রাশিদ রিয়াজ : ভারত বায়োটেকের কোভিড টিকা কোভ্যাক্সিন ২০৬ এবং সেরাম ইন্সটিটিউটের টিকা কোভিশিল্ড ২’শ রুপিতে বিক্রির পরও এ দুটি কোম্পানি ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ লাভ করতে পারবে। এ দুটি কোম্পানি টিকা তৈরির আগে কোনো উল্লেখযোগ্য গবেষণা বা উন্নয়ন ব্যয় করেনি। কোনো রকম সুদ, কর, অবমূল্যায়ন সহ অন্যান্য খরচের আগেই ভারতের এ দুটি কোম্পনি এধরনের লাভ করতে সমর্থ হচ্ছে। দি প্রিন্ট
ভারত সরকারের কাছে এ দুটি কোম্পানি ভ্যাকসিন সরবরাহের সময় দাম কম রাখছে। প্রাথমিক পর্যায়ে এসব ভ্যাকসিন বিতরণ বা বিপণনে কোম্পানি দুটিকে কোনো ব্যয় করতে হচ্ছে না। ভারতের একটি নেতৃস্থানীয় ব্রোকিং ফার্মের বিশ্লেষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন শুধু টিকা তৈরির খরচ কোম্পানিকে বহন করতে হচ্ছে যার ফলে তারা এধরনের লাভ করতে পারছে। ভারতে টিকাদান কর্মসূচিতে প্রাথমিক পর্যায়ে ৩ কোটি মানুষকে টিকা দেওয়া হবে যারা কোভিড মোকাবেলায় সামনের সারিতে আছে। এ কারণে ভারত এ দুটি কোম্পানিকে জরুরি ভিত্তিতে ৬ কোটি ডোজ টিকা তৈরির অনুমোদন দেয়। উভয় ভ্যাকসিনই দিতে হবে দুইটি ডোজ করে। ইন্ডিয়ান মেডিকেল এ্যাসোসিয়েশেনের সাবেক সভাপতি ড. রাজন শর্মা বলেন টিকা তৈরি করে লাভ করা সম্ভব হচ্ছে সংখ্যাধিক্যের কারণে। ৩০ থেকে ৪০ কোটি টিকা তৈরি হচ্ছে। এবং এসব টিকা বিভিন্ন দেশে রফতানিও করা হবে। সুতরাং লাভ হবেই। কেউ ক্ষতি করে ভ্যাকিসিন বিক্রি করতে চাইবে না।
ভ্যাকসিন বিশেষজ্ঞ নাভিন থ্যাকার বলেন প্রাথমিকভাবে কমমূল্যে দিতে হলেও কোম্পানি দুটি লাভও কম করছে। সেরামের এমডি আদর পুনাওয়ালা বলেছেন বেসরকারি খাতে তাদের টিকা প্রতি ডোজ বিক্রি হবে ১ হাজার রুপি এবং বিদেশি রফতানি হবে আরো বেশি মূল্যে। ভারত সরকারের তথ্য অনুযায়ী সেরাম প্রাথমিকভাবে ১ কোটি ১০ লাখ কোভিক্স টিকার প্রতি ডোজ বিক্রি করবে ২’শ রুপি করে। আর ২০৬ রুপি করে কোভ্যাক্সিন প্রতি ডোজ টিকা ভারত সরকারের কাছে বিক্রি হবে, টিকার সংখ্যা হবে সাড়ে ৩৮ লাখ। এছাড়া ১৬ লাখ ৫০ হাজার কোভ্যাক্সিন টিকা ফ্রি দেবে ভারত বায়োটেক। দি প্রিন্টের পক্ষ থেকে সেরাম ও ভারত বায়োটেকের কাছে এ ব্যাপারে ইমেইলে বিস্তারিত জানতে চাওয়া হলে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।
পুনের সেরাম ইন্সটিটিউটের যাত্রা শুরু হয় ১৯৬৬ সালে সাইরাস পুনাওয়ালার হাত ধরে। ভারতের টিকাদান কর্মসূচিতে বড় অবদান রাখছে এ কোম্পানি। পোলিও, বিসিসি, রুবেলা, হাম সহ বিভিন্ন রোগের প্রতিষেধক টিকা বানায় সেরাম। সংখ্যার দিক থেকে দেড় বিলিয়ন ডোজ টিকা তৈরি করে বিশে^ শীর্ষস্থানে রয়েছে এটি। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সেরামের বিক্রি ছিল ৫ হাজার ২৩৮ কোটি রুপি, কর দেওয়ার পর লাভ ছিল ২ হাজার ২৫২ কোটি রুপি। ২০১৪ থেকে ২০১৯ সাল এই পাঁচ বছরে সেরামের প্রবৃদ্ধি ঘটে ৮.