ডেস্ক রিপোর্ট : করোনাভাইরাসের কারণে ঝিমিয়ে পড়া পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের কাজ আগস্ট থেকে পুরোদমে শুরু হয়েছে। তবে মূল পদ্মা সেতুর দুই পাশের প্রায় ৭ কিলোমিটার উড়াল রেলপথ নির্মাণে দুটি অংশে কাজ বন্ধ রয়েছে।
আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী নির্ধারিত উচ্চতা বজায় না রেখে রেলের গার্ডার, পিলার স্থাপনের কারণে দুই পাশের ১৩ থেকে ১৫ এবং ২৬ থেকে ২৭ নম্বর পিলার এলাকায় সব ধরনের কাজ বন্ধ রয়েছে।
এসব ত্রুটি দ্রুত সমাধানে ইতোমধ্যে সরকারের সংশ্লিষ্ট সচিব, প্রকল্প পরিচালকসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা প্রকল্প এলাকা বেশ কয়েকবার পরিদর্শন করেছেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে বৃহস্পতিবার রেলপথমন্ত্রী, পরিকল্পনামন্ত্রী, সচিব, প্রকল্প পরিচালকসহ সংশ্লিষ্টরা ত্রুটিপূর্ণ এলাকাসহ বাস্তবায়িত প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করেছেন।
এ সময় পদ্মা সেতু ও পদ্মা সেতু রেল সংযোগ নির্মাণের কাজে নিয়োজিত সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, প্রকল্প পরিচালক, ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন।
এদিন প্রকল্প পরিদর্শনকালে রেলপথমন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজন জানান, পদ্মা সেতুর দুই পাশে রেল সংযোগ প্রকল্পের দুটি স্থানে কাজ বন্ধ রয়েছে। সমস্যাটি দ্রুত সমাধানের জন্য সংশ্লিষ্টরা বার বার সরেজমিন পরিদর্শন করছেন।
উল্লিখিত স্থানে ত্রুটি রয়েছে কিনা, তা বিশেষজ্ঞরা খতিয়ে দেখছেন। আমরা সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি, এ সমস্যা দ্রুততম সময়ের মধ্যেই সমাধান করা হবে। নতুবা একই দিন পদ্মা সেতু দিয়ে যান চলাচলের সঙ্গে ট্রেন পরিচালনা করা সম্ভব হবে না।
মন্ত্রী আরও বলেন, এটি যেহেতু ইঞ্জিনিয়ারিং সমস্যা, সেহেতু সমাধানে বিশেষজ্ঞরা দ্রুততার সঙ্গে কাজ করছেন। বিষয়টি সমাধানের জন্য সড়ক বিভাগ ও রেলওয়ের কাছে ডিজাইন চাওয়া হয়েছে। এরপর দু’টি ডিজাইন মিললে একটা সমাধানে আসা যাবে।
সেতুতে ওঠা-নামার বিষয়টি রেলওয়ের সঙ্গে সমন্বয় করতে হবে। পদ্মা সেতুর এ বিষয়টি পজিটিভভাবে দেখতে হবে। আমরা আশা করছি, পদ্মা সেতু দিয়ে যেদিন যান চলাচল করবে- সেই দিন ট্রেনও চালানো যাবে।
পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান, এখনও কাজ চলমান রয়েছে। চলমান অবস্থায় যে সমস্যার কথা বলা হচ্ছে তা দ্রুততম সময়ের মধ্যেই সমাধান করা সম্ভব। কারণ এখনও কাজ শেষ হয়নি।
মনে রাখতে হবে, এটি একটি জাতীয় প্রকল্প। জাতীয়ভাবে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। ত্রুটি শব্দের সঙ্গে আমরা একমত নই। ত্রুটি তখনই হবে, যখন চূড়ান্তভাবে পাওয়া যাবে। এটি প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে, কিছু সংশয় দেখা দিয়েছে। এত বড় প্রকল্পের পদে পদে সমস্যা হতে পারে। সেতু চালু হওয়ার আগেই এটি চিহ্নিত করা গেছে। এ ব্যাপারে উচ্চতর পর্যায়ে আলোচনা হবে।
