রাশিদ রিয়াজ : গত মাসে ব্লুমবার্গের বিশ্লেষকরা জানান সুদের হার হ্রাসে ফেডারেল রিজার্ভ যে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে তাতে ইউরো ও ইয়ানের বিপরীতে ডলার তার সক্ষমতা আরো হারাবে। কোভিড মন্দায় ট্রাম্প প্রশাসন যে অর্থনৈতিক সহায়তা প্যাকেজ দিতে শুরু করে তাতে ডলারের অবমূল্যায়ন আরো বাড়তে থাকে। গত ২৭ মাসে তা সর্বনিম্নে পর্যায়ে পৌঁছেছে। আগামী বছরে ইউরোর বিপরীতে ডলারের আরো ৩৬ শতাংশ অবমূল্যায়ন ঘটবে বলে এ.জি. বিসেট’এর প্রধান বিনিয়োগ কর্মকর্তা উলফ লিনধাল সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন। স্পুটনিক
রয়টার্সকে মুদ্রা ব্যবস্থাপনায় এই বিশেষজ্ঞ বলেন ডলারের বর্তমান মূল্যহ্রাস বড় ধরনের পতনেরই এক অশনিসংকেত। এবং বিষয়টি মার্কিন শেয়ার ও বন্ড বাজারে বিনিয়োগকারীদের জন্যে খুবই বেদনদায়ক পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে। গত ১৫ বছরে অন্য মুদ্রার সঙ্গে মার্কিন ডলারের দর পতন ও উলম্ফনের তুলনা করে তিনি বলেন বর্তমান পরিস্থিতিতে আসলেই ডলারের ওপর থেকে সরে যাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করেছে। কারণ এবছরের শুরু থেকে ডলার অন্যান্য শীর্ষ মুদ্রার তুলনায় ১১ শতাংশ অবমূল্যায়িত হয়েছে যা গত এক দশকে সর্বোচ্চ। জানুয়ারিতে ইউরোর সঙ্গে ডলারের ব্যবধান ছিল ১.১২ ডলার যা গত বৃহস্পতিবার বেড়ে ১.১৮ ডলারে দাঁড়িয়েছে।
বিভিন্ন দেশের মুদ্রা ব্যবস্থাপক ও অর্থনীতিবিদ এমনকি গোল্ডম্যান স্যাক্স, ইউবিএস, সোসাইটি জেনারেল বলছে কোভিড মন্দায় মার্কিন অর্থনীতির দুর্বল পারফরম্যান্স, দেশটিতে সুদের হার হ্রাস, কোভিড সহায়তা হিসেবে ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলারে প্যাকেজ সহায়তা, বাজেট ঘাটতি পূরণে গত অক্টোবর থেকে জুলাই পর্যন্ত ২.৮ ট্রিলিয়ন ডলার সরবরাহ, এসব কিছুই মার্কিন মুদ্রাটির সক্ষমতা হ্রাস করেছে। গোল্ডম্যান বলছে আগামী ৩ বছর ডলারের এ অবমূল্যায়ন অব্যাহত থাকবে এবং ২০২৩ সালে ইউরোর তুলনায় ডলার ২৮ শতাংশ অবমূল্যায়িত হয়ে ১.৩ ডলারে স্থির হবে। টিডি সিকিউরিটিস এধরনের পূর্বাভাসের সঙ্গে একমত প্রকাশ করে বলেছে অন্যান্য মুদ্রার বিপরীতে ডলার অন্তত ১০ শতাংশ বেশি মূল্যায়িত হয়ে আছে।
পর্যবেক্ষকদের অনুমান ডলারের এধরনের পতন বিশ^মুদ্রা মজুদ হিসেবে ডলারের যে কৌলিন্য রয়েছে তা ম্লান করবে। টরোসো ইনভেস্টমেন্ট/এটাক রোটেশন ফান্ডের পোর্টফোলিও ম্যানেজার মাইকেল গাইদ বলছেন এ নিয়ে অনেক জল্পনা-কল্পনা চলছে। তবে ব্লাকরক ইনকরপোরেশনের প্রধান বিনিয়োগ কর্মকর্তা রিক রেইডার রয়টার্সকে বলেন ডলারের এ পতন এতটা নাটকীয় হবে না। কারণ অন্যান্য দেশ লেনদেনের জন্যে ডলারের ওপর এখনো যথেষ্ট মাত্রায় নির্ভরশীল। গত মাসে আইএমএফ’এর সাবেক ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর ঝু মিন বলেন ভবিষ্যতে ডলার আরো ৩০ শতাংশ অবমূল্যায়িত হবে কি না তারচেয়ে ভয়ের কারণ হচ্ছে হঠাৎ করে এর ব্যাপক দরপতন ঘটলে আস্থা বিনষ্ট হবে এবং বাজার এর ধকল সহ্য করতে পারবে না।
ইতিমধ্যে অনেক দেশ ডলারের বিকল্প হিসেবে ইউরোর দিকে নজর রাখছে। বাণিজ্যিক লেনদেনে ডলার যুক্তরাষ্ট্রকে সবধরনের পণ্য তা শিল্প কিংবা কৃষি হোক বা বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ হোক, এমনকি সব তেল রফতানিকারক দেশগুলো ডলারকে আস্থার প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করে আসছে। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীন, ভারত, রাশিয়া, ইরান ও তুরস্ক ডলারের পরিবর্তে নিজস্ব মুদ্রায় বাণিজ্যিক লেনদেন বৃদ্ধি করছে। নিক্কেই এশিয় রিভিউ বিশ্লেষণ বলছে এবছরের প্রথম তিনি মাসে রাশিয়া ও চীনের মধ্যে সমস্ত লেনদেনের অর্ধেকেরও কম ডলারে হয়। বাকি লেনদেন হয় ৩০ শতাংশ ইউরো ও ২৪ শতাংশ রুবলে। এই বছরের শুরুতেই রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ আশ^াস দেন তার দেশ ক্রমশ ডলারের লেনদেন কমিয়ে আনবে। বিভিন্ন দেশের ওপর একতরফা মার্কিন নিষেধাজ্ঞা ও অবরোধ আরোপ ডলারের প্রতি বিমুখ হওয়ার মূল কারণ। গত এক দশক ধরে মস্কো মার্কিন ট্রেজারি থেকে ধাপে ধাপে ডলারের বিনিয়োগ হ্রাস করে এবং তা স্বর্ণ, ইউয়ান, ইউরো বা অন্যান্য মুদ্রাক্রয়ে ব্যয় করে। রুশ শীর্ষ জালানি কোম্পানি রসনেফট রফতানি আয়ে ডলারের বিপরীতে ইউরোকে বেছে নেয়। ইরান জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের সদস্য দেশগুলোকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ডলারকে চাপে ফেলার জন্যে বিকল্প মুদ্রায় লেনদেনের প্রস্তাব দিয়েছে।