বণিক বার্তা : চলতি বছরের মার্চে দেশে যখন করোনার সংক্রমণ শুরু হয় তখন শীত পেরিয়ে গিয়েছিল। এ কারণে শীতে করোনার প্রকোপ কেমন হতে পারে সে ধারণা নেই দেশের মানুষের। তবে করোনার বৈশ্বিক পরিস্থিতি বলছে, এখন পর্যন্ত শীতপ্রধান দেশগুলোতেই বেশি তাণ্ডব চালিয়েছে এ মারণ ভাইরাস। শীতের আগেই উত্তর গোলার্ধের বিভিন্ন অঞ্চলে আশঙ্কাজনক হারে ভাইরাসটির সংক্রমণ বাড়ছে বলে জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও (ডব্লিউএইচও)। এ কারণে আসছে শীত মৌসুমে করোনার সম্ভাব্য পরিস্থিতি নিয়ে শঙ্কায় রয়েছে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে সরকার ও বিশেষজ্ঞরা। বিশেষ করে ছিন্নমূল বা গৃহহীন মানুষদের জন্য শীত বাড়তি ঝুঁকি তৈরি করবে বলে আশঙ্কা সবার।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শীতকালে ঠাণ্ডা, কাশি, শ্বাসকষ্টের মতো কিছু রোগের প্রকোপ বেড়ে যায়। আবার কভিড-১৯-এর উপসর্গও এসব। ঠাণ্ডাজনিত এসব সমস্যায় বেশি ভোগে ছিন্নমূল মানুষেরা। করোনা থেকে বাঁচতে ঘন ঘন সাবান পানি দিয়ে হাত ধোয়া, মাস্ক পরা, একে অন্যের কাছ থেকে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখাসহ নানা সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের তাগিদ দেয়া হলেও তা মানার সুযোগ ও সামর্থ্য কম দরিদ্র এসব মানুষের। ফলে আসছে শীতে ঠাণ্ডাজনিত নানা সমস্যার পাশাপাশি করোনার ঝুঁকিও বেশি তাদের মধ্যে।
করোনাভাইরাসের প্রকোপ শুরু হওয়ার পর ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরীর বেশ কয়েকটি এলাকার গৃহহীন মানুষদের ওপর তিনটি জরিপ চালায় সাজেদা ফাউন্ডেশন। চলতি বছরের এপ্রিল ও জুনে দুই নগরীর ছয় হাজার গৃহহীন পরিবারের ওপর ওই জরিপ চালায় বেসরকারি সংস্থাটি। এর মধ্যে অনানুষ্ঠানিক বস্তিতে থাকে ৬৮ শতাংশ, ফুটপাতে থাকে ২৩ দশমিক ৩ শতাংশ এবং ৮ দশমিক ৮ শতাংশ ভাসমান মানুষ। ছিন্নমূল এসব মানুষের মধ্যে ৮৬ শতাংশ করোনাকালে জ্বরে ভুগেছে। কাশি ছিল ৭৮ শতাংশের। এছাড়া ৫৬ শতাংশের গলাব্যথা, ৩৪ শতাংশের শ্বাসকষ্ট, ৪৮ শতাংশের হাঁচি এবং ১৬ শতাংশের রক্তস্বল্পতা ছিল। শীতকালে এসব অসুস্থতা তাদের মধ্যে বেশি দেখা যায় বলে জানান ছিন্নমূল মানুষের উন্নয়নে সাজেদা ফাউন্ডেশন পরিচালিত প্রকল্প ‘আমরাও মানুষ’-এর সমন্বয়ক এমএ ফারুখ। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, শীতের সময় খোলা আকাশের নিচে থাকাটাই গৃহহীনদের সবচেয়ে বড় ঝুঁকি। এবার তারা শীত ও করোনার দ্বিমুখী ঝুঁকিতে পড়ছে।
