ডা. জাকারিয়া চৌধুরী: হরিণকে মাংশাসী হতে হবে
ডা. জাকারিয়া চৌধুরী: (প্রথম পর্বের পর) ইরাকে যে দলটা এ্যাপাচির আঘাতে দলা দলা মাংসে পরিনত হয়েছিল তাঁর সংখ্যা যদি ৪০ ধরি তবে সেখানে মারাত্মক আহত হয়েছে কমপক্ষে চার’শ। এর মধ্যে যদি এক শতাংশ লোক চিকিৎসা সামর্থ রাখে মানে ভিটে মাটি বিক্রি করে হলেও, তাঁর সংখ্যা ৪ জন। ২০০৩ সালে প্রেসিডেন্ট বুশ জুনিয়র ইরাকে যে হামলার সুচনা করেন তাতে শুধু মার্কিন হামলায় নিহত হয় প্রায় ১৪ লক্ষ নিরস্ত্র মানুষ। তারপর ওই সিনারিওতে হঠাত উদয় হয় মুক্তাদা আল সদর এবং ওসামা বিন লাদেনের দল। লাদেনের দল সুন্নী নিয়ন্ত্রিত, মুক্তাদা আল সদর শিয়া গোষ্ঠী। তারা মার্কিনীদের উপর হামলা করার চেয়ে বিশি উদ্গ্রীব ছিল শিয়া সুন্নী দ্বন্ধে। আবার কয়েক বছরের মধ্যেই তারা স্টেজ ত্যাগ করে কারন তারা মার্কিন সমর্থিত ছিল না, কিংবা মার্কিনীদের হয়ে কাজও করছিল না। এবার ফিল্ডে আসে ইজরায়েল । সাদ্দাম আমলের প্রায় ছয় লাখ চাকুরিচ্যুত সেনা, সেনা অফিসার থেকে শুরু করে যত বেশি সম্ভব মার্সেনারি রিক্রুট করতে থাকে। এরা ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় যুক্ত হয়েছে নাকি ক্ষুধার কষ্টে যুক্ত হয়েছে সেটা বিচারের ভার পাঠকদের। বেতন ১২০০-৩৫০০ ইউএস ডলার/মান্থ। কি ভাবছেন ? হিসেবটা কিন্তু ছোট নয়। প্রতিটা হত্যার জন্য অর্থ প্রনোদনা, যৌনতার জন্য নারী, ক্যাশ অর্থ আগাম পরিশোধের ব্যাবস্থা হিসেবে বিল্ডিং ভর্তি ডলার মজুদ, গুডাউন ভর্তি অস্ত্রের ভান্ডার বানিয়ে দেয়া হলো তাদের। এই গোষ্ঠীর নাম দেয়া হল আই এস। এদের চিকিৎসার জন্য ইজরায়েলে হাজার বেডের হসপিটাল নির্মান করে রাখার নিউজ কোনোটা-ই মিথ্যে ছিল না। আহত আই এস যোদ্ধাদের চিকিৎসা তদারকি করতেন ইজ্রায়েলি প্রধানমন্ত্রী খোদ নেতানিয়াহু। তাদেরকে বোমা বানানোর সকল সরঞ্জাম সরবরাহ করতো ভারতের অন্ততঃ নয়টা প্রতিষ্ঠান। বানিজ্যের হিসেবে এগুলো আই এস ক্যাশ ডলার পরিশোধ করে কিনে নিত। যুদ্ধটা চলছিল ( শুধু এশিয়ার হিসেবটা ধরুন ) আফগানিস্থান, ইরাক, ইরান-ইরাকের কুর্দিস্থান, সিরিয়া, সিরিয়া - তুরস্ক, তুরস্ক –কুর্দি, ইরাক-কুর্দি, ইরান-কুর্দি, ইজরায়েল-সিরিয়া, ইজরায়েল-ইরাক, ইউ এস বনাম ইরাক,ইয়েমেন,সিরিয়া,সুদান,ইথিওপিয়া……সউদি ইয়েমেন, ইরান ইয়েমেন ভার্সাস ইউএস সউদি…… নানান ফ্রন্টে। আবার সবার উপর আমেরিকা ন্যাটো, রাশিয়া বোমা ফেলছে আই এস নিধনের নামে। জনসমর্থন পাচ্ছে কিভাবে ? আগেই বলেছি, সমাজে তারা হেটার্স তৈরী করে রেখেছিল। যারা সামাজিক মনস্তত্ত হিসেবে সমাজের উপর চেপে বসেছিল। ওইসব অঞ্চলে ইউরোপের ফ্রান্স ছাড়া চিকিৎসায় উন্নত কোন দেশ নেই। ভারত আই এসকে ক্যামিকেল সরবরাহ করেছে শুধুমাত্র আহত লোকদের চিকিৎসা বানিজ্যটা করতে। চিকিৎসা প্রার্থী মানুষেরা কিসের আঘাতে আহত হতো ? বোমার আঘাতেই বেশিরভাগ। বোমা বানানোর মসলা কে দিয়েছে ভারত দিয়েছে। তাই না ভাই ?
