বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, চীনের পর বাংলাদেশ বিশ্বে দ্বিতীয় বৃহত্তম তৈরি পোশাক রফতানিকারক দেশ। আর তৃতীয় বৃহত্তম পোশাকের বাজার রাশিয়া। আনুমানিক ২৩-৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের তৈরি পোশাকের বাজার রয়েছে দেশটিতে যার বার্ষিক প্রবৃদ্ধি প্রায় ২০ থেকে ৩০ শতাংশ। রাশিয়ার মাধ্যমে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত ১১ দেশের জোট কমনওয়লেথ অব ইনডিপেনডেন্ট স্টেটসের বাজারে প্রবেশের সুযোগ রয়েছে বাংলাদেশের। প্রায় ১৫ হাজার কোটি ডলারের রফতানি বাজার রয়েছে এই সিআইএস জোটে। সুযোগ রয়েছে আরমেনিয়া, বেলারুশ, কাজাখস্তান, কিরঘিজস্তানকে নিয়ে রাশিয়ান নেতৃত্বাধীন ইউরেশিয়ান কাস্টমস ইউনিয়নেও রফতানি সম্প্রসারণের। সেই সুযোগটিই এবার নিতে যাচ্ছে বাংলাদেশ।
এর আগেও দেশটির সঙ্গে ব্যাংকিং সম্পর্ক স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয় একাধিকবার। ২০১৬ সালে এশিয়া-ইউরোপ মিটিং (আসেম) সম্মেলনে যোগ দিতে মঙ্গোলিয়া সফর করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই সময় দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক নিয়ে রাশিয়ার প্রধামন্ত্রীর মেভেদেভের সঙ্গে একটি সাইডলাইন বৈঠক করেন তিনি। ওই বৈঠকে দুই দেশের সরকারপ্রধান বাংলাদেশ ও রাশিয়ার মধ্যে সরাসরি ব্যাংকিং সম্পর্ক স্থাপনের যৌথ সিদ্ধান্ত নেন। তবে সেই সময় দুই রাষ্ট্রনেতার এই সিদ্ধান্ত আটকে যায় বাংলাদেশ ব্যাংকের মতামতে। সংশ্লিষ্টরা জানান, বাংলাদেশ ব্যাংক এ বিষয়ে সেই সময় অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো এক মতামতে জানায়, ‘রাশিয়ার সঙ্গে করেসপন্ডিং ব্যাংকিং সম্পর্ক স্থাপনের বিষয়ে সরকারের তৎপরতার সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংক সম্পূর্ণ একমত পোষণ করে। তবে রাশিয়ার প্রথম সারির ব্যাংকগুলোর ওপর ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন (ইইউ) ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অফিস অব ফরেন এ্যাসেটস কন্ট্রোল কর্তৃক আরোপিত নিষেধাজ্ঞার কারণে ওই ব্যাংকগুলোর সঙ্গে করেসপন্ডিং ব্যাংকিং সম্পর্ক স্থাপন করা যাচ্ছে না।’
জানা যায়, ২০১৫ সালে ইউক্রেনের ক্রিমিয়া দখল করার পর যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের অবরোধের মুখে রাশিয়া বাংলাদেশ থেকে মাছ, সবজি, আলু আমদানিতে আগ্রহ দেখায়। দেশটির বাজারে বাংলাদেশের নিটওয়্যার, ওষুধ, চিংড়ি, চামড়াজাত পণ্যেরও বিপুল চাহিদা রয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ রাশিয়ার সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বাড়াতে নানা উদ্যোগ নেয়। এরই অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে স্বাক্ষরিত টিকফা চুক্তির মতোই রাশিয়ার সঙ্গে একটি চুক্তি সই করেছে বাংলাদেশ। এছাড়াও রাশিয়ার নেতৃত্বাধীন ইউরেশীয় ইকোনমিক কমিশনের সঙ্গেও দুই বছর আগে চুক্তি সই করেছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড এ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) সঙ্গে রাশিয়ার মান নিয়ন্ত্রণ সংস্থা দ্য ফেডারেল এজেন্সি অন টেকনিক্যাল রেগুলেটিং এ্যান্ড মেট্রোলজির মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরের প্রস্তুতিও চলছে। কিন্তু রাশিয়ার বিভিন্ন ব্যাংক ও প্রতিষ্ঠানের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা থাকায় দেশটির ব্যাংকগুলোর সঙ্গে সরাসরি করেসপন্ডিং ব্যাংকিং সুবিধা চালু করতে পারছে না বাংলাদেশ। কারণ, বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর নস্ট্রো এ্যাকাউন্ট যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকগুলোতে। তাই যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার মুখে থাকা রাশিয়ার ব্যাংকগুলোর সঙ্গে লেনদেন করলে বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোও যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক অবশ্য জানিয়েছে, করেসপন্ডিং ব্যাংকিং হিসাব খোলা সম্ভব না হলেও বাংলাদেশ ও রাশিয়ার মধ্যে বাণিজ্য কার্যক্রম অব্যাহত রাখার স্বার্থে সুইফটের ‘রিলেশনশিপ ম্যানেজমেন্ট এ্যাপ্লিকেশন’ (আরএমএ) সেবার মাধ্যমে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবসায়িক কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারে। বর্তমানে রাশিয়ান কমনওয়েলথভুক্ত ৯টি দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর প্রায় ৫০টি আরএমএ রয়েছে। এ ছাড়া রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক আরও সম্প্রসারণের লক্ষ্যে দেশের অথরাইজড ডিলার (এডি) ব্যাংকগুলোকে রাশিয়ার ব্যাংকগুলোর আরও বেশিসংখ্যক আরএমএ স্থাপনের পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
জানা গেছে, উভয় দেশের মধ্যে যে দেশ রফতানির তুলনায় আমদানি বেশি করবে, অর্থাৎ বাণিজ্য ঘাটতিতে থাকবে, সেই দেশের আমদানিমূল্য থেকে রফতানিমূল্য বাদ দেয়ার পর অবশিষ্ট পাওনা সুদসহ তিন মাস অন্তর তৃতীয় কোন বৈদেশিক মুদ্রায় পরিশোধ করবে সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ২০১৯-২০ অর্থবছরে রাশিয়ায় বাংলাদেশের রফতানি ছিল ৪৮৭ মিলিয়ন ডলারের। একই সময়ে রাশিয়া থেকে আমদানির পরিমাণ ছিল ৭৮২ মিলিয়ন ডলার। বর্তমানে রাশিয়ায় ব্যবসা করা গ্লোবাল ব্রান্ডগুলো হংকং ও সিঙ্গাপুর অফিস থেকে বাংলাদেশের আমদানি মূল্য পরিশোধ করছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জানায়, তৈরি পোশাক, টেক্সটাইল ও চামড়া ছাড়াও কৃষি পণ্যের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে রাশিয়াতে। কিন্তু বাণিজ্যিক সম্পর্ক না থাকায় বাংলাদেশের পণ্য ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত (ইইউ) দেশগুলোর মাধ্যমে রাশিয়ায় যায়। ইউরোপের কোম্পানিগুলো ক্রেডিট সেলের মাধ্যমে দেশটিতে বাংলাদেশের পণ্য সরবরাহ করে। এর ফলে দামও বেশি পড়ে। উপরন্তু দ্বৈতকরের মুখে পড়তে হয় বাংলাদেশী পণ্যের। বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স এ্যান্ড এক্সপোর্টার্স এ্যাসোসিয়েশনের সিনিয়র সহ-সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘আমরা চাই, যত দ্রুত সম্ভব রাশিয়ার সঙ্গে সোয়াপ স্বাক্ষর হোক। রাশিয়ায় আমাদের রফতানি সম্ভাবনা ইউরোপের অনেক দেশের চেয়ে বেশি। তিনি বলেন, রাশিয়ানদের ক্রয় ক্ষমতাও ইউরোপের অনেক দেশের তুলনায় বেশি। সোয়াপ স্বাক্ষর হলে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ এই বাজারে কয়েক বছরের মধ্যেই বাংলাদেশের রফতানি কয়েকগুণ বাড়ানো সম্ভব হবে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের একটি দল সম্প্রতি রাশিয়া সফর করে এসে প্রস্তাবিত সোয়াপ চুক্তির খসড়া তৈরি করেছে। সেটি নিয়ে বাণিজ্য সচিব মোঃ জাফরউদ্দিনের সভাপতিত্বে গত সপ্তাহে একটি বৈঠকও হয়েছে। বৈঠকে বৈশ্বিক রাজনীতিতে সম্ভাব্য এ চুক্তির প্রভাব গভীরভাবে পর্যালোচনা করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। আর সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে এটিই হতে যাচ্ছে কোন দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রথম সোয়াপ চুক্তি। মূলত সোয়াপ হচ্ছে এক ধরনের বিনিময় পদ্ধতি। বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রানীতি বিভাগের এক উর্ধতন কর্মকর্তা বলেন, সোয়াপ চালু হলে বাংলাদেশের কোন রফতানিকারক রাশিয়ায় পণ্য রফতানি করলে তার রফতানি মূল্য বাংলাদেশ ব্যাংক টাকায় পরিশোধ করবে। ওই পরিমাণ অর্থ বাংলাদেশ ব্যাংক রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে পাওনা থাকবে। একইভাবে রাশিয়া থেকে বাংলাদেশ কোন পণ্য আমদানি করলে রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্থানীয় মুদ্রায় নিজ দেশের রফতানিকারককে পরিশোধ করবে। তিন মাস পরপর দুই দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক পাওনার হিসাব করে সমন্বয় করবে। বর্তমানে বিনিময় হার অনুযায়ী এক রুবল সমান এক টাকা ১৪ পয়সা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাণিজ্য সচিব ড. মোঃ জাফরউদ্দিন বলেন, বৈঠকের উদ্দেশ্য ছিল এক্ষেত্রে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করা। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিনিধিসহ ব্যবসায়ীরা বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। আমরা প্রাথমিকভাবে আলোচনা করে প্রাথমিক সমস্যাগুলো জানার চেষ্টা করেছি, আবার বসতে হবে। আগামীতে আমরা উন্নয়নশীল দেশে রূপান্তরিত হব। এজন্য আমাদের রফতানি বাড়াতে হবে। তাই রাশিয়ার সঙ্গে ব্যাংকিং ব্যবস্থাটা যেন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না করে, এ বিষয়েই আমরা উদ্যোগ নিয়েছি। সচিব আরও বলেন, রাশিয়া যেহেতু ইউরেশিয়ান কাস্টমস ইউনিয়নের নেতৃস্থানীয় সদস্য, সেহেতু বাংলাদেশ রাশিয়ার সঙ্গে ব্যাংকিং লেনদেন স্থাপন করতে পারলে ওই কাস্টমস ইউনিয়নের সদস্য দেশগুলোর সঙ্গে সরাসরি বাণিজ্য পরিচালনার সুযোগ তৈরি হবে।
ওই বৈঠকে উপস্থিত বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উর্ধতন এক কর্মকর্তা বলেন, তবে তাড়াহুড়ো করে কিছু হচ্ছে না। এক্ষেত্রে আর্থিক, বৈশ্বিক রাজনীতি ও কূটনৈতিক ইস্যু জড়িত। এ ধরনের কার্যক্রমে আমাদের আগের কোন অভিজ্ঞতা নেই। এখান থেকে ভাল অবস্থানে যাওয়ার জন্যই এমন উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ভাল কিছু করতে গিয়ে যেন নতুন করে কোন চ্যালেঞ্জে না পড়ে যাই। এটা করতে গিয়ে যেন বৈশ্বিক রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ঝামেলার সৃষ্টি না হয়, সেগুলো মাথায় রেখেই এ কাজটা করতে হবে। আমাদের রফতানি বাড়ানোর জন্য এ ধরনের উদ্যোগ নিতে হবে। -জনকণ্ঠ