনে ছিল না। সমস্যা দেখা দিল পাকিস্তান সৃষ্টির পূর্বে। পাকিস্তান সৃষ্টি হলো মুসলমানদের স্বতন্ত্র বাসভূমির দাবীতে। বলা হলো- হিন্দু, মুসলমান দুই জাতি। তাদের সংস্কৃতি এবং কৃষ্টি আলাদা। তাদের একই সাথে বসবাস করা সম্ভব নয়। তাই এই দুই জাতির আলাদা দু’টি রাষ্ট্রের প্রয়োজন। কিন্তু পাকিস্তান প্রস্তাবে দুই রাষ্ট্রের হিন্দু ও মুসলমান জনগোষ্ঠী বিনিময়ের কোনো প্রস্তাব ছিল না। পাকিস্তান প্রস্তাব মতে, ভারত ভেঙে দু’টি রাষ্ট্র হলেও উভয় রাষ্ট্রে হিন্দু এবং মুসলমান উভয় জাতিই থাকবে। লোক বিনিময় হবে না।
পাকিস্তান প্রস্তাবের এটাই ছিল সবচেয়ে দূর্বল দিক। মুসলমানদের জন্যে স্বতন্ত্র রাষ্ট্র চাই। মুসলমানদের জন্যে ভারত ভেঙে পাকিস্তান করতে হবে। অথচ খন্ডিত ভারতবর্ষের ভারত অংশে ৬ কোটি মুসলমানকে হিন্দুদের সাথেই বসবাস করতে হবে। আবার হিন্দুদের সাথে এক সাথে বসবাস করা যাবে না, এই চুক্তিতে মুসলমানদের জন্যে স্বতন্ত্র রাষ্ট্র পাকিস্তান হলেও পূর্ববঙ্গে দেড় কোটি হিন্দু থেকে গেল। দেশ বিভাগের পূর্বে মুসলিম লীগ নেতা মোহাম্মাদ আলী জিন্নাহ’র কাছে এ প্রশ্নটি তুলেছিলেন ভারতীয় মুসলামনরা। এ কথার জবাব তিনি ভারতের মাটিতে দিলেন না। পাকিস্তান পৌঁছে জিন্নাহ বিমানবন্দরে বললেন, রাজনৈতিকভাবে কোনো মুসলামন এখন আর মুসলমান নয়, কোনো হিন্দু আর হিন্দু নয় কোনো হিন্দু নয়, সকলেই পাকিস্তানি। অর্থাৎ ভারতীয় মুসলামদের ভারতীয় নাগরিক হিসেবেই থাকতে হবে। পাকিস্তান প্রস্তাবকে তিনি জোড়াতালি দিয়ে বাঁচাতে চাইলেন। প্রকৃতপক্ষে এভাবে জোড়াতালি দিয়ে পাকিস্তান প্রস্তাবকে বারবার বাঁচিয়ে ভারতকে ভাগ করা হয়েছিল ১৯৪৭ সালে। ‘৪৭ সালে দেশ বিভাগের অবৈজ্ঞানিক ধারণা-রুপরেখা ছিল এই উপমহাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা। এই অঞ্চলের চলমান রাজনৈতিক সংঘাত-সহিংসতা ও বিশৃংখলার একটি বড় কারণ সেখানেই।’