মধ্যপ্রাচ্য এবং দক্ষিন এশিয়ায় ভারতেই শুধুমাত্র তুলনামূলক কম খরচে ভাল চিকিৎসা করাতে আসে হাজার হাজার ইরাকি,আফগান কিংবা ইয়েমেনীয় সহ গোটা মধ্যপ্রাচ্যের লোকেরা। তারা তাদের শেষ কয়েনটা পর্যন্ত খরচ করে কেউ পিতার দিকে তাকিয়ে, কেউ সন্তানের দিকে তাকিয়ে, কেউ মায়ের তরে। এগুলো আমার নিজের চোখে দেখা পর্যবেক্ষন। মুম্বাই এর অভিজাত অঞ্চল্গুলো আমার নখদর্পনে। প্রতিটা হাসপাতাল গড়ে তোলা হয়েছে গত ১৫-২০ বছরের মধ্যে। হাসপাতাল গুলোর সামনে সারিসারি সাজানো ফ্ল্যাগ। কোন কোন দেশের ফ্ল্যাগ ? বাংলাদেশ, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটানের কোন ফ্ল্যাগ নেই। সেখানে ঝুলছে শুধুমাত্র যুদ্ধরত দেশগুলোর পতাকা। এর বাইরের কাউকে তারা চিকিৎসা সেবা দেন না। কেন দেন না ? বিদেশীরা দামাদামি করতে ভয় পায়। বেশিরভাগ রোগীকে তিন ধাপের চিকিৎসা সেখানে দেয়া হয়। প্রথমে জ্বলে পুড়ে যাওয়া অংশ এবং অর্থোপেডিক চিকিৎসা, তারপরে রিহ্যাবিলিটেশন এবং মানসিক চিকিৎসা। এসবে গড়ে প্রতিটা রোগীকে আটকে রাখা হয় চার থেকে সাত মাস পর্যন্ত। গড়ে প্রতিদিনের খরচ পরে ত্রিশ থেকে পঞ্চাশ হাজার রুপি। তারা সেটাকে ডলারে নেয়। দশ হাজার ডলার জমা দেয়ার তিন দিন পর থেকেই ক্যাবিনে ফোন আসতে থাকে। ‘শুধু আপনার একাউন্টেই কোন রিজার্ভ জমা নেই। তারাতারি দশ হাজার ডলার জমা করে দিন। সবাই জমা দিয়ে দিয়েছে। কখন জমা দেবেন ? ফোন আসতে-ই থাকে। আপনি কতক্ষন চুপ করে থাকবেন ? আমাদের ভাষায় বলুন- বাঞ্চোত না দিয়া যাইবি কই ? ভারতের হাসপাতাল গুলোর অনেক ফ্লোর বানানোই হচ্ছে বিল্ট ইন এসি এবং স্যুইট রুম হিসেবে অনেকটা স্টুডিও এ্যাপার্ট্মেন্ট এর আদলে। ফলে দীর্ঘ সময়ব্যাপী রোগীর চিকিৎসা মানেই পুরো একটা পরিবারের বনবাসের মত অবস্থা। প্রতিটা রোগীই ছয় সাতজনের একটা বিশাল পরিবার এবং গড়ে চার থেকে সাতমাসের টানা অবস্থান করেই তাদের চিকিৎসা শেষ করতে হচ্ছে । সো, বিলিয়ন ভাগের এক ভাগ লাভের অংকটা কি বিশাল বুঝেছেন ?!! শুধু মুম্বাইয়ে-ই এমন হসপিটাল আছে কয়েক হাজার এবং সেসবের স্যুট কখনো খালি থাকেনা। একদিনও না। ধরুন ভারত মাতা আমাদের গল্পের সেই শকুন মাতা। যুদ্ধ বাঁধিয়েছে আমেরিকা, বলি হয়েছে ইরাক ও মধ্যপ্রাচ্য, আর যুদ্ধের পক্ষে থাকার স্মারক সম্মানী হিসেবে ভারত পেয়েছে লক্ষ রোগী। এখন একটা কথা দয়া করে বলে যান। বিনা কষ্টে এত বড় উপহার পেয়ে ভারত আর আমেরিকা, যদি কখনো একে অপরের শত্রুও হয় তবুও এ মানিক জোড়ের স্বার্থ হারিয়ে বিচ্ছেদ কি কখনো সম্ভব ? না। কক্ষনো নয়।
চলুন বনের গল্পে ফিরে যাই :