এদিকে পদ্মা সেতুর প্রকল্প পরিচালক (পিডি) শফিকুল ইসলাম জানান, উল্লিখিত বিষয়টি (ত্রুটি) তুলে ধরে রেলপথ মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছি। আলোচনা চলছে। আশা করি এ সমস্যা থাকবে না। পদ্মা সেতু রেল
প্রকল্পের মাওয়া কনস্ট্রাকশনের প্রজেক্ট ম্যানেজার (১-২) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আহমেদ জামিউল ইসলাম বলেন, বিষয়টি দ্রুত সমাধানে প্র্যাকটিক্যাল সলিউশনের দিকে যাওয়া হচ্ছে। সম্মিলিতভাবে সমস্যা সমাধান করে উল্লিখিত স্থানে দ্রুত সময়ের মধ্যে কাজ শুরু করতে চান তারা।
এদিকে বৃহস্পতিবার দুপুরে মাদারীপুর জেলার শিবচরে পদ্মা সেতুর রেলসংযোগ প্রকল্পে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের পুনর্বাসন সুবিধবার চেক বিতরণ করেন রেলপথমন্ত্রী। তিনি জানান, পদ্মা সেতুর এ রেলসংযোগ ও সড়ক পথের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি অত্যাধুনিক রেলস্টেশন হবে ফরিদপুরের ভাঙ্গায়।
এর মধ্য দিয়ে এ এলাকার মানুষের আর্থ-সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তন হবে। পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পে ক্ষতিগ্রস্ত ৩৯৮৯ জনকে ১০৭ কোটি টাকা পুনর্বাসন সুবিধা হিসেবে প্রদান করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ রেলওয়ের পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পে (পিবিআরএলপি) ক্ষতিগ্রস্ত ৭৭০৫ জনের মধ্যে ৩৯৮৯ জনকে পুনর্বাসন কার্যক্রমের আওতায় ইতোমধ্যে অতিরিক্ত অনুদান হিসাবে ১০৭ কোটি ৪১ লাখ ৪ হাজার টাকা প্রদান করা হয়েছে। বাকি ক্ষতিগ্রস্তদের বিষয়টিও প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
অনুষ্ঠানে মন্ত্রী মাদারীপুরে ক্ষতিগ্রস্ত ২৮ জন ব্যক্তির মাঝে ১ কোটি ১২ লাখ টাকার পুনর্বাসন সুবিধার চেক প্রদান করেন। মাদারীপুর জেলায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ২৩৪৯ জনের মধ্যে ১৩৯৪ জনকে এ পর্যন্ত ৩৬ কোটি ৪৩ লাখ ৪৬ হাজার টাকার পুনর্বাসন সুবিধার চেক প্রদান করা হয়েছে।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. সেলিম রেজা, বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. শামছুজ্জামান, প্রকল্প পরিচালক ও অতিরিক্ত সচিব প্রকৌশলী গোলাম ফখরুদ্দিন আহমেদ চৌধুরী, সিএসসির প্রধান সমন্বয়ক মেজর জেনারেল এফএম জাহিদ হোসেন, ডরপ চেয়ারম্যান মো. আজহার আলী তালুকদার, মাদারীপুর জেলা প্রশাসক ড. রহিমা খাতুন, মাদারীপুর পুলিশ সুপার মো. মাহবুব হাসান, শিবচর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি (ভারপ্রাপ্ত) আবদুল লতিফ মোল্লা, সাধারণ সম্পাদক ডা. মো. সেলিম।
এদিকে সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, পদ্মা সেতু মাওয়া এলাকায় রেলওয়ের ১৩, ১৪ ও ১৫ নং পিলার এলাকায় সব ধরনের কাজ বন্ধ রাখা হয়েছে।
