ডেস্ক রিপোর্ট : একেবারে শীর্ষ পদ প্রধান প্রকৌশলী থেকে শুরু করে অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী, নির্বাহী প্রকৌশলী, উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী, সহকারী প্রকৌশলী, উপ-সহকারী প্রকৌশলী- এমনকি কম্পিউটার অপারেটর, পিয়ন পর্যন্ত উৎকোচ গ্রহণ করেন এখানে। যত প্রভাবশালী আর ক্ষমতাশালী হোন না কেন, সংশ্লিষ্টদের পকেটে টাকা গুঁজে দেয়ার আগ পর্যন্ত টেবিল থেকে ফাইল নড়া তো দূরে থাক, কম্পিউটারে টাইপ পর্যন্ত হয় না।
‘আগে টাকা পরে কাজ’-এখানে এমনটাই রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। প্রকাশ্যে এমন দুর্নীতি আর অনিয়ম হয় গৃহায়ণ ও গণপূর্তের নিয়ন্ত্রণাধীন প্রতিষ্ঠান গণপূর্ত অধিদফতরে। গণহারে দুর্নীতির কারণে অনেকেই এখন প্রতিষ্ঠানটিকে ‘গণপূর্ত অধিদফতর’ না বলে ‘গণদুর্নীতি অধিদফতর’ বলে ডাকেন।
সরকারের অবকাঠামো বিষয়ক উন্নয়ন প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষ হিসেবে থাকা প্রতিষ্ঠানটির এমন পাঁচ শতাধিক দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের সত্যতা খুঁজছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
স্বাধীন প্রতিষ্ঠান গণপূর্ত অধিদফতরে দুর্নীতির ১০টি উৎসও এরই মধ্যে চিহ্নিত করেছে। গণপূর্তের দরপত্র প্রক্রিয়াতেই দুর্নীতি বেশি হয় বলে দুদকের তদন্তে বেরিয়ে এসেছে। এর মধ্যে রয়েছে-যথাযথভাবে দরপত্র প্রক্রিয়া সম্পন্ন না করা, অপছন্দের ঠিকাদারকে কাজ না দেয়া, অস্বাভাবিক মূল্যে প্রাক্কলন তৈরি, ছোট ছোট প্যাকেজে প্রকল্প প্রণয়ন, দরপত্রের শর্ত উপেক্ষা করা।
এ ছাড়া নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার, প্রকল্পের প্রণয়ন, তদারকি, বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ কাজে ধীরগতি, প্রয়োজনের তুলনায় কম বরাদ্দ, প্রকল্পের অনাবশ্যক ব্যয় বৃদ্ধি, স্থাপত্য ও কাঠামোগত নকশা চ‚ড়ান্তে বিলম্ব, প্রত্যাশী সংস্থার প্রয়োজনমতো জরুরিভিত্তিতে কাজ শেষ না করা, সেবা প্রদানের বিভিন্ন স্তরে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অসহযোগিতা, সময়মতো ঠিকাদারদের বিল পরিশোধ না করা এবং বরাদ্দ থাকার পরও ঠিকাদারদের আংশিক বিল পরিশোধ করাও চিহ্নিত হয়েছে অনুসন্ধানে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতিষ্ঠানটির প্রধান প্রকৌশলী আশরাফুল আলমের অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ বেশ আগে থেকেই। রাজধানীর শেরেবাংলানগরে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী এবং রংপুরে অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত অবস্থায় তিনি এসব অনিয়ম ও দুর্নীতি করেছেন, যা দুদকে এখনো তদন্তাধীন।
এদিকে অভিযোগ তদন্তাধীন রয়েছে অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী উৎপল কুমার দে ও ড. মো. মঈনুল ইসলামের বিরুদ্ধেও। এ ছাড়া রাজধানীর বিভিন্ন সার্কেলে কর্মরত তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী, নির্বাহী প্রকৌশলী, উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী, সহকারী প্রকৌশলী ও উপ-সহকারী প্রকৌশলীদের অনেকের বিরুদ্ধেই উত্থাপিত অভিযোগ ও দায়ের করা মামলার তদন্ত চলছে বলে জানা গেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গণপূর্ত অধিফতরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সীমাহীন অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে গত বছরই একটি টিম গঠন করে দুদক। ২৫টি প্রতিষ্ঠানকে টার্গেট করে বিভিন্ন গণপূর্তসহ একাধিক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত পৃথক টিম গঠন করে দেয় সংস্থাটি। টিমের কর্মকর্তারা নানা বিষয়ে অনুসন্ধান চালানোর পর তৎকালীন গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিমের হাতে এ-সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন তুলে দেন দুদকের কমিশনার মো. মোজাম্মেল হক খান।
