সুজন কৈরী : শীতকাল শুরু হলেই রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থাপনায় অগ্নিকাণ্ডে সংখ্যা বেড়ে যায়। বিশেষ করে বস্তিগুলোতে। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর বলছে, বছরের অন্যান্য সময়ের তুলনায় শতীকালে দাহ্য পদার্থগুলোতে শুষ্কতা বা রুক্ষতা তৈরি হয়, যা জ্বলে উঠতে সহয়তা করে। এছাড়া বস্তিবাসীদের অসচেতনতা ও অবৈধ বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগ নেয়া একটি বড় কারণ।
সর্বশেষ সোমবার রাত থেকে মঙ্গলবার মধ্যরাত পর্যন্ত রাজধানীর মহাখালীর সাততলা বস্তি, মোহাম্মদপুর বাবর রোডের বিহারিপট্টি ও মিরপুরের কালশী বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন বাউনিয়া বাঁধের বস্তিতে অগ্নিকাণ্ড ঘটে। এসব ঘটনায় কেউ হতাহত না হলেও পুড়ে গেছে কয়েকশ ঘর। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে নিম্ন আয়ের হাজারও মানুষ। বস্তিবাসীর অভিযোগ, এসব অগ্নিকাণ্ডের নেপথ্যে রয়েছে দখলদারিত্ব, চাঁদাবাজি এবং উচ্ছেদের কৌশল। প্রতি বছরই এসব অপতৎপরতার বলি হচ্ছেন তারা। কিন্তু তাদের পুনর্বাসনে এগিয়ে আসছে না সরকার।
তবে বস্তিতে অগ্নিকাণ্ডের বিষয়ে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর বলছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে বস্তিতে আগুনের পেছনে অবৈধ বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগ দায়ী। এরপরও ওই তিনটি ঘটনায় আগুনের সূত্রপাত খতিয়ে দেখতে পৃথক কমিটি গঠন করেছে সংস্থাটি। শিগগিরই কমিটিগুলো প্রতিবেদন জমা দেবে।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৭ সাল থেকে চলতি বছেরর অক্টোবর পর্যন্ত প্রায় চার বছরে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন বস্তিতে ১ হাজার ৪৬টি অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। এতে মোট ক্ষতি হয়েছে ১০৪ কোটি ৪১ লাখ ৮৪ হাজার ৬৮৮ টাকার। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করা হয়েছে ৪৭ কোটি ৪৬ লাখ ৪২ হাজার ৪৫ টাকার মালামাল। এসব অগ্নিকাণ্ডের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঘটেছে ২০১৮ সালে। ওই বছর চট্টগ্রামে ঘটে সবচেয়ে বেশি অগ্নিকাণ্ড। সেখানে ৪০৩টি অগ্নিকাণ্ডে ৭ কোটি ৯২ লাখ টাকার ক্ষতি এবং ঘটনাস্থলগুলো থেকে ২২ কোটি ৮ লাখ টাকার মালামাল উদ্ধার করা হয়েছে। এরপর রংপুরে ঘটেছে ৮৮ অগ্নিকাÐ। এতে ক্ষতি হয়েছে ৮৭ কোটি ৫৩ লাখ টাকা এবং ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার হয়েছে সাড়ে ১৪ লাখ টাকার মালামাল। ঢাকায় ঘটেছে ৩৩ অগ্নিকাণ্ড। এতে ৫ কোটি ২৯ লাখ ১০ হাজার টাকা ক্ষতি ও ৬ কোটি ৪ লাখ ৫০ হাজার টাকার মালামাল উদ্ধার করা হয়েছে। এসব অগ্নিকাণ্ডে ২জন আহত হয়েছেন।