১৩ ও ১৪ নং পিলারটি ঢেকে রাখা হয়েছে। একই অবস্থা জাজিরা প্রান্তেও সেখানে পদ্মা সেতু থেকে নামার পথে রেলওয়ে পিলার নির্মাণে ত্রুটি থাকায় ২৪, ২৫ ও ২৬ নং পিলার এলাকায় কাজ বন্ধ রয়েছে। ২৪ ও ২৫ নং পিলারের কাজ সম্পন্ন হলেও ২৫ নম্বর পিলারের কাজ শেষ হয়নি।
নিচে ৬টি করে পাইল তৈরি করা অবস্থায় পড়ে আছে। উভয় পান্তে থাকা সমস্যাকবলিত স্থানগুলো পরিদর্শন করেছেন দুই মন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে পদ্মা সেতু যতটুকু হয়েছে- পুরোটা জুড়ে রেললাইন স্থাপনের অংশটুকুও সম্পন্ন করা হয়েছে। পদ্মা সেতুর প্রায় তিন কিলোমিটার সরেজমিনে দেখা গেছে, মূল সেতুর নিচে অর্র্থাৎ গার্ডারের নিচে রেললাইন স্থাপনের সবকিছু ঠিকঠাক করে রাখা হয়েছে।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, সেতুর দুই পাশে প্রায় ৭ কিলোমিটার রেলপথ উড়াল লাইন হচ্ছে। পদ্মা সেতু পাইল-গার্ডার নির্মাণ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই নিচের অংশে রেললাইন স্থাপন করা হবে। পয়েন্টসহ সবকিছু পদ্মা সেতু কর্র্তৃপক্ষই করে দিচ্ছে, রেল শুধু সেখানে লাইন স্থাপন করবে।
এদিকে রেলপথ মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী সঠিক উচ্চতা বজায় রেখেই গার্ডার স্থাপন করে পদ্মা সেতুতে রেলসংযোগ স্থাপনের জন্য রেলপথ মন্ত্রণালয়কে সুপারিশ করেছে সেতু মন্ত্রণালয়।
সেতু মন্ত্রণালয়ের মতামত দেয়া ডিজাইন অনুযায়ী রেল রিংক প্রকল্পের কাজ করার পরিকল্পনা নিয়েছে রেলপথ মন্ত্রণালয়। সোমবার সেতু মন্ত্রণালয় তাদের দেয়া তিন বিকল্প ডিজাইন ও সমস্যা সমাধানের পথ নির্ণয় করে দেয়া ব্যাখ্যাসহ মতামত রেলপথ মন্ত্রণালয়ে পাঠায়।
মন্ত্রণালয় তা যাচাই-বাছাই করে কোন পদ্ধতিতে অতি দ্রুত সমাধান করা যাবে ও কম খরচে কীভাবে গার্ডার স্থাপন করে আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী উচ্চতা ঠিক করা যায় তার প্রক্রিয়া চালাচ্ছে।
জানা গেছে, সেতু মন্ত্রণালয়ে পদ্মা রেল সেতু নির্মাণের কাজে নিয়োজিত সেনাবাহিনীর একটি টিম ও পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পের পরিচালক সেতু প্রকল্পের পরিচালকের সঙ্গে তিনটি ডিজাইন নিয়ে কীভাবে সমাধান করা যায় তা আলোচনা করেন। তিনটি ডিজাইন প্রণয়নে কাজ করেন বিখ্যাত ডিজাইনার শামীম জেড বসুনিয়ার নেতৃত্বে পরিচালিত টিম।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় শামীম জেড বসুনিয়া বলেন, পদ্মা সেতু আমাদের অহংকার। এখানে রেলপথ মন্ত্রণালয় আগে থেকেই সেতু নির্মাণ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ বা সমন্বয় করে গার্ডার তৈরি না করত তাহলে বর্তমান অবস্থায় পড়তে হতো না। তবে আমরা এটিকে দ্রুত সমাধানের দিকে যাচ্ছি। পদ্মা সেতু কিছু করতে পারবে না। এখানে সমস্যা সমাধানে রেলওয়েকেই করতে হবে।