দুদক কমিশনার সাংবাদিকদের বলেন, এই প্রতিবেদনটি এক ধরনের পর্যবেক্ষণ বা সংক্ষিপ্ত জরিপ। কাজটি করতে এই মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, স্টেক হোল্ডার, ঠিকাদার ও বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন, এই মন্ত্রণালয়ের অডিট রিপোর্ট, বার্ষিক প্রতিবেদন সবকিছু পর্যালোচনা করা হয়েছে। দুদকের এই প্রতিবেদনকে গুরুত্বের সঙ্গে নেবেন বলে জানিয়েছিলেন গণপূর্তমন্ত্রীও।
সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘এই প্রতিবেদন আমাদের কাজের গতি বৃদ্ধি, স্বচ্ছতা আনতে এবং জবাবদিহির ক্ষেত্রে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। এই গাইডলাইনকে আমরা খুবই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করব।’
সংশ্লিষ্টরা জানান, দুদকের প্রতিবেদন অনুযায়ী মন্ত্রী ব্যবস্থা নেয়ার আগেই মন্ত্রণালয় পরিবর্তন হয়ে যায় তার। যে কারণে দুদক প্রতিবেদন দেয়ার এক বছর গত হয়ে গেলেও বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া থমকে আছে।
এদিকে করোনার ভয়াবহ প্রাদুর্ভাবের কারণে দুদকের তদন্তেও কিছুটা ভাটা পড়েছে। এখন সবকিছু স্বাভাবিক হতে শুরু করায় ফের এসব অভিযোগ তদন্তে নামছে সংস্থাটি। এসব বিষয়ে গণপূর্ত অধিদফতরের প্রধান প্রকৌশলী মো. আশরাফুল আলমের বেশ কয়েক দফা যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। মুঠোফোনে বারবার কল দিলেও রিসিভ না করে বক্তব্য দেয়ার বিষয়টি এড়িয়ে যান তিনি।
যেসব দুর্নীতি ও অনিয়ম হচ্ছে: দরপত্র প্রক্রিয়ার বিভিন্ন স্তরে দুর্নীতির খোঁজ মিলেছে। যেমন- অতিরিক্ত ব্যয়ের প্রাক্কলন, দরপত্রের তথ্য ফাঁস, সমঝোতার নামে অনৈতিক সুবিধা নিয়ে এজেন্ট ঠিকাদার নিয়োগ, বারবার নির্মাণকাজের নকশা পরিবর্তন, নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার, টেন্ডারের শর্তানুসারে কাজ বুঝে না নেয়া, কোনো কোনো ক্ষেত্রে মেরামত বা সংস্কারকাজের নামে ভুয়া বিল-ভাউচার করে অর্থ আত্মসাৎ, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা/প্রভাবশালী ব্যক্তিদের বেনামে বা ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজনের মাধ্যমে ঠিকাদারি কাজ পরিচালনা, প্রভাবশালী ব্যক্তিদের অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপ এবং ঠিকাদার ও প্রকল্প বাস্তবায়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীর অনৈতিক সুবিধালাভ।
গণপূর্ত অধিদফতরের বৃহৎ পরিসরের কাজ ছাড়াও মেরামত, সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণ খাতে কোটি কোটি টাকার বরাদ্দ রয়েছে। এ বরাদ্দের বিপরীতে কাজগুলো ছোট ছোট লটে ভাগ করা হয়। এসব কাজ তাদের পছন্দের ঠিকাদারদের দেয়ার জন্য ই-জিপিতে না গিয়ে গোপন দরপত্রের মাধ্যমে কাজ দেয়া হয়। অনেক ক্ষেত্রে অপছন্দের ঠিকাদারকে ‘নন-রেসপনসিভ’ করা হয় এবং কৌশলগত হিসেবের মাধ্যমে পছন্দের ঠিকাদারকে রেসপনসিভ করা হয়।
