শিরোনাম
◈ জুলাই অভ্যুত্থানের সেই ঐক্য কোথায়? ◈ ব্রিটিশদের ‘নাকানিচুবানি’ দিতে ইরানের এক দশকের ‘ছায়া যুদ্ধ’: যেভাবে চলছে যুক্তরাজ্যের ভেতরে গোপন তৎপরতা ◈ চট্টগ্রাম কাস্টমস কমিশনার জাকির হোসেন বরখাস্ত, আরও কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা ◈ এবার অঝোরে কাঁদলেন মিসাইল ম্যান কিম জং উন (ভিডিও) ◈ জুলাই নিয়ে ‘আপত্তিকর’ ফেসবুক পোস্ট: পুলিশের বিরুদ্ধে ছাত্রদের অবরোধ-বিক্ষোভ ◈ নতুন উচ্চতায় রেমিট্যান্স: ২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রবাসী আয়ের সর্বোচ্চ প্রবাহ ◈ ডলারের দরপতনে রেকর্ড, ১৯৭৩ সালের পর সবচেয়ে বড় পতনে বিশ্ববাজারে আস্থার সংকট ◈ “৭১-এর মুক্তিযোদ্ধাদের মতোই চব্বিশের যোদ্ধাদেরও জাতি ভুলবে না” — তারেক রহমান ◈ গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে ঐক্য বজায় রাখার আহ্বান খালেদা জিয়ার ◈ শ্রীলঙ্কার বিরু‌দ্ধে বুধবার  সি‌রি‌জের প্রথম ওয়ানডে ম‌্যা‌চে  মু‌খোমু‌খি  বাংলাদেশ

প্রকাশিত : ১৩ আগস্ট, ২০২০, ০৭:২৯ সকাল
আপডেট : ১৩ আগস্ট, ২০২০, ০৭:২৯ সকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

ডাঃ খোন্দকার মেহেদী আকরাম : রাশিয়ার ভ্যাকসিন কি কোভিড ভ্যাকসিন নাকি পলিটিক্যাল?

ডাঃ খোন্দকার মেহেদী আকরাম : চারদিকে একই খবর, রাশিয়া বিশ্বে সর্বপ্রথম করোনাভাইরাস ভ্যাকসিন উদ্ভাবন করে তা সর্বসাধারনের উপর প্রয়োগের অনুমতি দিয়েছে। অর্থাৎ ভ্যাকসিন দৌড়ে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি এবং চীনকে পেছনে ফেলে চ্যাম্পিয়নের স্থানটি দখল করে নিয়েছে রাশিয়া। আর এই সফলতার আনন্দে তারা তাদের কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনটির নাম রেখেছে স্পুটনিক-৫! রাশিয়াই বিশ্বে সর্প্রথম যারা যুক্তরাষ্ট্রকে পেছনে ফেলে মহাশূন্যে স্যাটেলাইট প্ররণ করেছিল, এবং এর নাম তারা রেখেছিল স্পুটনিক।

উদ্ভাবনে প্রথম হওয়া রাশিয়ানদের একটা চিরাচরিত ধারা। মূলত আমেরিকা এবং ব্রিটেনকে টেক্কা দিতে পারলেই তারা খুশি! তবে এটা কিন্তু মানতেই হবে যে স্যাটেলাইট স্পুটনিক এবং ভ্যাকসিন স্পুটনিক, নামে একরকম হলেও দুটো কিন্তু সম্পূর্ন ভিন্ন জিনিস। মনুষ্যবিহীন স্যাটেলাইট উৎক্ষেপনে দুর্ঘটনা ঘটলে, অথবা কক্ষপথ থেকে স্যাটেলাইটি কক্ষচ্যূত হয়ে ছিটকে পরলে প্রাণনাশের কোন সম্ভবনা নেই। কিন্তু অনীরাপদ বা অকার্যকর ভ্যাকসিন প্রয়োগের সাথে স্বাস্থ্যহানি বা জীবণনাশের সম্পর্ক রয়েছে। আর একারনেই ভ্যাকসিন উৎপাদন এবং প্রয়োগের ক্ষেত্রে সর্বদা অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করা হয়।