এর আগের বছর অর্থা’ ২০১৭ সালে ২৫৪টি অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। ওই বছর চট্টগ্রামে ১৫৩টি অগ্নিকাণ্ডে ১ কোটি ৩৬ লাখ ২০ হাজার টাকার ক্ষতি ও ১২ কোটি ৩৫ লাখ টাকার মালামাল উদ্ধার করা হয়েছে। এরপর রংপুরে ৬৬টি অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতি হেেছ ৩১ লাখ টাকা ও উদ্ধার হয়েছে সাড়ে ৬৮ লাখ টাকার মালামাল। ঢাকায় ৩২টি অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতি হয়েছে ১ কোটি ২১ লাখ ও উদ্ধার হয়েছে ১২ কোটি ৩৫ লাখ টাকার মালামাল। অগ্নিকাণ্ডে একজন নিহত ও ১০ জন আহত হয়েছেন।
২০১৯ সালে মোট ১৭৪টি অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। এরমধ্যে রংপুরে ৯৫টি অগ্নিকাণ্ডে ১ কোটি ৭৩ লাখ টাকার ক্ষতি ও সাড়ে ২২ লাখ টাকার মালামাল উদ্ধার হয়েছে। চট্টগ্রামে ৪৬টি অগ্নিকাণ্ডে ৩৭ লাখ ৩৯ হাজার টাকার ক্ষতি ও ২ কোটি ৭৫ লাখ ৭২ হাজার টাকার মালামাল উদ্ধার করা হয়েছে। আর ঢাকায় ৩১টি অগ্নিকাণ্ডে ৫ কোটি ২১ লাখ ৫০ হাজার টাকার ক্ষতি ও ১১ লাখ ৪৫ হাজার টাকার মালামাল উদ্ধার করা হয়েছে।
চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ঢাকায় ২৭টি অগ্নিকাণ্ডে ১০ লাখ ৬৮ হাজার টাকার ক্ষতি ও ৩৭ লাখ টাকার মালামাল উদ্ধার করা হয়েছে। চট্টগ্রামে ২৯ অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতি হয়েছে ১৯ লাখ টাকার ও উদ্ধার হয়েছে প্রায় ১১ কোটি টাকার মালামাল। এছাড়া রাজশাহী বিভাগে ৩টি, খুলনায় ৬টি, বরিশালে ৩টি, সিলেটে ১৩টি, রংপুরে ১১টি ও ময়মনসিংহ বিভাগে ১টি অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। এসব ঘটনায় ১০ জনের প্রাণহাণি ও ২৮ জন আহত হয়েছেন। বস্তিতগুলোতে বারবার ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটলেও প্রকৃত কারণ বা রহস্য সবসময়ই অজানা থেকে যাচ্ছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ থেকে সব অগ্নিকাণ্ডেরই তদন্ত করা হলেও তা জনসম্মুখে প্রকাশ করা হয় না।
অভিযোগ রেেছ, বস্তিগুলোতে ঘিরে মাদকের বাজার গড়ে ওঠাও। এছাড়া বস্তিগুলোর অধিকাংশই সরকারি খাসজমির ওপর তৈরি করা হয়। এজন্য স্থানীয় প্রভাবশালীদের জমি দখলেরও টার্গেট থাকে। এ কারণে ভ‚মি দখল, আধিপত্য বিস্তার, ক্ষমতার দ্ব›দ্ব ও নাশকতা সৃষ্টিসহ নানা রাজনৈতিক অপকৌশল বাস্তবায়নের জন্য বস্তি দখল করতে পরিকল্পিতভাবে আগুন লাগানো হয়ে থাকে বলে অভিযোগ রয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত বস্তিবাসীরাও প্রায়ই বলে থাকে, কৌশলে উচ্ছেদ কিংবা আধিপত্যের জেরে কোনো পক্ষ আগুন ধরিয়ে দিয়েছে।
তবে অগ্নিকাণ্ড নিয়ে কাজ করা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অগ্নিকাণ্ডের পর প্রায় সব ধরনের আলামতই আগুনেই নষ্ট হয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে ফায়ার ফরেনসিক ল্যাব থাকলেই কেবল অগ্নিকাণ্ডের সঠিক কারণ জানা সম্ভব। কিন্তু দেশে এখনও ফায়ার ফরেনসিক ল্যাব প্রতিষ্ঠা করা হয়নি। তাই বিভিন্ন বক্তব্য, পূর্ব অভিজ্ঞতা ও ধারণা থেকে অগ্নিকাণ্ডের কারণ নির্ধারণ করা হয়ে থাকে।