যেমন- বর্তমানে ই-জিপির মাধ্যমে দরপত্র আহ্বান করা হলেও আগেই গোপন সমঝোতার মাধ্যমে পছন্দের ঠিকাদারকে রেট জানিয়ে দেয়া হয়। এ ছাড়া পছন্দের ঠিকাদারের যেসব অভিজ্ঞতা রয়েছে সেসব অভিজ্ঞতার শর্ত জুড়ে দেয়া হয়, যাতে অন্য কোনো ঠিকাদার ওই দরপত্রে অংশ নিতে না পারেন।
এদিকে সরকারি বাজেটের একটি অংশ ঠিকাদারের যোগসাজশে আত্মসাতের উদ্দেশ্যে বাজারদরের সঙ্গে সামঞ্জস্য না রেখে শিডিউল রেটের বাইরে গিয়েও অনেক ক্ষেত্রে প্রাক্কলন তৈরি করা হয়। বড় বড় প্রকল্প বিশেষ করে ৩০ কোটি টাকার ঊর্ধ্বে প্রকল্প প্রণয়নের ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের প্রয়োজন হয়। অনেক সময় অসৎ উদ্দেশ্যে মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের দায় এড়ানোর জন্য ছোট ছোট প্যাকেজ করে প্রাক্কলন প্রণয়ন, অনুমোদন ও ঠিকাদার নিয়োগ করা হয়। যেমন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের আওতায় ডেলিগেটেড ওয়ার্ক হিসেবে গণপূর্ত অধিদফতরের নির্মাণাধীন ছয়টি ভবনে আসবাবপত্রসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক কাজের জন্য দাফতরিক প্রাক্কলন প্রণয়ন করে ছয়টি প্যাকেজে ই-জিপিতে দরপত্র আহ্বান করা হয়েছিল।
সূত্র মতে, বর্তমানে গণপূর্ত অধিদফতরের অধিকাংশ ক্ষেত্রে ই-জিপি টেন্ডারিং প্রক্রিয়া অনুসরণ করলেও তার শর্তানুসারে স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী কাজ বাস্তবায়ন না করে একশ্রেণির প্রকৌশলী/কর্মকর্তার যোগসাজশে প্রকল্পের অর্থ আত্মসাৎ করা হয়ে থাকে। ঠিকাদার নির্বাচনের ক্ষেত্রে সিন্ডিকেট পদ্ধতি দীর্ঘদিন একটি প্রচলিত প্রথায় পরিণত হয়েছে। কাজ পাওয়ার জন্য অনেক সময় বিভিন্ন প্রভাবশালী ব্যক্তি, পরামর্শক সংস্থা, দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের উৎকোচ প্রদান করতে হয়।
গণপূর্তের মাধ্যমে বাস্তবায়নাধীন প্রকল্প বা নির্মাণকাজে নিম্নমানের ইট, রড, সিমেন্ট ও বালু ব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে যে রেশিও অনুযায়ী সিমেন্ট-বালু মেশানোর কথা, তা না করে বালুর পরিমাণ বেশি মেশানো হয়। এ ছাড়া যে ধরনের রড নেয়ার কথা, তা না করে তার চেয়ে পাতলা রড এবং ঘনত্বও কমিয়ে দেয়া হয়। প্রকল্প বাস্তবায়নে নিয়োজিত গণপূর্ত অধিদফতরের প্রয়োজনের তুলনায় জনবল আনুপাতিক হারে কম থাকায় প্রকল্প প্রণয়ন, তদারকি, বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ কাজে ধীরগতির অভিযোগ রয়েছে।
এ ছাড়া ভবনের মেরামত, সংস্কার ও সংরক্ষণের জন্য যে পরিমাণ বরাদ্দ প্রয়োজন, এর এক-তৃতীয়াংশ পাওয়া যায় না। যথাসময় বরাদ্দ ছাড়ের অভাবে রক্ষণাবেক্ষণের কাজ বিঘ্নিত হয়। এতে রক্ষণাবেক্ষণ কাজ চাহিদামাফিক করা সম্ভব হয় না। প্রকল্প ছক সংশোধন করে অনাবশ্যক প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধি করা হয়। মূলত আর্থিক মুনাফার প্রত্যাশায় প্রয়োজন না থাকা সত্ত্বেও ঠিকাদার ও প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের যোগসাজশে ব্যয় বৃদ্ধি করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।
জরুরিভিত্তিতে কাজ না করা: কর্মকর্তাদের অবহেলা, সদিচ্ছা ও তদারকির অভাবে প্রাক্কলন তৈরি থেকে শুরু করে দরপত্র আহ্বান কার্যাদেশ প্রদান এবং প্রত্যাশী সংস্থার চাহিদামতো জরুরিভিত্তিতে কাজ শেষ করা হয় না। এ ছাড়া পূর্ত অধিদফরের আওতাধীন বিভিন্ন সরকারি দফতর, অধিদফতর বা সরকারি কোয়ার্টারের মেরামত, রক্ষণাবেক্ষণসহ সেবা দিতে বিভিন্ন স্তরে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অসহযোগিতার অভিযোগও রয়েছে বিস্তর।
সূত্র-মানবকণ্ঠ