নবউদ্ভাবিত একটা ভ্যাকসিন কতটুকু নিরাপদ এবং কার্যকরী তা দেখার জন্য তিনটি ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল করা হয়। এর ভেতরে প্রথম ধাপের (ফেইজ-১) ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল করা হয় স্বল্পসংখ্যক (২৫-১০০ জন) সুস্থ্য মানুষের উপর। এই ধাপের ট্রায়ালে দেখা হয় প্রয়োগকৃত ভ্যাকসিনটি শরীরে কোনরূপ ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে কি না এবং কতটুকু ইমিউন রেসপন্স করে। দ্বিতিয় ধাপের (ফেইজ-২) ট্রায়াল করা হয় অপেক্ষাকৃত অধিক সংখ্যক (১০০-৫০০ জন) সুস্থ্য ভলান্টিয়ারের উপর। এই ধাপে নির্ধারণ করা হয় ভ্যাকসিনটির কার্যকরী ডোজ এবং তা শরীরে কতটুকু নিউট্রালাইজিং এন্টিবডি তৈরী করে এবং কতটুকু টি-সেল বা ইমিউন সেল রেসপন্স ঘটাতে পারে।

এই দুটো ধাপে সন্তোষজনক ফলাফল পাওয়া গেলে শুরু করা হয় শেষ বা তৃতীয় ধাপের (ফেইজ-৩) ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল। এই ধাপের ট্রায়ালটি করা হয় ১০-৩০ হাজার সুস্থ্য সবল মানুষের উপর। এই ট্রায়ালটি হতে হবে প্ল্যাসিবো-কন্ট্রোল্ড ডাবল-ব্লাইন্ড ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল, যেখানে ট্রায়ালে অংশগ্রহনকারী অর্ধেকের শরীরে দেয়া হয় ভ্যাকসিন এবং বাকী অর্ধেককে দেয়া হয় প্ল্যাসিবো বা ডামি ভ্যাকসিন। এরপর তাদেরকে মুক্তভাবে চলাফেরা করতে দিতে হয় জনমানুষের ভেতরে, যেখানে করোনা মহামারী চলমান। এরপর দেখা হয় আসল ভ্যাকসিন গ্রহীতাদের ভেতরে কতজন করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছে। ভ্যাকসিন গ্রহীতাদের ভেতরে যদি কমপক্ষে ৬০-৭০ শতাংশ করোনা সংক্রমণ থেকে মুক্ত থাকে তাহলে ধরে নেয়া হয় যে ভ্যাকসিনটি রোগপ্রতিরোধে সক্ষম। আর শুধুমাত্র এই ফলাফলের পরেই একটা নতুন ভ্যাকসিন সর্বসাধারণের উপর প্রয়োগের অনুমতি দেয়া হয়।

যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড, আমেরিকার মর্ডানা, জার্মানির বায়োন্টেক এবং চীনের সিনোভ্যাক তাদের ভ্যাকসিনের সফল ফেইজ-১/২ ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের পর এখন চালাচ্ছে ফেইজ-৩ ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল, যেখানে অক্সফোর্ড সবার চেয়ে এগিয়ে। অন্যদিকে রাশিয়ার গামালেয়া ইন্সটিটিউট তাদের ভ্যাকসিনের কোন প্রকার ফেইজ-৩ ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল না করেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে তারা তা জনসাধারণের উপর প্রয়োগ করবে। আর এভাবেই পুতিনের দেশ রাশিয়া হঠাৎ করেই হয়ে গেল ভ্যাকসিন দৌড়ে চাম্পিয়ন!

কিন্তু রাশিয়ার এই ভ্যাকসিনের ব্যাপারে গোটা বিশ্বের বিজ্ঞানী মহল কতটুকু অবগত? যেখানে অক্সফোর্ড, মর্ডানা বা সিনোভ্যাক সবাই তাদের ভ্যাকসিন গবেষণার ফলাফল এবং ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের রিপোর্ট স্বনামধন্য বিজ্ঞান সাময়িকীতে প্রকাশ করেছে, সেখানে রাশিয়ার গামালেয়া ইন্সটিটিউট তাদের ‘গাম-কোভিড-ভ্যাক’ (স্পুটনিক-৫) ভ্যাকসিনটির কোন প্রকার বৈজ্ঞানিক ফলাফল কোন বিজ্ঞান সাময়িকীতে প্রকাশ করেনি। আর এ কারনেই তাদের ভ্যাকসিনটির কার্যকারীতা এবং নিরাপত্তা নিয়ে বিজ্ঞানী মহলে তৈরী হয়েছে উৎকন্ঠা। সপ্তাহখানেক আগে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা রাশিয়ার ভ্যাকসিনটি নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছে এবং তরিঘরি সর্বসাধারণে প্রয়োগে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছে। আমেরিকার করোনা মহামারী টাস্কফোর্স প্রধান বিজ্ঞানী অ্যান্থনি ফাউচি রাশিয়ার ভ্যাকসিনটির যথাযথ ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল না করেই সর্বসাধারনে প্রয়োগের সিদ্ধান্তকে অবৈজ্ঞানিক হিসেবে আক্ষ্যা দিয়েছেন।

