বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন।। বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলার ভালুকায় হিন্দু ধর্মাবলম্বী একজন পোশাক শ্রমিককে ধর্ম নিয়ে কটূক্তির অভিযোগ তুলে দলবদ্ধ হয়ে পিটিয়ে ও পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে। তবে এ ঘটনায় 'ধর্ম অবমাননার' কোনো প্রত্যক্ষ প্রমাণ পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন বা র্যাব।
"নিহত ব্যক্তি যদি ফেসবুকে কিছু লিখতেন তাহলেও একটা বিষয় হতো। সেখানে সবাই এখন বলছেন তারা তাকে (নিহত শ্রমিক) এমন কিছু বলতে নিজেরা শোনেননি। কেউ নিজে শুনেছেন বা দেখেছেন (ধর্ম অবমাননার বিষয়ে) এমন কাউকে পাওয়া যায়নি," বিবিসি বাংলাকে বলেছেন ময়মনসিংহ র্যাবের কোম্পানি কমান্ডার মো. সামসুজ্জামান।
তিনি জানিয়েছেন, "পরিস্থিতি যখন টালমাটাল হয়ে ওঠে তখন ফ্যাক্টরি রক্ষায় তাকে বাইরে ঠেলে দেওয়া হয়েছে"।
বাইরে ঠেলে দেওয়ার পর তাকে পিটিয়ে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনার ভিডিও বিশ্লেষণ করে দুই জনকে আটক করে তাদের জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে আরও পাঁচ জনকে আটক করা হয়েছে বলে জানিয়েছে র্যাব।
ভালুকা মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, এ ঘটনায় থানায় মামলা হয়েছে এবং তারাও ঘটনায় সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে তিন জনকে আটক করেছেন।
এদিকে নিহত পোশাক শ্রমিককে পুলিশের কাছ থেকে নিয়ে 'মব সন্ত্রাসীরা' পিটিয়ে আগুন দিয়ে মেরেছে বলে সামাজিক মাধ্যমে যে প্রচার চলছে তা সম্পূর্ণ 'ভুয়া' বলছেন মি. ইসলাম।
"আমাদের জানানোই হয়েছে অনেক পরে। তাকে সরাসরি ফ্যাক্টরি থেকেই তুলে নিয়ে হত্যা করা হয়েছে," বলেছেন তিনি।
নিহত ব্যক্তির চাচাতো ভাই কার্তিক চন্দ্র দাস বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, "ঘটনায় কারা জড়িত তা ভিডিওতে আছে। এলাকার মানুষ জানে আমার ভাই কেমন। তাকে মিথ্যা অভিযোগ করে খুন করা হয়েছে"।
তবে যেই কারখানা ঘটনাটি ঘটেছে সেখানকার কেউ এ বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি।
শুক্রবার অন্তর্বর্তী সরকারের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, "ময়মনসিংহে এক হিন্দু ব্যক্তিকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় আমরা গভীরভাবে নিন্দা জানাই। নতুন বাংলাদেশে এ ধরনের সহিংসতার কোনো স্থান নেই। এই নৃশংস অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না"।
কী ঘটেছিলো ভালুকায়
র্যাব বলছে, ডুবুলিয়া পাইওনিয়ার নিট ফ্যাক্টরিতে শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন জেলার তারাকান্দা থানার দিপু চন্দ্র দাস, যার বয়সী ২৮ বছরের কাছাকাছি। তাকে বৃহস্পতিবার রাতে জোর করে তার ফ্যাক্টরি থেকে বের করে এনে হত্যা করা হয়েছে।
"অজ্ঞাতনামা উত্তেজিত জনতা ভিকটিমের বিরুদ্ধে নবী ও ধর্ম নিয়ে কটূক্তির অভিযোগ এনে গত বৃহস্পতিবার রাত আনুমানিক নয়টায় ফ্যাক্টরি থেকে জোরপূর্বক বের করে দাঙ্গা সৃষ্টির মাধ্যমে দেশীয় অস্ত্র দিয়ে আঘাতসহ কিলঘুষি দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে," র্যাবের এক প্রেস ব্রিফিং দেওয়া বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে।
"পরবর্তীতে ভিকটিমের মৃতদেহ জামিরদিয়া স্কয়ার মাস্টারবাড়ি বাসস্ট্যান্ডে ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কের মাঝখানে আইল্যান্ডের গাছের সাথে ঝুলিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়," এ তথ্য দিয়ে র্যাবের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ঘটনার ভিডিও বিশ্লেষণ ও অন্য তথ্য সংগ্রহ করে সাত জনকে আটকের কথা বলা হয়েছে।
