ডেস্ক রিপোর্ট : স্বল্প কয়েকদিনের ভিসা নিয়ে খেলার জন্য কেউ এসেছিলেন বাংলাদেশে। কেউ আবার এসেছিলেন লেখাপড়া করতে। কেউ বা ট্যুরিস্ট ভিসায়। অথচ নির্ধারিত কাজ না করে উল্টো ভয়ঙ্কর প্রতারণাসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে বাংলাদেশে অবৈধভাবে বসবাসরত এক শ্রেণির বিদেশি নাগরিক। স্বদেশি ও স্থানীয় মিলে তারা গড়ে তুলছে অপরাধের আস্তানা। সংঘবদ্ধ চক্র হয়ে টার্গেট করছে বাঙালি সহজ-সরল বিত্তশালী মানুষের। এরপর ফেসবুকসহ নানা মাধ্যমে সুসম্পর্ক গড়ে প্রতারণার মাধ্যমে হাতিয়ে নিচ্ছে মোটা অঙ্কের টাকা। এমন একটি চক্রের চার সদস্যকে (নাইজেরিয়া ও ঘানার নাগরিক) বুধবার গ্রেফতার করেছে বাংলাদেশ পুলিশের ‘ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট (সিআইডি)’।
সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলেছেন, বিদেশি নাগরিকরা ফেসবুক, ই-মেইল, হোয়াটস-অ্যাপ ও মেসেঞ্জারসহ নানা ধরনের অনলাইন মাধ্যমে বিভিন্নভাবে লোভনীয় সুযোগ সুবিধার কথা বলে প্রথমে ভুক্তভোগীর সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করে। একপর্যায়ে বিদেশি মূল্যবান গিফট বা ডলার পাঠানোর ইচ্ছা ব্যক্ত করে প্রতারকচক্র। কেউ তাদের লোভনীয় কথা বিশ^াস করে যোগাযোগ শুরু করলে উপহার পাঠানোর কিছু ছবি পাঠিয়ে বিশ^াসযোগ্যতা তৈরি করে। এক পর্যায়ে প্রতারকচক্রের বাংলাদেশি এক সদস্য নিজেকে কাস্টমস কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে গিফট আসার বিষয়টি জানায়। এভাবে পর্যায়ক্রমে অপরিশোধিত শুল্ক পরিশোধের কথা বলে কখনও ভয়ভীতি দেখিয়ে হাতিয়ে নেওয়া হয় লাখ লাখ টাকা।
বাংলাদেশে অবৈধ বসবাস করে নানা সংঘবদ্ধ অপরাধে জড়িয়ে পড়া বহু নাগরিককে এ পর্যন্ত গ্রেফতার করে এলিটফোর্স র্যাব, সিআইডি ও ডিবি পুলিশ। গত এক বছরে বিভিন্ন অপরাধে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে শতাধিক বিদেশি নাগরিককে গ্রেফতার করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষকারী বাহিনী। এ ছাড়া বর্তমানে ৫ শতাধিক বিদেশি নাগরিক বাংলাদেশের বিভিন্ন কারাগারে রয়েছে। যাদের মধ্যে আফ্রিকানদের সংখ্যাই সাড়ে ৪শ-এরও বেশি।
সিআইডির অতিরিক্ত ডিআইজি শেখ মো. রেজাউল হায়দার বলেন, বিদেশিরা এ দেশে বৈধভাবে আসলেও ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার পরেই মূলত তারা অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। শুধু বাংলাদেশ নয়, এসব আফ্রিকানরা ভারত, সিঙ্গাপুর ও দুবাইসহ বিভিন্ন দেশে মার্চেন্ডাইজিংসহ বিভিন্ন ব্যবসা করতে এসে অপরাধ করে চলেছে। তাদের অপরাধের ধরন এমন যে, কেউ ভিক্টিম হওয়া ছাড়া জানার উপায় নেই। বাংলাদেশি নাগরিকদের অনেকের বিশ^াস এমন যে বিদেশিরা প্রতারণা করতে পারে না। যার কারণে কেউ তাদের দ্বারা প্রতারণার শিকার হয়ে আইনের আশ্রয় নিলেই কেবল জানা যায়।
তিনি আরও বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একার পক্ষে তাদের অপরাধ দমন করা সম্ভব নয়। গণমাধ্যমের সচেতনতার পাশাপাশি যে সব বাড়িঅলা বা দেশীয় নাগরিক তাদেরকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেন তাদের সতর্ক ও সচেতন হতে হবে। বিদেশিদের বাসা ভাড়া দেওয়ার সময় বৈধ কাগজপত্র যাচাই করা গেলে অবৈধভাবে এ দেশে অবস্থান রোধ করা সম্ভব হবে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশি নাগরিকরা প্রতিবছর অবৈধভাবে প্রায় ২৬ হাজার কোটি টাকা বিদেশে নিয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন সূত্র থেকে তাদের সংগ্রহ করা তথ্যে দেখা যায়, বাংলাদেশে বৈধ এবং অবৈধভাবে কর্মরত বিদেশি নাগরিকদের সংখ্যা কমপক্ষে আড়াই লাখ। এদের অনেকে কর ফাঁকি দিচ্ছে আবার অনেকে অবৈধভাবে বাংলাদেশে কাজ করে কোনো কর না দিয়ে টাকা নিয়ে যাচ্ছে। এর ফলে প্রতিবছর বাংলাদেশ সরকারের প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হচ্ছে। বাংলাদেশে বৈধ-অবৈধভাবে আসা নাগরিকদের মধ্যে ভারত, পাকিস্তান, মিয়ানমার ও আফ্রিকানদের সংখ্যাই বেশি।