এটি বিশাল কোনো সমস্যা নয়। আমরা এ সমস্যার সমাধান করতে তিনটি পথ বাতলে দিয়েছি। প্রথম পথে যে ডিজাইন দেয়া হয়েছে তাতে অত্যন্ত কম সময়ে তার সমাধান করা হবে। দ্বিতীয় ডিজাইন অনুযায়ী অনেক বেশি ব্যয় হবে ফলে প্রকল্পের কাজে নতুন বেশ কিছু সমস্যার সৃষ্টি হবে ও অনেক কাজ করতে হবে।
এছাড়া তৃতীয় পদ্ধতিতে ডিজাইন তুলনামূলকভাবে কম পরিবর্তন করলেও বেশ কিছু গার্ডার নির্মাণ করতে হবে। প্রশস্ততা ও উচ্চতা বাড়াতেও বিকল্প তিনটি পথ দেয়া হয়েছে। তবে অবশ্যই আন্তর্জাতিক মানের উচ্চতা ঠিক রেখেই সব কাজ করতে হবে।
কম সময়ে পদ্মা সেতুর রেল লিংক সংযোগের কাজ শেষ করতে চাইলে তিনটি ডিজাইনের যেটি পছন্দ হয় সেটিই করবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
রেলওয়ে সংশ্লিষ্টরা জানান, নতুন ডিজাইন অনুযায়ী রেলের তৈরি পুরনো গার্ডার সরিয়ে ফেলতে হবে। সড়কের সঙ্গে রেললাইনের হেডরুম উচ্চতা কমপক্ষে ৫ দশমিক ৭ মিটার থাকতে হয় বর্তমানে হেডরুম উচ্চতা রয়েছে ৪ দশমিক ৮ মিটার।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশ অনুযায়ী বিকল্প পথে কীভাবে কম সময়ে ও কম খরচে রি-ডিজাইন করে চলমান উচ্চতার সমস্যা নিরূপণ করা যায় সেজন্য বিকল্প তিনটি রি-ডিজাইন তৈরি করে রেলপথ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। ডিজাইন অনুযায়ী যে কোনো একটি গ্রহণ করে রেলপথ মন্ত্রণালয় চলমান সমস্যার সমাধানে কাজ করবে।
এদিকে পদ্মা সেতু সূত্র জানায়, সেতুর মাওয়া ও জাজিরা প্রান্তে এই সমস্যা দেখা দিয়েছে। দুই পাশের কিছু অংশে রেললাইন ওপর দিয়ে গেছে। এসব জায়গায় হেডরুম যে উচ্চতায় দেয়ার কথা, সেটি দেয়নি রেলওয়ে। এ অবস্থায় সেতুতে ওঠানামা করতে পারবে না বড় ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যানগুলো। হোরাইজন্টাল ও ভার্টিক্যাল দুটো দিকেই রেলওয়ের কাজে আপত্তি রয়েছে।
দেশের সড়কপথের হেডরুম স্ট্যান্ডার্ড হচ্ছে হোরাইজন্টাল ১৫ মিটার, ভার্টিক্যাল ৫ দশমিক ৭ মিটার, যা এই সেতু নির্মাণের ক্ষেত্রে মানা হয়নি। এ অবস্থায় সেতুতে ট্রাক কাভার্ড ভ্যান ও দোতলা বাস যেতে পারবে না।
পদ্মা রেল লিংক প্রকল্পটির ঠিকাদার হচ্ছে চায়না রেলওয়ে গ্রুপ লিমিটেড। প্রকল্পের ব্যয় ৩৯ হাজার ২৪৬ কোটি টাকা। এর আওতায় মূল ও শাখা লাইনসহ ২১৫ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণ করা হবে। এর মধ্যে প্রায় ২২ কিলোমিটার হবে উড়ালপথে।
জমি অধিগ্রহণ, বেতন-ভাতা, ভ্যাটসহ আনুষঙ্গিক খরচ বাদে শুধু রেললাইন নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৭ হাজার ৯১ কোটি টাকা। প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় দাঁড়ায় ৭৯ দশমিক ৪১ কোটি টাকা। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত কাগজে-কলমে অগ্রগতি ২২ শতাংশ। তবে এর বেশির ভাগই জমি অধিগ্রহণসহ প্রস্তুতিমূলক কাজ বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।যুগান্তর