ডেস্ক রিপোর্ট : স্বল্প জায়গায় শিশুদের গাদাগাদি জীবন। অনেক শিশু থাকলেও নেই তাদের ঘুমানোর পর্যাপ্ত শয্যা। ঘুমানোর একটু জায়গা পেতে শুরু হয় টানাহেঁচড়া, ধাক্কাধাক্কি—একপর্যায়ে মারামারি। শাসনের নামে অযথাই স্যারদের চড়-লাথি-ঘুষি। লেখাপড়ার নেই খবর। সরকারি বরাদ্দ থাকলেও দেওয়া হয় না উন্নতমানের খাবার। অভিভাবকরা খাবার নিয়ে এলেও তা শিশুদের কাছে পৌঁছে না। নেই সংশোধন কিংবা কাউন্সিলিংয়ে দক্ষ কর্মকর্তা। শিশুরা অসুস্থ হয়ে দিনের পর দিন ভুগলেও দেওয়া হয় না সুচিকিৎসা। রয়েছে জনবলসংকটও। বয়সে বড় শিশুদের দিয়ে অন্যদের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন অসাধু কর্মকর্তারা। তাঁদের কথা না শুনলে নেমে আসে নির্যাতনের খড়্গ। বিভিন্ন অপরাধে বন্দি থাকা ১৮ বছরের কম বয়সী শিশুদের সংশোধনের জন্য পরিচালিত তিনটি শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের বিরুদ্ধে মিলেছে এমন বিস্তর অনিয়মের অভিযোগ। বন্দি ও অভিভাবকসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, বছরের পর বছর চলছে এমন অব্যবস্থাপনা। কালের কণ্ঠ
গত বৃহস্পতিবার যশোরের শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে তিন শিশুকে পিটিয়ে হত্যার পর অনিয়মের বিষয়গুলো সামনে উঠে আসে। এর আগেও এসব কেন্দ্রে ঘটেছে অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর ঘটনা। এই পরিস্থিতিতে প্রকৃত অর্থে সংশোধনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে গাজীপুরের কোনাবাড়ীর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রটি (বালিকা) পরিবর্তনের উদ্যোগ নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। অন্য দুই কেন্দ্রের অভিযোগও খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
অপরাধ বিশেষজ্ঞ ও মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, ভিন্ন বিষয়ে লেখাপড়া করে উন্নত প্রশিক্ষণ ছাড়াই যাঁরা এসব কেন্দ্রের দায়িত্ব পালন করছেন তাঁরা শিশুর মনস্তত্ত্ব, অপরাধ সংশোধন, কাউন্সিলিংসহ অনেক বিষয়ে অদক্ষ। ফলে তাঁরা অন্য অপরাধীর মতোই শিশুদের নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে। উন্নত প্রশিক্ষিত দক্ষ প্রয়োজনীয় কর্মীদের মাধ্যমে কেন্দ্রগুলো পরিচালিত হলে সংশোধনের উদ্দেশ্য সফল হবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের চেয়ারম্যান আব্দুল কাদের মিয়া বলেন, কেন্দ্রগুলোতে আসনসংখ্যা এবং লোকবল কম। এ ছাড়া যেসব সমাজসেবা কর্মকর্তা সেখানে দায়িত্ব পালন করেন তাঁরা অন্য বিষয়ে লেখাপড়া করে এই দায়িত্ব পালন করছেন। এখানে সমাজকর্মী, মনস্তত্ত্বসহ সংশ্লিষ্ট বিষয়ের ওপর প্রশিক্ষিত কর্মী প্রয়োজন।
গাজীপুরের টঙ্গীর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে বন্দি থাকা শিশুদের শুধু একবার দূর থেকে দেখতে প্রতিদিন ভোরে চেরাগ আলী এলাকার সফিউদ্দিন সরকার বিজনেস কমপ্লেক্সের উত্তর পাশে ভিড় করেন অনেক অভিভাবক। তাঁদের ছেলেরা ডরমিটরির জানালায় এসে কথা বলে মা-বাবার সঙ্গে। রাজধানীর গেণ্ডারিয়ার শাহনাজ আক্তার নামের এক অভিভাবক বলেন, ‘ছয় মাস ধরে কেন্দ্রে থাকা ছেলের কথা শুনে আমি সন্ধিহান। খাবারে তার অরুচি, মাছ-মাংস, ডিম-দুধ খেতে তার আবদার। এসব নাকি সেখানে চোখে দেখে না। বিছানা সমস্যার কারণে ঘুমাতে পারে না। বড়রা ছোটদের ওপর চালায় নির্যাতন। শাসনের নামে অযথাই স্যারদের চড়-লাথি-ঘুষি। প্রশিক্ষণ বলতে ইলেকট্রিশিয়ান, দর্জি, কাঠমিস্ত্রির কাজ।’