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) গুলশান বিভাগের উপকমিশনার মো. মশিউর রহমান বলেন, ব্যাংকের বিভিন্ন কার্ড জালিয়াতি ছাড়াও মাদক, জাল মুদ্রা, উপহার পাঠানোর নামে প্রতারণা ও মানবপাচারসহ আরও অনেক অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে এসব বিদেশি নাগরিকরা। সহজে বাসা ও অফিস ভাড়া নেওয়ার জন্য এদেশের এক শ্রেণির অসাধু নাগরিকের সঙ্গে সখ্য করে গড়ে তোলা হয় পেশাদার অপরাধীচক্র। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকসহ বিভিন্ন অনলাইন মাধ্যম ব্যবহার করে তারা এ প্রতারণার ফাঁদ পাতে। পরবর্তী সময়ে নানা ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে টার্গেট করে সেই ফাঁদে ফেলে হাতিয়ে নেওয়া হয় কোটি কোটি টাকা।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার উপপরিচালক মেজর হুসাইন রইসুল আজম মনি বলেন, র্যাব প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত বিভিন্ন অপরাধে জড়িত ১৮৯ জন বিদেশি নাগরিককে গ্রেফতার করেছে। এর মধ্যে ২০১৫ সাল থেকে এ পর্যন্ত গ্রেফতার করা হয়েছে ৮৯ জনকে। এই বিদেশিরা বেশিরভাগই প্রতারণাসহ নানা গুরুতর অপরাধে জড়িত। এ ধরনের বিদেশি অপরাধী চক্রের বিরুদ্ধে র্যাব সবসময় সজাগ দৃষ্টি রেখে কাজ করে যাচ্ছে।
র্যাব ও সিআইডির দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলেছেন, পড়াশোনা, ভ্রমণ বা ব্যবসার উদ্দেশে স্বল্প কিছুদিনের ভিসা নিয়ে এ দেশে আসলেও অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তারা গড়ে তুলছে অপরাধীচক্র। বিদেশিদের মধ্যে অপরাধ সংশ্লিষ্টতা সবচেয়ে বেশি নাইজেরিয় নাগরিকদের। বাংলাদেশি এক শ্রেণির অসাধু নাগরিকদের সহযোগিতায় তারা গড়ে বড় বড় অপরাধীচক্র। এসব চক্রের সদস্যরা প্রতারণা, ব্যাংকের অর্থ আত্মসাৎ, মাদক ও মানবপাচার থেকে শুরু করে অনেক নৃশংস অপরাধও ঘটিয়ে থাকে।
সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলেছেন, বাংলাদেশে কি পরিমাণ বিদেশি নাগরিক বসবাস করে তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। অনেকে বৈধভাবে এ দেশে আসলেও বৈধতার মেয়াদ ফুরিয়ে গেলে ভিসা নবায়ন না করেই অবৈধভাবে থাকতে শুরু করেন। এসব অবৈধ নাগরিকরাই পরবর্তী সময়ে জড়িয়ে পড়ছে নানা অপরাধে। এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে গ্রেফতার বিদেশি নাগরিকদের বিরুদ্ধে মামলার তদন্তকালেও পড়তে হয় নানা জটিলতায়। এসব অপরাধীদের অধিকাংশের কাছেই কোনো ধরনের কাগজপত্র পাওয়া যায় না। একইভাবে এ দেশে প্রবেশের পর থেকে পরবর্তী সময় পর্যন্ত তাদের অবস্থান ও কার্যক্রম যথাযথভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয় না। এ ছাড়া বেশিরভাগই তাদের নিজ দেশে কোনো না কোনো অপরাধ করে এদেশে আত্মগোপন করায় সে দেশের সরকার সংশ্লিষ্টরাও তাদের ফিরিয়ে নিতে তেমন আগ্রহ দেখায় না। অনেক আগে থেকে পড়াশোনা, ভ্রমণ বা ব্যবসার উদ্দেশে এদেশে বিদেশিরা আসলেও ২০১০ সাল থেকে তাদের মধ্যে বেশি মাত্রায় অপরাধে জড়িয়ে পড়ার প্রবণতা দেখা গেছে।
গণমাধ্যমের তথ্যে দেখা যায়, ৬ আগস্ট রাজধানীর কাফরুল ও পল্লবী থানা এলাকায় অভিযান চালিয়ে চার নাইজেরিয়ানসহ সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্রের পাঁচ সদস্যকে গ্রেফতার করে র্যাব-৪। ২১ জুলাই ফেসবুকে প্রতারণার ফাঁদ পেতে কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে পল্লবীর একটি বাসা থেকে বাংলাদেশি ভুয়া নারী কাস্টমস কর্মকর্তা ও ১২ নাইজেরিয়ান নাগরিককে গ্রেফতার করে সিআইডি। জুনে উপহার পাঠানোর নামে প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে ১৮ নাইজেরিয়ান ও দুই বাংলাদেশিসহ ২০ জনকে গ্রেফতার করে সিআইডি।সময়ের আলো