পরদিন একটা হায়েনা একাই আস্ত এক হরিন শিকার করে ফেলল। কেজি দশেক মাংস খেয়েও তার আফসোস রইল এইজন্যে যে, হরিনের প্রায় পুরোটাই ফেলে যেতে হচ্ছে। তার একার পক্ষে এতবড় জানোয়ার সাবার করা সম্ভব নয়। তারপরের দিন একদল কুকুর শিকার করল একটা হরিন। একই দিন বিকেলে আরেকটা হরিণ খুন হল সিংহের হাতে। সকলের নাম, জীবন বৃত্তান্ত, মৃত্যুর কারন লেখা হল নিবন্ধনের খাতায়। এভাবে পাঁচশ হরিনের একটা দল বছর ঘুরতেই যোগ বিয়োগ শেষে তিনশ আশিতে দাঁড়াল। নতুন বছরে এই বহরটিতে প্রচুর শাবক জন্ম নেয়ার কারনেই সংখ্যাটা এমন হল। এর পরের বছর হরিনের সংখ্যা নেমে এল সমান তিন'শ তে। অস্বাভাবিক গতিতে হরিনের সংখ্যা হ্রাস পেতে থাকায় একটা নিরাপদ জায়গায় দলের সকল সদস্য অস্তিত্ব রক্ষার জন্য জরুরী সভায় মিলিত হল। গল্পটাকে পড়ার সুবিধার্থে ধরি তাদের তাদের নেতার নাম বালি...... পিনপতন নীরবতা ভেঙ্গে বালি-ই প্রথম কথা বলল।
বালি- বন্ধুগণ, আপনারা সকলেই অবগত আছেন যে, আমরা হরিন সমাজ আজকে এক ভয়ংকর অস্তিত্ব সংকটে পরে গেছি। আমাদের শিং আজ ভোতা অস্ত্র। এই বনে একমাত্র আমরাই বন্ধুহীন। বাকি প্রায় সবাই আমাদের শত্রু। সামান্য যে কিছু তৃণভোজী জেব্রা আর ওয়াইল্ড বিস্ট আছে তাদের অবস্থা আরও খারাপ। ঘাস খাওয়া নিরীহ সকলেই এ মুহুর্তে অস্তিত্ব সংকটে পরে গেছি। ফলে কেউ কাউকে আর বিশ্বাসও করতে পারছিনা। যে যার মত জীবন বাঁচানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। আমরা সামান্য এই ক'জন হরিন ছাড়া বন বা শরিক জোটের কেউ আজ উপস্থিত হবার প্রয়োজনও মনে করেনি। তাদের সন্দেহ যে, আমরা নিজেদের বাচিয়ে রাখতে প্রতিদিনই তাদের কাউকে না কাউকে ধরিয়ে দিচ্ছি হিংস্র প্রানীদের খাবার মেন্যুতে। অথচ আমরা নিজেরাও দিনে দিনে শেষ হয়ে যাচ্ছি।
-- ওদেরকে ধরিয়ে দেই বলেই আমাদের সংখ্যা এখনো তিন'শ আছে। তা না হলে আজকে আমরা দশ জন থাকতাম। এক নাগারে কথা গুলো বলে গেল দলের দ্বিতীয় শীর্ষ নেতা সুগ্রীব। বালির আপন সহোদর। বদমেজাজী, গোঁয়ার আর দুশ্চরিত্র বলে তরুণী হরিনগুলো একে এড়িয়ে চলে। সে বালি ছাড়া আর কাউকে পরোয়া করেনা। বালির সাথে সুগ্রীব জোরে পারে না।
- কিন্তু এটি জোটের সিদ্ধান্ত ছিল না বলে এক বয়স্ক হরিণ হায় হায় করে উঠল। বালি তার লেজকে সোজা উপরের দিকে খাড়া করাতে সবাই বসে পড়ল।
বলার অদম্য ইচ্ছাকে দমিয়ে রাখতে না পেরে একটা কিশোর হরিন লাফ দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল উত্তেজনায়। সে কিছু একটা জিজ্ঞেস করতে চায়-
কিশোর হরিন-১ লেজকে দুই দিকে নাড়িয়ে ক্ষমা প্রার্থনার ভঙ্গিতে সে বলতে লাগল............
