অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন: এটা কাকতালীয় নয়, দৈব-নির্দেশিতই বলতে হবে যে, মুজিব শতবর্ষ আর স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর কাছাকাছি লাগোয়া সময়ে উদ্যাপিত হচ্ছে। ব্যাপারটি জাতি হিসেবে আমাদের বিরল সৌভাগ্য বলতে হবে। বাঙালি এমনিতে উৎসব-প্রবণ; দুটো উদ্যাপন উৎসব হলেও তা ইতিহাসের অংশ। মুজিব কুড়ি শতকের ইতিহাসে সবচেয়ে সাড়া জাগানো নেতা; বাংলাদেশের স্বাধীনতা কুড়ি শতকে সবচেয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করা ঘটনা। মুজিব ছিলেন ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের একটি ক্ষুদ্র ভূখন্ডের নেতা; কিন্তু তার প্রভাব/আবেদন ছিল বিশ্বময়। মুজিববর্ষে মুজিব হয়ে উঠেছেন সীমাহীন। তার স্বপ্নসাধের বাংলাদেশ যে সুবর্ণজয়ন্তী পালন করছে তা-ও এক বিমুগ্ধ বিস্ময়। জন্মলগ্নেই দেশটি ছিল বিস্ময়; বৈরীদের জন্য বিপন্ন, আর বন্ধুদের জন্য বিমুগ্ধ। বঙ্গবন্ধু মানে স্বাধীনতা, স্বাধীনতা মানে বঙ্গবন্ধু। জন্মলগ্ন আর পঞ্চাশ বছরের বাংলাদেশ- সময়োত্তীর্ণ পোড় খাওয়া দেশ নিয়েই কী সুকান্তের পঙক্তি ছিল? সাবাস বাংলাদেশ/অবাক পৃথিবী তাকিয়ে রয়/জ্বলে পুড়ে মরে ছারখার/তবুও মাথা নোয়াবার নয়।
বঙ্গবন্ধু কোনোদিন তার জন্মদিন পালন করেননি; কিন্তু আমরা করি আমাদের দায়বোধ থেকে, সারা বিশ্বে আালোড়ন তুলে তার শততম জন্মদিনও পালন করছি, করতে বাধ্য। কারণ এ মানুষটির স্বপ্নের ফসল স্বাধীন বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু অন্নদাশংকর রায়কে বলেছিলেন, ১৯৪৭ থেকে তিনি স্বাধীনতা-স্বপ্নের বীজ বুনতে শুরু করেছিলেন। এমন মন্তব্যের সপক্ষে তথ্য আছে। কারণ পাকিস্তান হবার পর তিনি বেকার হোস্টেলের ২৪ নং ঘরে সাথীদের বলেছিলেন, এ পাকিস্তান বাঙালির স্বার্থ রক্ষা করবে না, ঢাকায় ফিরে আন্দোলন শুরু করতে হবে। আরও বললেন, ‘ওই মাউরাদের সাথে বেশিদিন থাকা যাবে না।’ ‘ওই মাউরাদের’ সাথে আমরা ছিলাম ২৪ বছর ৪ মাস ৩ দিন। ততোদিনে স্বাধীনতা-স্বপ্নের বীজ থেকে যে অঙ্কুরোদ্গম হয়েছিল তার-ই ফসল বাংলাদেশ।
১৯৬১-তে শেখ মুজিব ছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। দলটি বাঙালি স্বার্থের প্রতিনিধি। তাতে কী? বাঙালির মুক্তিপাগল শেখ মুজিব নিজে নিজেই তৈরি করলেন ‘পূর্ববঙ্গ মুক্তিফ্রন্ট’। লিফলেট ছাপলেন নিজ খরচে। সারা ঢাকা শহরময় এ লিফলেট বিলি করলেন সাইকেলে চড়ে। ফল কিছু হয়নি। তাতে কিছু যায় আসে না। বাঙালির মুক্তিপাগল এ মানুষটির কর্মকান্ডই ছিল এমন। ১৯৬৬- তে তিনি হাজির করলেন ছয় দফা- বাঙালির মুক্তিসনদ। এ ছয়দফা বাঙালিকে মুক্তির স্বপ্নে বিভোর করলো। ছয়দফার নেতা শেখ মুজিব হয়ে উঠলেন বাঙালির নেতা। সিরাজুল আলম খান এ সময়ে একদিন বললেন, ‘শেখ মুজিবের নেতৃত্বেই দেশ স্বাধীন করতে হবে। কারণ লোকে তার কথা শোনে।’ পরবর্তী ইতিহাস তাই বলেছে; শেখ মুজিবের নেতৃত্বেই দেশ স্বাধীন হয়েছে।