কয়েকজন অভিভাবক ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, একজনের মাথাপিছু এক বেলা খাবার, জ্বালানিসহ বরাদ্দ মাত্র ২৭ টাকা। নিয়মানুসারে ভাত, মাছ, মাংস, সবজি ও ডাল প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় থাকলেও যা তাদের পাতে দেওয়া হয়, তা নিতান্তই সামান্য। কেন্দ্রে ২০০ আসন থাকলেও গতকাল রবিবার টঙ্গী কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে ভর্তি ছিল ৫৪৯ জন। ঘুমানোর একটু জায়গা পেতে চলে মারামারি। স্টিলের খাট ভেঙে চলে হামলা—এই কারণে সব খাট সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। ঠাণ্ডায় বিছানা পেতে সর্দিজ্বরে ভোগে কিশোরেরা। গত বছর জ্বরে শুভ নামের এক কিশোরের মৃত্যু হয়েছে। ওই কেন্দ্রে মাসিক চিকিৎসাসেবা জনপ্রতি ১০০ টাকা থাকলেও কেন্দ্র থেকে কোনো নিবাসীকে ওষুধ সরবরাহ করা হয় না। চিকিৎসার একমাত্র ভরসা টঙ্গী সরকারি হাসপাতাল। এখানে ভর্তি হয় অনূর্ধ্ব ১৮ বছর বয়সীরা, তাদের অনেকেই মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থী। অথচ এখানে রয়েছে মাত্র পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়ার সুযোগ। কেন্দ্রের গুরুত্বপূর্ণ ২৪টি পদ দীর্ঘদিন ধরে শূন্য।
এ ব্যাপারে টঙ্গী কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রের তত্ত্বাবধায়ক এহিয়াতুজ্জামান বলেন, কিশোরদের খাবার সরকারি বরাদ্দের টাকা অনুযায়ী সরবরাহ করা হয়। তাদের ওপর কোনো ধরনের নির্যাতন করার অভিযোগ ঠিক নয়।
এদিকে গতকাল দুপুরে যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের সামনে গিয়ে উদ্বিগ্ন অভিভাবকদের অপেক্ষা করতে দেখা যায়। তিন নিবাসী নিহত হওয়ার পর অভিভাবকরা এসেছেন তাঁদের সন্তানদের একনজর দেখার জন্য। খুলনার দৌলতপুর থেকে আসা কবীর শেখ জানান, তাঁর ছেলে সোহাগ শেখ আড়াই বছর এই কেন্দ্রে আছে। ছেলে ফোন করে বলত, ‘আব্বা এখানে খাবারের সমস্যা।’ সোহাগের মা দুইবার আসত খাবার নিয়ে। খাওয়ার জন্য আর ডাক্তার দেখানোর জন্যও টাকা দিতে হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক অভিভাবক বলেন, ‘শিশুদের মারধর করলেও ভয়ে তারা এ কথা বলতে চায় না। আবার নির্যাতন হতে পারে, এটা ভেবে। টাকা দিলে এখানে সব মেলে, একদম বড় জেলখানার মতো। এখানে নেশার জিনিসও পাওয়া যায় টাকার বিনিময়ে।’
মানবাধিকারকর্মী রাইটস যশোরের নির্বাহী পরিচালক বিনয় কৃষ্ণ মল্লিক বলেন, এটা অবশ্যই শিশু অধিকারের লঙ্ঘন। শিশুদের নির্যাতন তো করাই যাবে না। বরং মোটিভেশন কাউন্সিলিংয়ের মাধ্যমে তাদের সংশোধন করতে হবে। সমাজসেবা অধিদপ্তর যশোরের উপপরিচালক অসিত কুমার সাহা বলেন, ‘খাবার কম দেওয়া, টাকা ছাড়া চিকিৎসা না হওয়া এবং কেন্দ্রে মাদক ব্যবহারের বিষয়টির বিন্দুমাত্র সত্যতা নেই।