প্রিয় নেতা, যথাযথ সম্মান দিয়েই জানতে চাচ্ছি, আমাদের অস্ত্র গুলো আজ ভোতা কেন ? আমাদের যে কোন একজন সক্ষম পুরুষ কি একাই একটা চিতাকে মেরে ফেলতে পারেনা ? আমি জানি এ অসম্ভব কোন কাজ নয়। যদি মরব-ই তবে এভাবে কাপুরুষের মত কেন ? একই বনের প্রানীরা সমান অধিকার নিয়ে জন্মালেও শুধু তৃণভোজীরা-ই কেন আজ সারা বনময় পালিয়ে বেড়াচ্ছি ? সিংহ, চিতা, হায়েনা এমনকি একটা পাখিরও নিজস্ব টেরিটোরি আছে। আমাদের স্থায়ী ঠিকানা কোথায় মাননীয় স্পীকার ? সর্যি, লিডার। সে হয়ত আরও কিছু বলত কিন্তু তার আগেই তার মা তাকে ভোঁতা শিং দিয়ে খোঁচা মেরে ফেলে দিল। জরুরী সভার ডেকোরাম ভঙ্গের দায়ে শাস্তি হিসেবে তাকে দলচ্যুত করা কিংবা ফিরিয়ে নেয়ার ( আর্টিকেল ৩৬ অনুযায়ী ) এখতিয়ার আছে দলনেতা বালির।
অভিজ্ঞ এবং দলপ্রেমিক বালি শান্ত ভঙ্গিতে কিশোর হরিনের কথা শুনল। তারপর একে একে বলতে শুরু করল।
... ....... হ্যাঁ বাছা, তোমার কথা-ই ঠিক। তুমি যা ভাবছ আমরাও তা-ই ভাবছি। শোন বাবারা, কার্যকর অস্ত্রও কখনো কখনো সময় গুনে ভোঁতা হয়ে যায়। উদাহরন হিসেবে মানব সমাজের ভয়ংকর অস্ত্র দা এবং ছুরির গল্প শোনাল...... যে জিনিস দিয়ে তারা হরিনকে ছোট ছোট টুকরায় খন্ড বিখন্ড করে পুড়ে পুড়ে খায় সে জিনিসও সঠিক ব্যাবহারের অভাবে মরিচা ধরে যায়...... কোন কাজেই আসে না...... তেমনি আমরাও আমাদের শিং ব্যাবহার করব না বিনিময়ে খাদক পক্ষ আমাদের উপর হামলা চালাবে না এমন একটা চুক্তি এক সময় হয়েছিল। তারা সে চুক্তি মানেনি বরং প্রতিদিন আমাদের সীমান্তে একটা করে হলেও লাশ ফেলেছে। আমাদের ছেলেরা মাঝে মাঝে জানের রিস্ক নিয়ে ওপাড়ে গিয়ে হারানো হরিনের চামড়া কিংবা হাড়গোড় পেয়েছে। হরিণটি চিরতরে হারিয়ে গেছে ঠিকই। আমরা পঁচিশ বছর মেয়াদি চুক্তির আদলে তাদের গোলামী করেছি। বিনিময়ে তারা আমাদের এক টুকরো চামড়া কিংবা কয়েকটা হাড়গোড় ছাড়া আর কিছুই ফেরত দেয়নি। তাদের সাথে চুক্তির অসারতা অনেক আগেই প্রমানিত হয়ে গেছে.........
-- আমরা আরেকবার চেষ্টা করে দেখতে পারি। শত্রুতা কোন সমাধান নয়। তারা-ই আমাদের সবচে নিকটজন। তাদের সাথে মিলেমিশে থাকা সম্ভব............ সুগ্রীব যেন ছোঁ মেরে দলনেতার বক্তব্যকে ছিনতাই করতে চাইল।
দলের সবচে বয়স্ক এবং প্রবীন হরিণটা হু হু করে কেঁদে বলে উঠল...............