র্যাবের কোম্পানি কমান্ডার মো. সামসুজ্জামান বলছেন, "পরিস্থিতি টালমাটাল হয়ে গেলে ফ্যাক্টরি রক্ষার জন্য সেখানকার কর্মকর্তারা ভিকটিমকে কথিত জনতার হাতে তুলে দিয়েছে। এমনকি বিকেল পাঁচটার ঘটনা রাত আটটায় পুলিশকে বলা হয়েছে"।
"কিন্তু যাদেরকেই জিজ্ঞাসা করছি তারা বলছেন তারা ওই ব্যক্তি (দিপু চন্দ্র দাস) কটূক্তিমূলক মন্তব্য করেছে শুনেছেন, কিন্তু নিজেরা সরাসরি শুনেননি বা দেখেননি," বলেছেন মি. সামসুজ্জামান।
র্যাব, পুলিশ ও স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মীদের কাছ থেকে যে ভাষ্য পাওয়া যাচ্ছে তা হলো, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর ফ্যাক্টরির ভেতরেই কিছু শ্রমিক দলবদ্ধ হয়ে দিপু চন্দ্র দাসকে মারধর শুরু করেন।
এ সময় তারা তার বিরুদ্ধে 'নবীকে কটূক্তি করার' অভিযোগ করতে থাকেন। তখন মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে যে 'দিপু চন্দ্র দাস চায়ের দোকানে বসে এমন মন্তব্য করেছেন'।
এক পর্যায়ে বাইরে খবর ছড়িয়ে পড়লে ফ্যাক্টরির বাইরেও অনেকে জমায়েত হয়ে দিপুকে তাদের হাতে তুলে দেওয়ার দাবি জানাতে থাকেন। আবার ওই সময় ওই এলাকার কারখানাগুলোর ছুটির সময় হওয়ায় অল্প সময়ের মধ্যে বহু মানুষ জড়ো হয় সেখানে।
পরিস্থিতি সামাল দিতে গিয়ে ফ্যাক্টরির প্রডাকশন ম্যানেজার দিপু চন্দ্র দাসকে তখনি বরখাস্ত করেন।
"পরিস্থিতি যখন টালমাটাল হয়ে ওঠে তখন ফ্যাক্টরি রক্ষার জন্য ভিকটিমকে বাইরের দিকে ঠেলে দেয় ফ্যাক্টরির লোকজন," বলছিলেন র্যাবের মো. সামসুজ্জামান।
যদিও কেউ কেউ বলছেন, মি. দাসকে যখন ভেতরে মারধর করা হচ্ছিলো, তারই এক পর্যায়ে একটি পকেট গেট দিয়ে বাইরে থেকে লোকজন ভেতরে প্রবেশ করে তাকে বাইরে নিয়ে যায়।
"বাইরে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে নিয়ে মারধর করে গাছে ঝুলিয়ে তারপর আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। এক পর্যায়ে আগুনে রশি ছিঁড়ে দিপু দাসের দেহ পড়ে যায়। পরে পুলিশ ও সেনাবাহিনী গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেয়," বিবিসি বাংলাকে ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেছেন স্থানীয় একজন সাংবাদিক।
এ ঘটনার যে ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে তাতেও এসব দৃশ্য দেখা গেছে। যদিও পরে আবার সামাজিক মাধ্যমে কেউ কেউ অভিযোগ করেন যে দিপু আক্রান্ত হয়ে পুলিশের কাছে গিয়েছিলেন।
এ অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে ভালুকা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম বলছেন, ঘটনাটি ঘটেছে ফ্যাক্টরিতে এবং "পুলিশকে খবরই দেওয়া হয়েছে অনেক দেরি করে"।
র্যাবের মো. সামসুজ্জামানও বলছেন যে, বিকেল পাঁচটায় ঘটনা শুরু হলেও পুলিশকে কল দেওয়া হয়েছে রাত আটটায়।
নিহত দিপু চন্দ্র দাসের চাচাতো ভাই কার্তিক চন্দ্র দাস বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, "ফ্যাক্টরির ভেতরে অনেক ঘটনা ঘটেছে" এবং সে কারণেই তার ভাইকে হত্যা করা হয়েছে বলে মনে করছেন তারা।
তবে কী কী ঘটেছে ফ্যাক্টরিতে- সে ব্যাপারে তিনি বলতে চাননি।
"ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে কারা কী করেছে। আমরা শুধু বিচার চাই। মিথ্যা অভিযোগ তুলে এভাবে মারা হলো কেন তার বিচার চাই," বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
নিহত দিপু চন্দ্র দাস দেড় বছর বয়সী এক কন্যা সন্তানের জনক। তবে কাজের জন্য পরিবার ছাড়াই তিনি ফ্যাক্টরি এলাকায় একটি মেসে থাকতেন বলে তার চাচাতো ভাই জানিয়েছেন।