দেশে গৃহহীন মানুষদের সঠিক পরিসংখ্যান নেই। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর বস্তিশুমারি ও ভাসমান লোকগণনা-২০১৪-এর তথ্য অনুযায়ী, দেশে ১৬ হাজার ৬২১ জন ভাসমান (গৃহহীন) লোক গণনা করা হয়েছে। ১৯৯৭ সালে ৩২ হাজার গৃহহীন লোকগণনা হয়েছিল বলে জানায় প্রতিষ্ঠানটি। তবে বাস্তবে এ সংখ্যা অনেক বেশি বলে জানিয়েছে সাজেদা ফাউন্ডেশন। শুধু ঢাকায় গৃহহীন মানুষের সংখ্যাই দেড় লাখের ওপরে। এ সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। দেশের মোট গৃহহীন মানুষের অর্ধেকই ঢাকায় থাকছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো।
শীতে গৃহহীনদের ঝুঁকির মধ্যে থাকতে হয়। এর মধ্যে করোনার প্রাদুর্ভাব তাদের বাড়তি ঝুঁকিতে ফেলেছে। দ্বিতীয় পর্যায়ে করোনার সংক্রমণ বাড়লে তাদের ঝুঁকিটা বেশি হবে—এমনটি বলছিলেন সাজেদা ফাউন্ডেশনের উন্নয়ন কর্মসূচির জ্যেষ্ঠ পরিচালক মো. ফজলুল হক। ছিন্নমূল এসব মানুষের ক্ষেত্রে সামাজিক দূরত্ব মানা কোনোভাবেই সম্ভব না মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘তাদের সামাজিক দূরত্ব মানার কথা বলা হলো এক ধরনের উপহাস। যাদের ঘরই নেই, তারা সামাজিক দূরত্ব মানবে কী করে। রাস্তায় হাজারো মানুষের চলাচলের মধ্যে তাদের থাকতে হয়। একই সঙ্গে তাদের মধ্যে করোনাভাইরাস নিয়ে সচেতনতা কম। তাদের ধারণা, তাদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বেশি।’
সম্প্রতি আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর,বি) এবং সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) একটি গবেষণায় দেখিয়েছিল, ঢাকার বস্তি এলাকার ৭৪ শতাংশ মানুষের মধ্যে করোনার সংক্রমণ হলেও তাদের প্রতিরোধক্ষমতা বেশি। শুধু এ গবেষণার ওপর ভিত্তি করে শীতে গৃহহীন মানুষের ঝুঁকি বাড়বে না এমনটি বলতে নারাজ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও করোনা মোকাবেলায় জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম। স্বাভাবিকভাবেই গৃহহীনরা শীতকালীন করোনায় বাড়তি ঝুঁকিতে থাকবে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘যেহেতু শীত ও করোনা থেকে বাঁচতে তাদের ঘর নেই, তাই তারা শীতকালে করোনার ঝুঁকিতে বেশি থাকতে পারে। যদিও কয়েকদিন আগে আইসিডিডিআর,বি ও আইইডিসিআর জানিয়েছে, বস্তিতে ৭৪ শতাংশ মানুষের ইমিউনিটি (রোগ প্রতিরোধক্ষমতা) বেশি। তবে এ গবেষণা থেকে কোনোভাবেই বলা যাবে না গৃহহীন ও বস্তির মানুষের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বেশি। ওই গবেষণার অনেক ত্রুটি আছে।’
করোনার চেয়ে শীতই ছিন্নমূল মানুষের জন্য বড় ঝুঁকি বলে মনে করেন আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এএসএম আলমগীর।
তিনি বলেন, ‘গৃহহীন মানুষরা খোলামেলা জায়গায় থাকে বলে তাদের করোনার ঝুঁকিটা তেমন একটা নেই। তবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা তাদের পক্ষে প্রায় অসম্ভব। অন্যদের মতো তাদেরও ঝুঁকি রয়েছে। বিষয়টি ফেলে দেয়া যায় না।’