ইয়া মাবুদ, আমাদেরকে তুমি হায়েনা, সিংহ আর কুকুরের লকলকে জিভ এবং ধারালো দাঁত থেকে বাঁচাও। ইয়া মালিক, মানব সমাজকে ধ্বংস করে দাও ... মানুষেরা হায়েনার চেয়েও খারাপ...... এরা প্রয়োজন ছাড়াই শুধু মাত্র বিনোদনের জন্যেও আমাদের হত্যা করে.........
এ সময় আরেকজন কিশোর হরিন হাত তুললে বালি তাকেও কথা বলার অনুমোদন দিলেন হরিন সমাজের আর্টিকেল ৩৬ বলে...
কিশোর হরিন-২ আমি একটা বিষয় বুঝতে পারছি না মাননীয় স্পীকার। আমরা কখন কোথায় আছি সে খবর শত্রুরা নিখুঁত ভাবে পেয়ে যায় কিভাবে ? আমরা যে পথে যাইনা সে পথে প্রস্রাব করে আসি যেন শত্রুদের ভুল পথে চালিত করতে পারি। শত্রু’র চোখে ধুলো দেয়ার এই পথ সবচে কার্যকর পথ হওয়া স্বত্তেও তাদের ধোঁকা দেয়া যাচ্ছে না কেন ? নাকি শর্ষেই কোন ভুত লুকিয়ে আছে ? দল থেকে কেউ ওদের পথ দেখিয়ে নিয়ে আসছে না তো ......?
বালি দুই কিশোর হরিনের প্রশ্ন করার ধরন দেখে খুশি হলেন। এরা ভাবতে শিখেছে। এরা সমস্যা চিহ্নিত করে ফেলেছে প্রায়... কিছু বলার জন্যে মুখ খুলতে গিয়েও সে চুপ করে গেল। তার ভাই সুগ্রীব অগ্নি দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। ফলে দলের অন্যান্য হরিণদের দৃষ্টিও সুগ্রীবের দিকেই ঘুরে গেল......... সুগ্রীব বিস্ফোরিত হবার মত লাফ দিয়ে বালির একেবারে সামনে চলে এল।
- ভেবেছিলাম তুই সত্যিই হরিণ জাতির সংকট সমাধানের জন্য সভা ডেকেছিস। আমার ভাবনায় ভুল ছিল। আমি নিজের স্ত্রী-কে অবিশ্বাস করে তোর মত গাদ্দার ভাইকে বিশ্বাস করেছিলাম। ভুল আমিই করেছি। ভারতী ( সুগ্রীবের স্ত্রী ) গত রাতেই আমাকে বারবার বলেছে এখানে উপস্থিত না থাকতে। এটা হচ্ছে আলোচনার নামে কালক্ষেপণের সভা। তলে তলে তোদের প্রস্তুতি চলছে। তোরা আমাকে হায়েনার হাতে জীবন্ত তুলে দেয়ার চাল করছিস। এই সভা ডেকেছিস সকলকে এটা বোঝাবার জন্যে যে, আমিই ভারতীর বাপ মানে আমার শ্রদ্ধেয় শ্বশুরের কাছে বারবার দলের অবস্থান জানিয়ে দিয়ে সংবাদ পাচার করি...... শালা বাঞ্চোত, তোকে দেখে নেব। চলুন বন্ধুগণ, এখানে আমরা আর নিরাপদ নই। সীমান্তের ওপাড়ে আপনাদের থাকা খাওয়া, নিরাপত্তা, বিনোদন সব কিছুর ব্যাবস্থা করে রেখেছেন আমার শ্বশুর আব্বাজান। তিনি সভ্য সমাজের একজন মান্যগন্য লোক। আপনারা তার নাম শুনেছেন হয়ত। চিত্ত রঞ্জন হরিণ......