রাশিয়ার স্পুটনিক-৫ ভ্যাকসিনটি এক ধরনের অ্যাডিনোভাইরাস ভিত্তিক ভ্যাকসিন। ভ্যাকসিনটি অনেকটা অক্সফোর্ডের চ্যাডক্স-১ বা চীনের ক্যানসিনোবায়ো ভ্যাকসিনের মতই। এই ভ্যাকসিনে রিকম্বিনেন্ট টেকনোলজির মাধ্যমে অ্যাডিনোভাইরাসের মধ্যে করোনাভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনের ডিএনএ বা জীন প্রবেশ করিয়ে দেয়া হয়। এতে করে এই অ্যাডিনোভাইরাসটি যখন ভ্যাকসিন আকারে ইন্জেকশনের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করানো হয়, তখন আমাদের ইমিউন সিস্টেম এই ভাইরাসটিকে করোনাভাইরাস হিসেবে চিহ্নিত করে এর বিপরীতে রোগপ্রতিরোধ ব্যাবস্থা তৈরী করে, যা পরবর্তিতে আমাদেরকে আসল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থেকে রক্ষা করে।

গামালেয়া ইন্সটিটিউটের দাবী অনুযায়ী তারা তাদের ভ্যাকসিনটি সর্বপ্রথম বানরের উপর পরীক্ষা করে সফলতা পেয়েছে। ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের নিবন্ধন ওয়েবসাইট ক্লিনিক্যালট্রায়ালস ডট গভ থেকে জানা যায় যে তারা তাদের ভ্যাকসিনের ফেইজ-১ ও ফেইজ-২ ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু করে ১৭ জুন এবং তা শেষ করে ৫ আগস্ট। তারা এই ট্রায়াল দুটো একসাথে চালায় প্রায় ৭০ জন ভলান্টিয়ারের উপর যাদের বেশীর ভাগই ছিল রাশিয়ার সৈন্য। এই ট্রায়াল দুটোর ফলাফল সমন্ধে আমরা কিছুই জানিনা। তারা শুধু বলেছে যে তাদের ভ্যাকসিনটি নিরাপদ এবং কার্যকরী। আর এর পরের খবর তো আমরা সবাই জানি! ৫ আগস্ট থেকে ১১ আগস্ট এই ৬ দিনে কোন ফেইজ-৩ ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল হয় না।

ফেইজ-৩ ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল না করে কখনই কোন ভ্যাকসিনকে সর্বসাধারনের জন্য প্রয়োগের অনুমতি দেয়া যেতে পারে না। এই ধরনের কান্ড কিন্তু নতুন না। চীনের ক্যানসিনোবায়োও এই কান্ডটি করেছে। তারা তাদের করোনা ভ্যাকসিনের ফেইজ-৩ ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল না করেই তাদের দেশের সৈন্যদের উপর প্রয়োগের অনুমতি প্রদান করে। সেই অর্থে কিন্ত তারাই প্রথম করোনা ভ্যাকসিন তৈরীর দাবীদার। অবশ্য ক্যানসিনোবায়ো এখন উপায়ন্তর না দেখে ফেইজ-৩ ট্রায়াল করার চেস্টা করছে। কারন তারা জানে, ফেইজ-৩ ট্রায়াল ছাড়া তাদের উৎপাদিত ভ্যাকসিন কেউ কিনবে না। ঠিক একই ভাবে রাশিয়ার ভ্যাকসিনও সঠিক ট্রায়াল ছাড়া সবার মাঝে গ্রহনযোগ্যতা পাবে না।

গত নয় মাসে সারা বিশ্বে করোনাতে প্রান গেছে ৭ লক্ষ ৮২ হাজার মানুষের। চলতি বছরের শেষে হয়তো এই সংখ্যাটি ১০ লক্ষে গিয়ে ঠেকবে। সুতরাং একটি কার্যকরী ভ্যাকসিন এখন সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন। শুরুতে করোনাতে মৃত্যুহার বেশী থাকলেও এখন কিন্তু মৃত্যুহার অনেকটা কমে এসেছে। বাংলাদেশ এই হার এখন ১.২ শতাংশ, ভারতে ২ শতাংশ এবং ব্রাজিলে প্রায় ৩ শতাংশ। অতএব, আমরা তরিঘরি না করে অরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে পারি একটি নিরাপদ এবং কার্যকরী ভ্যাকসিনের জন্য। আর এই তালিকায় রাশিয়ার ভ্যাকসিন কখনই স্থান পাবে না যদি না তারা যথাযথ নিয়ম মেনে তাদের ভ্যাকসিন উৎপাদন করে।

ডাঃ খোন্দকার মেহেদী আকরাম,
এমবিবিএস, এমএসসি, পিএইচডি,
সিনিয়র রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট,
শেফিল্ড ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাজ্য

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়