শেখ মুজিবের ছয়দফার পাকিস্তানি উত্তর ছিল আগরতলা মামলা। শেখ মুজিবসহ ৩৫ জন অভিযুক্ত ও কারারুদ্ধ। অভিযোগ রাষ্ট্রদ্রোহ। তরুণ প্রজন্মের রাজপথ কাঁপানো ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের শ্লোগান ছিল, ‘জেলের তালা ভাঙবো, শেখ মুজিবকে আনবো।’ ’৬৯-এর ২২ ফেব্রুয়ারি মুক্ত শেখ মুজিব ফিরেছিলেন; পরদিন ২৩ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিব হলেন বঙ্গবন্ধু। সেই থেকে তিনি বঙ্গবন্ধু।
বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ’৭০-এর নির্বাচনে বাঙালি অংশগ্রহণ করে। নির্বাচনের আগে পাকিস্তানের সামরিক জান্তা প্রধান ইয়াহিয়ার আইনি কাঠামো আদেশ বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো মনে হলো। ২৫ ও ২৭ ধারা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন অনুযায়ী ভবিষ্যতের সংবিধানে বাঙালির ন্যায্য হিস্যা নিশ্চিত করার পথ রুদ্ধ করে দিয়েছিলেন। কাজেই আওয়ামী লীগের মধ্যে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর অমোঘ উচ্চারণ ছিল, ‘আমার লক্ষ্য বাংলাদেশের স্বাধীনতা। নির্বাচন হয়ে যাবার পর আমি এল.এফ. ও. টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলবো।’ বঙ্গবন্ধুর কথাগুলো গোয়েন্দারা গোপনে রেকর্ড করে ইয়াহিয়াকে শোনালে তার প্রতিক্রিয়া ছিল, ‘I will fix Sheikh Mujib.’ পরবর্তী ইতিহাস বলে ইয়াহিয়া বঙ্গবন্ধুকে fix করতে পারেননি; বঙ্গবন্ধুই ইয়াহিয়াকে fix করেছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ইয়াহিয়ার গালে সজোরে চপেটাঘাত ছিল।
’৭০-এর নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের গরিষ্ঠ দল; ৩০০ টির মধ্যে ১৬৭ টি আসন তার দখলে। কিন্তু ইয়াহিয়া-ভুট্টো-সামরিক বাহিনি ত্রয়ীর যোগসাজশে আওয়ামী লীগের জন্য ক্ষমতা মায়ামৃগ হয়ে রইলো। কাজেই বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালির অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়; যার একটি পর্যায়ে ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু দিলেন তার কালজয়ী ভাষণ। বঙ্গমাতাকে দেয়া কথা অনুযায়ী স্বাধীনতার কথা বলা হলো ঘুরপথে, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ বাঙালি পেয়েছিল স্বাধীনতার কাক্সিক্ষত বার্তা; পাকিস্তানিরাও বুঝেছিল বাক্যটির নিহিতার্থ। ৮ মার্চ গোয়েন্দা প্রতিবেদনে লেখা হলো, ‘চতুর শেখ মুজিব কৌশলে স্বাধীনতা ঘোষণা করলো, আমরা চেয়ে চেয়ে দেখলাম।’ ৭ মার্চে সঙ্গত কারণে বঙ্গবন্ধু বাক্কুশলী হয়েছিলেন; কিন্তু ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে তিনি আক্রান্ত হয়ে সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন, ‘সম্ভবত এটাই আমার শেষ বার্তা। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন।’
’৭২-এর ১৮ জানুয়ারি প্রচারিত ডেভিড ফ্রস্ট সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, পাকিস্তানিরা আগে আক্রমণ করুক, পরে বাঙালিরা প্রতিরোধ করবে; আগে আক্রমণ করে তিনি বিচ্ছিন্নতাবাদী হতে চাননি। মনে হয়, গরম মাথার ইয়াহিয়ার সামরিক জান্তা ঠান্ডা মাথা ও বিচক্ষণ বঙ্গবন্ধুর পাতা ফাঁদে পা দিয়ে ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামের গণহত্যা শুরু করেছিল। ৭ মার্চের ভাষণ ছিল বিন্দুতে সিন্ধু। এ ভাষণ দিয়ে বঙ্গবন্ধু সাপ মেরেছিলেন, কিন্তু লাঠি ভাঙেননি। রাজনীতির কবি সেদিন স্বাধীনতা নামের মহাকাব্য লিখতে শুরু করেছিলেন। আর সেদিন থেকেই স্বাধীনতা নামের শব্দটি আমাদের হলো।
’৭২-এর ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘আজ আমার জীবনের সাধ পূর্ণ হয়েছে। বাংলাদেশ স্বাধীন।’ তিনি গুনগুন করে যে গানটি গাইতেন তা ছিল, ‘মা, আমার সাধ না মিটিল, আশা পুরিলো।’ স্বাধীন বাংলাদেশ তার সাধ মিটিয়েছিল; কিন্তু সোনার বাংলা গড়ার আশা অপূর্ণ থেকে গেলো। অবশ্য বঙ্গবন্ধু - কন্যার নেতৃত্বে সে আশা পূরণের কাজ চলছে। এগিয়েছি অনেক; কিন্তু যেতে হবে আরও বহু দূর। বঙ্গবন্ধু তো পথ দেখিয়েছেন; দেখানো পথ পরিক্রমা করতে হবে। কাজেই এমন নেতার জন্মশতবার্ষিকী তো আমরা পালন করতে বাধ্য এবং তা করছি।
এবার আসা যাক বাংলাদেশের ৫০ বছরের কথায়। স্বাধীনতা প্রাপ্তি থেকে আজ পর্যন্ত ৫০ বছর হয়; কিন্তু হিসেবে শুভঙ্করের ফাঁক আছে। ’৭৫ থেকে ’৯০ ছিল অবৈধ সামরিক শাসন, ’৯১ থেকে ’৯৬ সাম্প্রদায়িক শক্তির শাসন; আর ২০০১ থেকে ২০০৬ ছিল স্বাধীনতাবিরোধী বিএনপি-জামায়াত শাসন। এ বছরগুলো ছিল নষ্ট সময়। ’৭২-’৭৫, ’৯৬-২০০১; এবং ২০০৮ থেকে আজ পর্যন্ত দেশ গড়ার সময়। জন্মলগ্নে বাংলাদেশ নিয়ে ড. কিসিঞ্জারের অভিসস্পাত ছিল তলাবিহীন ঝুড়ি হওয়ার। উন্নয়নবিদ জাস্ট ফায়ায়াল্যান্ড ও জে. আর. পার্কিনসন বলেছিলেন তিনটি নেতিবাচক কথা। এক. বাংলাদেশ উন্নয়নের কঠিনতম সমস্যা। দুই. বাংলাদেশে উন্নয়ন হলে পৃথিবীর সব দেশেই উন্নয়ন হবে। তিন. বাংলাদেশে উন্নয়ন হলে অন্তত দুশ বছর লাগবে।