মাত্র দশ বারোজন ষন্ডা প্রকৃতির মাগিবাজ, চোর হরিণ নিয়ে চলে গেল সুগ্রীব। উদ্ভূত ঘটনার প্রেক্ষিতে সভার কার্যবিবরনী স্থগিত রেখে বালির নেতৃত্বে পঁচিশ জনের একটা চৌকশ দল চলে গেল তাদের গোপন গুদামের নিরাপত্তায়। সেই গুদামে পুরো দলটির একমাস টিকে থাকার মত শুকনো খাবার মজুদ রাখা হয়। বিভিন্ন ধরনের সীম, মটরদানা,সব্জি শুকিয়ে রাখা হয় যেগুলো পানিতে ভিজলেই সতেজ হয়ে উঠে। এখানে বছরে কুড়ি পঁচিশ দিনের মত পানি জমে থাকে। সে সময় আবার হরিণীদের বাচ্চা প্রসবের সময়। ফলে পুরুষ হরিনরা খুব অল্প খেলেও প্রসূতি মায়েদের প্রচুর খাবার লাগে। কিন্তু একি ! গুদাম ফাকা কেন ? এত কম সময়ে এত মালামাল সরিয়ে ফেলা অসম্ভব ! হচ্ছেটা কি ? বালির কপালে চিন্তার গভীর খাঁজ পড়ল।
কিশোর-২ হরিণটাই এবারে ত্রাতার ভুমিকায় কথা বলল-
গত একমাস তারা রাতে আমাদের সাথে ঘুমাত না নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে। আসলে প্রতিরাতে তারা গুদামের মাল ভারতী মাগীর বাপের বাড়ি পাঠিয়েছে। তারা যে কয়জন চলে গেল তাতে আরও পঁচিশ বছর শুয়ে বসে খেলেও ভারতীর বাবার এক পয়সা খরচ করতে হবে না এই গাদ্দারদের পিছনে কিন্তু কোন অঘটন ঘটিয়ে ফেলতে পারলে এই বনের সব কিছু লুট করবে ওই সুতার হরিনের ষন্ডারা....
বালির দলটা করুন মুখে ফিরে এলো। গুদাম লুটের খবর শুনে সেই বৃদ্ধ হরিণটা আবারও কাঁদতে শুরু করল। হায়রে খোদা !! এ তুমি কি করলা। দুধের বাচ্চা লইয়া আমাদের এই মেয়ে হরিনগুলো আগামী বর্ষায় কি করবে রে খোদা......... আমি মিষ্টি প্রস্রাবের রোগী। আমাকেও রক্তে চিনির পরিমান ঠিক রাখতে হয়। আমি বুড়া হরিণ। এখন কি হবে রে.........
সে রাতের একেবারে শেষ প্রহরে দলটা হায়েনা, কুকুর আর সিংহের যৌথ আক্রমনের মুখে পড়ল। কেউ কিছু বোঝার আগেই চারটা হরিণ প্রান হারাল। কিশোর হরিন-২ ই প্রথম আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে যুদ্ধের ডাক দেয় এবং আক্রমনের চেষ্টা করে। একটা হায়েনা পিছন দিক থেকে এসে তার অণ্ডকোষ কামড়ে ছিড়ে ফেলে। ফলে সাথে সাথেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পরে সে। ততক্ষনে কিশোর হরিন ১ তার শিং দিয়ে অন্য একটা হায়েনার বুকে গভীর ক্ষত করে হরিণ ইতিহাসে প্রথমবারের মত প্রতিরোধের চিহ্ন আঁকে ......
অপ্রস্তুত হরিন দলটিকে রাতের আধারেই শেষ করে দেয়ার চেষ্টা করেছিল অপারেশন 'খোজ দ্যা সার্চ' নামের যৌথ বাহিনীর আক্রমন।
অন্যদিকে বালির সাম্রাজ্য ধংস এবং বালিকে হত্যায় বদ্ধপরিকর ভারতী পরিবার আর সুগ্রীবের এক চ্যালা কাউকে কিছু না জানিয়ে যুদ্ধ পরবর্তী দলের পরিচালনা এবং সুগ্রীবের ভবিষ্যত নেতৃত্ব সহ বিভিন্ন বিষয়ে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করে বসে। তাদের চুক্তির খসড়া দেখে দলের একজন সিনিয়র হরিণ ষড়যন্ত্রের আলামত টের পেয়ে যায়। ফলে সে পালিয়ে মুল দলে চলে আসতে চেয়েছিল। ঠিক এই সন্দেহটাই করেছিল সুগ্রীব। তাই নিজে চুক্তি স্বাক্ষর পর্বে উপস্থিত না থেকে একটা ঝোপে লুকিয়ে পথের উপর নজর রাখছিল। সুগ্রীব নিজ শিং দিয়ে পালাতে চেষ্টারত সিনিয়র হরিনটির ভুড়ি বের করে প্রকাশ্য পথে ফেলে রেখে যায় যেন অন্যরা তার বার্তা বুঝতে পারে। (সমাপ্ত)
পরিচিতি: ডেন্টাল সার্জন, কলামিস্ট