আমীন আল রশীদ : দ্বিতীয় ধাপে গত ১৬ জানুয়ারি দেশের যে ৬০টি পৌরসভায় নির্বাচন হয়, তাতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ৪৬ জন এবং বিএনপির মাত্র ৪ জন মেয়র প্রার্থী জয়ী হয়েছেন। গত তিনটি জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির জয়-পরাজয়ের যে পরিসংখ্যান, তাতে পৌরসভায় ৪৬ জনের বিপরীতে বিএনপির ৪ জনের জয়ী হওয়াটা মোটেও অস্বাভাবিক নয়। দেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী এবং বিকল্প হিসেবে মানুষ এখনও বিএনপিকেই ভাবে। অন্য কোনও দল, যেমন জাতীয় পার্টি সেই বিকল্প হতে পারেনি। কোনো ইসলামিক বা বামপন্থী দলও আওয়ামী লীগের বিকল্প হয়ে ওঠেনি। সুতরাং, বিএনপি যদি আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হয়, সেক্ষেত্রে জাতীয় নির্বাচনে তিনশ’ আসনের বিপরীতে মাত্র ৯টিতে জয়ী হওয়া যেমন অস্বাভাবিক, তেমনি পৌরসভা নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের ৪৬ জনের বিপরীতে মাত্র ৪ জনের জয়ী হওয়াটাকেও অস্বাভাবিক মনে হতে পারে। জাতীয় সংসদ এবং স্থানীয় নির্বাচনের মধ্যে প্রধান পার্থক্য হলো, জাতীয় নির্বাচনের জয়-পরাজয়ে রাষ্ট্রক্ষমতার পালাবদল ঘটে। কিন্তু স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সরকারের পতন হয় না। বরং ভোটারদের মনে এরকম একটি ভাবনা থাকে, যে দল ক্ষমতায় আছে, তাদের মনোনীত প্রার্থীরাই জয়ী হোক। কারণ, বিরোধীদলীয় প্রার্থী স্থানীয় নির্বাচনে জয়ী হলেও তার পক্ষে স্থানীয় উন্নয়নে খুব বেশি ভূমিকা রাখার সুযোগ থাকে না। কারণ, একটা বড় সময় তাকে মামলা সামলাতে হয়। তাছাড়া সরকারের সুনজরে না থাকার কারণে বরাদ্দ পেতেও তাকে ‘হ্যাপা’ পোহাতে হয়। বলা হচ্ছে, এসব তিক্ত অভিজ্ঞতার কারণেই বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের ছোট ভাই মির্জা ফয়সল আমিন এবার নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। তিনি ঠাকুরগাঁও পৌরসভার মেয়র। গণমাধ্যমকে বলেছেন, নাগরিকদের কাছে দেওয়া প্রতিশ্রুতি পূরণে ব্যর্থ হয়েছেন বলে এবার নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন না।
বিরোধীদলীয় প্রার্থী হিসেবে জয়ী হওয়ার পর কী রকম ‘দৌড়ের ওপর’ থাকতে হয়, তার বড় উদাহরণ গাজীপুর সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র এম এ মান্নান। যদিও ব্যতিক্রম কুমিল্লার মেয়র মনিরুল হক সাককু। বিরোধী দলের নেতা হয়েও সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে নগরীর উন্নয়নে কাজ করা যায়, সাককু তার উদাহরণ। সিলেটের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীও বিএনপি নেতা। কিন্তু তাকেও খুব বেশি ‘দৌড়ের ওপর’ থাকতে হয় না। অর্থাৎ তিনি ‘ম্যানেজ’ করে চলতে পারছেন। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী জয়ী হলে তার পক্ষে উন্নয়নে ভূমিকা রাখা সহজ—এটা যেমন ঠিক, তেমনি বিরোধীদলীয় প্রার্থী শক্তিশালী হলে এবং ভোটের মঠে কোমর সোজা করে দাঁড়াতে পারলে, অর্থাৎ মাঠ ছেড়ে না দিলে মানুষ তাকেও ভোট দেয়। কিন্তু বিএনপির সাম্প্রতিক রাজনীতিতে সবচেয়ে বড় সমস্যা স্রোতের বিপরীতে কোমর সোজা করে দাঁড়াতে না পারা। এর জন্য দায়ী প্রধানত তাদের দলীয় নেতৃত্বের সংকট। খোদ দলের অনেক সিনিয়র নেতারাও এ নিয়ে ক্ষুব্ধ। দল কে চালাচ্ছেন, কোথা থেকে পরিচালিত হচ্ছে মহাসচিবের কথা কতোটুকু গুরুত্ব পাচ্ছে তা নিয়ে প্রশ্নের অন্ত নেই। এ নিয়ে গণমাধ্যমে বিভিন্ন সময় সংবাদও বেরিয়েছে। সুতরাং সরকার ভোটের মাঠ দখল করে রেখেছে; বিএনপির প্রার্থীদের এজেন্টদের বের করে দেওয়া হয়েছে; দেশে গণতন্ত্র নেই; বাকস্বাধীনতা নেই; বিরুদ্ধ মতের লোকদের দমন পীড়ন করা হচ্ছে এসব অভিযোগ করার আগে বিএনপির বরং উচিত নিজেদের মেরুদণ্ড চেক করা। দলের অভ্যন্তরে কী কী সমস্যা আছে, সেগুলোর সুরাহা করতে না পারলে আওয়ামী লীগের মতো ‘জায়ান্ট’ দলের বিপরীতে তার টিকে