ড. সেলিম জাহান: এক সপ্তাহেরও কম সময় বাকি। আগামী ৩ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন। একটি অসম, অস্থির, অস্থিতিশীল ও অবজায়যোগ্য পৃথিবীর প্রেক্ষাপটে এ নির্বাচনের গুরুত্ব অপরিসীম। বিশেষ করে, বিশ্বব্যাপী কোভিড সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে এ নির্বাচন এক নতুন মাত্রিকতা লাভ করেছে। সুতরাং আগামী সপ্তাহের যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচন শুধু যুক্তরাষ্ট্রের জনগনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নয়, বিশে^র জন্যও প্রাসঙ্গিক। এই নির্বাচনের মোটাদাগের বিষয়গুলো ছাড়িয়ে যদি সূক্ষ্ম বিষয়গুলোর দিকে তাকাই, তাহলে বোঝা যাবে, আগামী সপ্তাহের নির্বাচন হচ্ছে একটি মৌলিক লড়াই, বিজ্ঞানের সঙ্গে গোঁড়ামির, যুক্তির সঙ্গে শক্তির, ঐক্যের সঙ্গে বিভাজনের, সত্যের সঙ্গে মিথ্যার, মানবতার সঙ্গে পাশবিকতার, সুব্যবহারের সঙ্গে কুব্যবহারের, আশ্বাসের সঙ্গে ভীতির, দায়িত্বশীলতার সঙ্গে দায়িত্বহীনতার।
প্রথমত আগামী সপ্তাহের নির্বাচনে বিজ্ঞানমনস্কতার সঙ্গে গোঁড়ামীর দ্বন্দ্বটি উঠে আসছে। আজ বিশ্বব্যাপী যে করোনা সঙ্কট চলছে, সংক্রমণ ও মৃত্যুর দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্র সে তালিকায় শীর্ষস্হানে রয়েছে। এ পর্যন্ত এ দেশে সংক্রমিত হয়েছে ৯০ লাখের এটা কোন সমস্যাই নয়’ কিংবা ‘শিগগীরই এ সমস্যা শেষ হয়ে যাবে’ র মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো না, কোভিড এড়াতে ময়লা পরিষ্কারক ক্ষার পান করতে যুক্তরাষ্ট্রের জনগণকে পরামর্শ দিয়েছিলেন যুক্তরাষ্টের বর্তমান রাষ্ট্রপ্রধান এবং আগামী ৩ নভেম্বরের রিপাবলিকান দলের প্রার্থী। বলে নেয়া ভালো যে তিনি মুখাবরনীও ব্যবহার করেন না এবং যাঁরা করেন, তাঁদের উপহাস করেন। অন্যদিকে, ডেমোক্রেটিক দলের প্রার্থী ভূতপূর্ব উপরাষ্ট্রপতি জো বাইডেন পুরো সঙ্কটটিকে দেখছেন বিজ্ঞান ও যুক্তির দৃষ্টিকোণ থেকে।
দ্বিতীয়ত ডোনাল্ড ট্রাম্পের কৌশলটিই হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের জনগোষ্ঠীকে বিভাজিত রেখে একটি সংঘর্ষপূর্ণ সমাজ চিকিয়ে রেখে শাসন করা। সেজন্য ‘লাল’ ও ‘নীল’ অঙ্গরাজ্যের কথা বলা হচ্ছে, ভীতির একটি সংস্কৃতি ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে, সন্ত্রাস বৃদ্ধির লক্ষ্যে উস্কানি দেয়া হচ্ছে। এ প্রক্রিয়াতে, কৃষ্ণাঙ্গদের অবদমিত করা হচ্ছে, মেক্সিকান অভিবাসীদের ওপরে অত্যাচার বাড়ছে, সংখ্যালঘুদের প্রান্তিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। অন্যদিকে জো বাইডেন অখণ্ড যুক্তরাষ্ট্রের কথা বলছেন, ঐক্যের ওপরে জোর দিচ্ছেন, মানুষে মানুষে সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির বাণী প্রচার করছেন।