বঙ্গবন্ধুর যাত্রা শুরু হয়েছিল শূন্য থেকে এবং মাটি আর মানুষ নিয়ে। তার সময় ছিল মাত্র ১,৩১৪ দিন। তা-ও আবার ’৭৫-এর ২৫ জানুয়ারি তাকে পথ পাল্টাতে হয়েছিল পরিস্থিতির অনিবার্যতায় এবং সম্পূর্ণ সাময়িকভাবে। বঙ্গবন্ধু হত্যা পর্যন্ত প্রস্তুতি পর্বের বাকশাল ছিল ২৩৩ দিনের। এ সময়ে বাংলাদেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসতে শুরু করেছিল; এমনকি সিআইএ-র দলিলেও তার স্বীকৃতি আছে। বঙ্গবন্ধুর আমলে গড় প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৭.৪ শতাংশ। অর্থাৎ ঝুড়ির তলা লেগেছিল; আর ঝুড়িতে সি ত হয়েছিল অনেক কিছু। সুতরাং বাস্তবতার নিরিখে বলতে হয়, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয় এ কারণে যেন বাংলাদেশ যেন ঘুরে দাঁড়াতে না পারে।
বর্তমান সরকারের আমলে বাংলাদেশ অপ্রতিরোধ্য প্রগতির পথে। অগ্রগতির নানা কথা আছে; দুটোর কথা বলি। এক, ২০১৬-তে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশকে উন্নয়নের রোল মডেল তকমা দিয়েছে। সারা বিশ্বের উন্নয়নবিদগণ এখন বাংলাদেশ নিয়ে ইতিবাচক কথা বলেন। সর্বসাম্প্রতিক অর্জন স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের পর্যায়ে উন্নীত হওয়ার স্বীকৃতি, যা বর্তমান সরকারের আমলে এক বিরাট অর্জন। দুই. পদ্মা সেতু। বিশ্বব্যাংক টাকা ছাড় না করেই দুর্নীতির অভিযোগ এনে অর্থায়ন বন্ধ করে দিল। আর আমরা প্রধানমন্ত্রির সাহসী সিদ্ধান্তে জনগণের টাকায় এ সেতু করে ফেললাম। বাংলাদেশ এখন তৃতীয় বিশ্বের রোল মডেল।
৫০ বছরের বাংলাদেশ এগিয়েছে অনেক; যেতে হবে এখনও বহু দূর। আমাদের গন্তব্য, সোনার বাংলা। সোনার বাংলার পথ পরিক্রমা করতে হলে যে চ্যালেঞ্জ আছে সেগুলো হলো, বঙ্গবন্ধুর আদর্শিক প্রেরণায় থিতু থাকা, শাসনের গুণমান বাড়ানো, বৈষম্যের বৃদ্ধি রোধ করা, অস্থির উত্তাল সমাজকে সামাল দেওয়া, শিক্ষার অবস্থা ফেরানো; সর্বোপরী দুর্নীতি ঠেকিয়ে দেওয়া। চ্যালেঞ্জ আরও অনেক আছে, তবে এগুলো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে মোকাবেলা করতে হবে। বাংলাদেশ এগিয়েছে অনেক; কিন্তু এখনও যেতে হবে বহু দূর।
সংস্কৃত প্রবচন আছে: রত্ন কর্ষতি পুর: পরমেক/স্তদগতানুগতিকো ন মহার্ঘ্য- অর্থাৎ একজনই আগে পথ তৈরি দেন। পরে সে পথ দিয়ে যাতায়াত করার লোক দুর্লভ হয় না। বঙ্গবন্ধু আমাদের স্বাধীনতার পথ দেখানো এমন নেতা ছিলেন, যিনি জন ম্যাক্সওয়েলের ভাষায়, পথ চেনেন, সে পথ পরিক্রমা করেন, এবং পথ দেখান। আমরা কী বঙ্গবন্ধুর পথে এগোচ্ছি? লেখক : বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনাল্স (বিইউপি)