থাকা মুশকিল হবে। বরং বিএনপি রাজনীতি থেকে মাইনাস হতে থাকলে অন্য কোনও কট্টরপন্থী দল হয়তো আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী বা বিকল্প হিসেবে তৈরি হয়ে যাবে— যা একসময় আওয়ামী লীগের জন্যও সুখকর হবে না। গণমাধ্যমের খবর বলছে, দ্বিতীয় দফয় প্রায় অর্ধেক সংখ্যক পৌরসভায় বিএনপির প্রার্থীরা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ছিলেন না। অর্থাৎ সক্রিয় ছিলেন না। অভিযোগ আছে, নির্বাচন বা জাতীয় সংসদের উপনির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পেতে নেতারা যতটা মরিয়া, ভোটের মাঠে তারা সেভাবে সক্রিয় নন। তবে কিছু জায়গায় ভিন্ন চিত্রও দেখা গেছে। ফলে যেসব পৌরসভায় বিএনপির প্রার্থীরা শক্ত এবং মাঠ ছেড়ে যাননি, সেসব জায়গায় তুলনামূলক ভালো ফলাফল এসেছে। আওয়ামী লীগের তরফে বরাবরই এই অভিযোগ করা হয় যে, বিএনপি জিততে নয় বরং ভোটকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য নির্বাচনে অংশ নেয়। যে কারণে তাদের প্রার্থীরা মাঠে সক্রিয় থাকেন না। ফলে বিএনপির উচিত আওয়ামী লীগের এই অভিযোগের বিষয়ে নিজেদের অবস্থান সুস্পষ্ট করা। কারণ, শুধু বিরোধিতার খাতিরে বিরোধিতা করলে একটা পর্যায়ে তারা সাধারণ মানুষের কাছেও হাস্যরসের পাত্রে পরিণত হবে।
ভালো ভোট তর্ক : বরাবরের এবারও ভোট নিয়ে অফ ট্র্যাকে নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার যিনি এর আগে ইসির স্বাধীনতা ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে নোট অব ডিসেন্ট দিয়ে গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছেন, যা মূলত বাকি চার কমিশনারের সঙ্গে তার পার্থক্য (দূরত্ব) স্পষ্ট করেছে। দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনের দিন ঢাকার সাভার পৌরসভার তিনটি কেন্দ্র পরিদর্শন শেষে নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের দেওয়া লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, পৌরসভা নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হয়নি। ১৮টি বুথ পরিদর্শনের কথা জানিয়ে তিনি উল্লেখ করেন, বেলা ১টা পর্যন্ত ওইসব ভোটকেন্দ্রে সাত হাজার ৩১১ জন ভোটারের মধ্যে এক হাজার ২৩২ জন ভোট দেন। ৩টি বুথে ৩ জন বিরোধীদলীয় প্রার্থীর পোলিং এজেন্ট দেখতে পান। কিন্তু অন্য কোথাও এজেন্ট ছিলেন না। এছাড়া সাভার পৌর এলাকায় বিরোধীদলীয় প্রার্থীর কোনো পোস্টার দেখতে পাননি উল্লেখ করে কমিশনার বলেন, এই নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক বলা যায় না। যেকোনও নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক না হলে তা সিদ্ধ হয় না। ‘একতরফা নির্বাচন কখনও কাম্য নয়’ বলেও তিনি মন্তব্য করেন। যদিও একই দিন নির্বাচন কমিশনের সিনিয়র সচিব মো. আলমগীর গণমাধ্যমকে বলেন, সুন্দরভাবে ভোট হয়েছে। শান্তিপূর্ণভাবে ভোট হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে সহিংসতা প্রসঙ্গে সচিব বলেন, দুয়েকটি ঘটনা যা ঘটেছে তা একেবারেই নগণ্য। কিছু কিছু এলাকায় দুষ্কৃতকারী কিছু সুযোগসন্ধানী আছে, যা সব সময় থাকে। দুষ্কৃতকারীরা চেষ্টা করে নির্বাচনের পরিবেশ ক্ষণ্ন করার জন্য, যেন সুষ্ঠু নির্বাচন না হতে পারে। তারা নির্বাচনের কাজকে বিঘ্ন করার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়েছে, কিন্তু নির্বাচনি দায়িত্ব পালনকারী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা এটাকে নিয়ন্ত্রণ করেছেন। তাদের নির্বাচনি পরিবেশ নষ্ট করার সুযোগ দেওয়া হয়নি। আলোচনাটা এখানেই যে, সুষ্ঠু তথা শান্তিপূর্ণ ভোট আর অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য ভোট এক কিনা? ভোট সুষ্ঠু হলো, কিন্তু সব দল অংশগ্রহণ করলো না বা পুরো নির্বাচনি মাঠে কেবল একটি দলের প্রার্থীরাই দাপট দেখালেন, তাহলে সেই সুষ্ঠু ভোটকে গ্রহণযোগ্য বলা যাবে কিনা? ফেসবুক থেকে
লেখক: সাংবাদিক।