১ শতাংশ এবং কর ছাড়া লাভ বৃদ্ধি পায় ৫.৩ শতাংশ। সেরামের বিক্রির দুই-তৃতীয়াংশ আসে রফতানি থেকে। ২০১৯ সালে সেরামের মোট সম্পদের পরিমান ছিল ১৬ হাজার ৭০৩ কোটি রুপি। কোভিড টিকা তৈরির জন্যে সেরাম অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির ওষুধ কোম্পানি এ্যাস্ট্রাজেনেকার সঙ্গে যৌথবিনিয়োগে গেছে। সেরামের কোভিশিল্ড ৬২ শতাংশ কার্যকর। সেরাম ইতিমধ্যে ৫ কোটি ডোজ টিকা তৈরির পর আগামী ফেব্রুয়ারির মধ্যে আরো ১০ কোটি টিকা বানাতে যাচ্ছে।
১৯৯৬ সালে ভারত বায়োটেক ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড যাত্রা শুরু করে। ১৬০টি পেটেন্টের বায়োপণ্য তৈরি করে এটি ভারতের নেতৃস্থানীয় বায়োটেকলোজি কোম্পনি। ২০১৯ সালে জিএসকে’র কাছ থেকে কিরন বেহরিংয়ের মালিকানা নেওয়ার পর এটি ভারতে সবচেয়ে বড় জলাতঙ্ক রোগের ওষুধ তৈরির কোম্পানিতে পরিণত হয়। এ কোম্পানি গত অর্থবছরে বিক্রি করে ৭৬৩.৩ কোটি রুপির পণ্য। মোট লাভ ছিল ১১১.৬ কোটি রুপি। কোম্পানির বিক্রির ৩৭ শতাংশ এসেছে রফতানি থেকে। গত পাঁচ বছরে বিক্রির প্রবৃদ্ধি ছিল ২৩.৬ শতাংশ। লভ্যাংশের প্রবৃদ্ধি ছিল ৪৩.৩ শতাংশ। ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিকেল রিসার্সের সহযোগিতায় কোভ্যাক্সিন টিকা তৈরি করছে ভারত বায়োটেক। টিকাটির তৃতীয় ধাপের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চলছে। কোম্পানিটি বছরে ৩০ কোটি টিকা তৈরি করতে পারে। ব্রাজিলে টিক রফতানির চুক্তি করেছে এ কোম্পানি।
এছাড়া ভারতে কেডিলা হেলথকেয়ার কোভিড ওষুধ রেমডেসিভির তৈরি করছে। কোম্পানিটি কোভিড ভ্যাকসিনও তৈরি করছে। ২৬ হাজার কোভিড রোগির ওপর কেডিলা ওষুধ প্রয়োগ করে তৃতীয় মাত্রার ট্রায়াল করছে। তবে কেডিলার টিকার মূল্য সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়নি। গত অর্থবছরে কোম্পানির মোট বিক্রির পরিমান ছিল ১৪ হাজার ২৫৩ কোটি রুপি এবং লাভ হয় ১ হাজার ১৭৬ কোটি রুপি। কোম্পানির আয়ের এক তৃতীয়াংশ আসে রফতানি থেকে। বছরে ১০ কোটি ডোজ টিকা তৈরি করতে পারে কেডিলা। এছাড়া অন্য কোম্পানির সাহায্যে আরো ৫-৬ কোটি বাড়তি ডোজ তৈরি করতে পারে। বিশ্বে কোভিড পরিস্থিতিতে ভ্যাকসিনের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় ভারতের এসব ওষুধ কোম্পানিগুলো ভাল বাজার খুঁজে পেয়েছে। জনসংখ্যার তুলনায় একই সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদী সংক্রমণ রোগ বৃদ্ধি পাওয়ায় ও চিকিৎসা সুবিধা বৃদ্ধি পাওয়ায় ভারতে ওষুধের বাজার আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। বছরে ভারতে ওষুধের বাজারের আকার দাঁড়িয়েছে ২০ বিলিয়ন ডলার এবং তা বৃদ্ধি পাচ্ছে সাড়ে ৯ শতাংশ হারে। বিশ্বের শীর্ষ ১০টি ওষুধ তৈরি দেশের একটি হচ্ছে ভারত এবং এ খাতে বিনিয়োগে ভারত তৃতীয় স্থানে রয়েছে।