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের ঢাকা বিভাগীয় উপ পরিচালক দেবাশীষ বর্ধন বলেন, অবৈধ অপরিকল্পিত বৈদ্যুতিক লাইন, গ্যাসলাইন এবং অসচেতনতা- এই তিনটি কারণে বস্তিতে অগ্নিকাণ্ড বেশি ঘটে। এর বাইরেও বস্তির ভেতরে যত্রতত্র চুলা স্থাপন এবং কাঠখড়ি দিয়ে রান্নার কারণেই অগ্নিকাণ্ড ঘটে থাকে। মূলত গ্যাস ও বিদ্যুতের লাইনগুলো লুজ কানেকশন বা টেনে নেয়া হয়ে থাকে। গ্যাসের সাধারণ পাইপগুলো মাটির ওপরে ছড়ানো-ছিটানো থাকে। সেগুলো নানা কারণে অনেক সময় লিকেজ হয়। এমন অবস্থায় রান্নার চুলা বা সিগারেট-দিয়াশলাই থেকে ওই লিকেজে অগ্নিসংযোগ ঘটলে বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ড ঘটে।
তিনি বলেন, সাধারণত শীতকালে অতি দাহ্য পদার্থগুলো অতিমাত্রায় শুষ্ক থাকে। যা আগুন জ¦ালাতে সহায়ক। এছাড়া বস্তিগুলোও অপরিকল্পিতভাবে বাঁশ-কাঠ, পলিথিন ও হার্ডবোর্ডের মতো অতি দাহ্য পদার্থ দিয়ে তৈরি করা হয়। এজন্য বস্তিগুলোতে আগুন লাগলে ক্ষতির মাত্রা বেশি হয়। তবে বর্তমানে ফায়ার সার্ভিসের সক্ষমতা অনেক বেড়েছে। গাড়িসহ অন্যান্য সরঞ্জাম বেড়েছে। কোনও বস্তিতে আগুন লাগার থবর পাওয়া মাত্রই একসঙ্গে ১২-১৩টি ইউনিট পাঠানো হচ্ছে। তবে সরু গলি, অতিরিক্ত লোক সমাগম, ও বস্তিগুলোতে পারিন উৎস না থাকায় আগুন দ্রæত নিয়ন্ত্রণে আনতে বেগ পেতে হয়।
ফায়ার সার্ভিসের এই কর্মকর্তা বলেন, অধিকাংশ অগ্নিকাণ্ডের পর বস্তিবাসিরা আগুন ধরিয়ে দেয়ার অভিযোগ করেন। কিন্তু এই অভিযোগ সুস্পষ্ট প্রমাণ করার মতো প্রযুক্তিগত কোনো সুযোগ-সুবিধা আমাদের দেশে নেই। সাধারণত আগুনেই সবচেয়ে বেশি আলামত নষ্ট হয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে ফায়ার ফরেনসিক ল্যাব থাকলে কিছুটা হলেও সুফল পাওয়া সম্ভব হবে।
দেবাশীষ বর্ধন বলেন, বস্তিগুলোতে অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধে অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। লিফলেট বিতরণ করা হচ্ছে। লোক সমাগম এড়াতে গঠণ করা হয়েছে তিনটি পথক টিম। কোথাও আগুনের খবর পেলে এই টিমের সদস্যরা গিয়ে লোকজনকে সরিয়ে ফায়ার সার্ভিসসহ সংশ্লিষ্টদের কাজের পরিবেশ তৈরি করে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক নগর পরিকল্পনাবিদ মো. মাজহারুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, বস্তিতে অপরিকল্পিত ও অব্যবস্থাপনাগত জীবনযাপন প্রক্রিয়ার কারণেই মূলত বেশিরভাগ অগ্নিকাণ্ড ঘটে। কেননা এখানে গ্যাসের পাইপ ও বিদ্যুতের লাইন সাধারণত ঝুলন্ত বা মাটিতে ফেলে রেখে অপরিকল্পিতভাবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। তাতে করে লিকেজ ও শর্টসার্কিটও হয় বেশি। সেখান থেকেই মূলত বেশিরভাগ অগ্নিকাণ্ড ঘটে থাকে। তিনি আরও বলেন, পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশে বস্তিবাসীদের জন্যও নির্দিষ্ট এলাকায় পরিকল্পিত বাসস্থানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমাদের দেশেও অনেক সময় এসব বলা হয়, কিন্তু কার্যত বস্তিবাসীদের জন্য সেভাবে উদ্যোগ নেয়া হয়নি। বস্তি মূলত সরকারি খাস জমিতেই বেশি গড়ে ওঠে। সরকার চাইলেই বস্তিবাসীর জন্য সেই খাস জমিতেই পরিকল্পিত বাসস্থানের ব্যবস্থা করে দিতে পারে। এটা করা গেলেই ভয়াবহ এসব অগ্নিকাণ্ড এড়ানো সম্ভব।