তৃতীয়ত ডোনাল্ড ট্রাম্প একটি ‘ভীতির সংস্কৃতি গড়ে তুলে বিজয়ের চেষ্টা করছেন। ‘চীনা জুজুর’ ভয় থেকে শুরু করে, অভিবাসীরা দেশীয়দের কাজ নিয়ে নিচ্ছে, ইরান যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ে ষড়যন্ত্র করছেÑ এমন সব ভয় তিনি দেখিয়ে যাচ্ছেন তিনি যুক্তরাষ্ট্রে জনগণকে। যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রশাসন অভিবাসীদের বিরুদ্ধে খড়গহস্ত হয়েছে, শে^তাঙ্গ-শ্রেষ্ঠত্বকে সমর্থন করেছে, বিশ^-বিচ্ছিন্ন নীতিমালা গ্রহণ করেছে। এর কোনোটিই মৌলিক আমেরিকান ধ্যান-ধারনার সঙ্গে যায় না। সেই সঙ্গে চলছে মিথ্যের বেসাতি। কোভিড থেকে শুরু করে অর্থনীতির হাল-হকিকত, নিজের তথাকথিত সাফল্য থেকে শুরুকে জো বাইডেনের রাশিয়ার সংযোগ ইত্যাদি ইত্যকার বিষয়ে নিরবচ্ছিন্ন মিথ্যে কথা বলে চলেছে। এ বিষয়ে অবশ্য তিনি গোয়েবলসের সমতুল্য। অন্যদিকে, জো বাইডেন মিথ্যে কথা বলছেন, এমন অভিযোগ এখনও শোনা যায়নি।
চতুর্থত: ব্যবহারের দিক থেকেও ট্রাম্পের সংস্কৃতি হচ্ছে উপহাসের, মানবিক অবমাননার এবং কুব্যবহারের। তাঁর কর্মকাণ্ডে ট্রাম্প নানান কুরুচির পরিচয় দিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে বহু অদক্ষ ও দুর্বল প্রশাসক রাষ্ট্রপ্রধান হয়েছেন, কিন্তু এমন অমানবিক মানব দেশটির নেতৃত্বে যাননি। অন্যদিকে বাইডেন বিশ^াস করেন প্রশংসায়, মানবিক মর্যাদায় ও সুব্যবহারে। তাঁর ভদ্রতা, সুরুচি ও মানবিক গুণ সর্বজনবিদিত। পঞ্চমত ট্রাম্প যেখানে সব দোষ অন্যের ওপরে চাপান, বাইডেন সেখানে দায়িত্ব নেন। ট্রাম্প যেখানে দায়িত্বহীন কথা বলেন, বাইডেন সেখানে পরিমিত প্রাসঙ্গিক কথা বলেন। একজন সত্যিকারের নেতার বড় গুণ হচ্ছে অন্যকে দোষারোপ করা নয়, নিজে দায়িত্ব নেয়া।
তবে এ নির্বাচনে ইতিহাস গড়ারও কিছু ব্যাপার রয়েছে। প্রথমত এ নির্বাচনে মানুষ বিপুল সংখ্যায় অংশগ্রহন করেছে। এমনটা আগে আর দেখা যায়নি। মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে গেছে বর্তমান প্রশাসনকে নিয়ে এবং বুঝেছে যে পরিবর্তন চাইলে তাদের ভোটের মূল্য অনেক। আগাম নিজ উপস্থিতিতে ভোটের জন্য যে দীর্ঘ লাইন ও দীর্ঘ সময়ের অপেক্ষা নানান জায়গায় লক্ষ্য করা যাচ্ছে, তা যেকোনো গণতন্ত্রমনা মানুষকে প্রীত করবে।
দ্বিতীয়ত: এবারের ভোটের একটি বিরাট অংশ হচ্ছে ডাকের মাধ্যমে ভোট ও আগাম ভোট। ইতোমধ্যেই ৬ কোটিরও বেশি নাগরিক তাঁদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন। ডোনাল্ড ট্রাম্প অবশ্য জাকের মাধ্যমে ভোটের সম্পর্কে সম্ভাব্য কারচুপির কথা বলেছেন, যার কোন ভিত্তি নেই। জল ঘোলা করাই তাঁর উদ্দেশ্য। তৃতীয়ত এবারের ভোটে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক তরুণ ভোট দিয়েছেন ও দিচ্ছেন। হয়তো তাঁরা সচেতন হয়েছেন, কিংবা তাঁরা ডাকের মাধ্যমে ভোট বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন, কিংবা তাঁরা নতুন তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করছেন। তরুণেরা এবার অনেক বেশি হারে নির্বাচনে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করছেন। এটাও ভালো লক্ষণ। যুক্তরাষ্ট্রের ২০২০ সালের রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচন কোনো শেষ কথা নয়, একমাত্র কথা তো নয়ই। কিন্তু এবারের লড়াইটি শুভের সঙ্গে অশুভের। বহু হৃত মূল্যবোধ ফিরিয়ে আনার জন্যে, বহু নষ্ট করে দেয়া প্রক্রিয়াকে শক্ত ভূমির প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে এবং বহু অশনি সঙ্কেত রোধ করার জন্যে আগামী সপ্তাহে মার্কিন জনগনের রায় একটি ঐতিহাসিক পালাবদল শুরু করুক - শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সব মানুষের এটাই কামনা। ফেসবুক থেকে