আসিফ নজরুল: আব্রাহামের সংগে আমার পরিচয় লন্ডনে। ভারতের ছেলে। শ্যামল বর্ণ, মাঝারী উচ্চতা, বিরক্ত চেহারা, কপালে ভাঁজ। আলাদাভাবে মনে রাখার মতো কিছু ছিল না। আমি তাই জানতাম।
গ্রীসের মেয়ে ভিভি সেই ভুল ভেঙ্গে দেয় আমার। সেটি ১৯৯৫ সালের কথা। খুবই সংকটময় দিনকাল তখন আমার। জীবনে কখনো পিএইচডি হবে কিনা, না হলে পালিয়ে কোন প্যাসিফিক আইল্যান্ডে চলে যাব কিনা, নাকি একবারে স্যুইসাইড– ই করে ফেলবো এই জটিল চিন্তায় মগ্ন থাকি।
সেদিনও স্কুল অব ওরিয়েন্টাল এন্ড আফ্রিকান স্টাডিজ (সোয়াস)-এর সামনের সিড়িতে বসে ভাবছিলাম এসব। ভিভি এসে বসে আমার পাশে। ‘ক্যামেল’ সিগারেট ধরায়। এমন মায়াবী চেহারার একটা মেয়ের মুখে সিগারেট মানায় না। ওকে এটা বলছি আগে আমি । লাভ হয়নি । আমার কথাবার্তা বেশি পাত্তা দেয় না ও। ওর বাড়ির মালিক লেসবিয়ান কেন এনিয়ে প্রশ্ন তোলার পর থেকে আরও না।
ভিভি প্রায় আমার মুখের উপরই ধোঁয়া ছেড়ে জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে? পিএইচডি নিয়ে দুশ্চিন্তার কথা বলি। এসব কথা আগে শুনেছে ও। একটু বিরক্তি হয় প্রথমে। তারপর কামওন আজিফ্ (মানে আসিফ) বলে বুঝাতে শুরু করে। বাংলাদেশের মায়েদের মতো মায়ামমতা তার কণ্ঠে। সেই মমতা তেমন স্পর্শ করেনা আমাকে । ভিভি তবু হাল ছাড়ে না।
হঠাৎ বলেঃ তুমি আব্রাহামকে চিনো?
কোন আব্রাহাম? ইন্ডিয়ার?
হ্যা। তুমি জানো ও কয় বছর ধরে পিএইচডি করছে?
জানি না।
পাঁচ বছর ধরে, ওকে? এখনও ওর আপগ্রেডিংই হয়নি।
ভিভির কথার মর্ম বুঝতে পারি আমি। এলএসসি, ইউসিএল বা কিংস-এর মতো সোয়াস – ও ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনে প্রথমেই পিএইচডি করার জন্য ভর্তি নেয় না। প্রথমে এমফিল – এর জন্য রেজিস্ট্রেশন করতে হয়। এমফিল থিসিস – এর অগ্রগতির উপর নির্ভর করে পরে পিএইচডিতে আপগ্রেডিং করা হয়।
আব্রাহাম এমফিলই করছে পাঁচ বছর ধরে, আর আমি শুরু করছি জাস্ট গতবছরে। কাজেই এতো চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই আমার।
আসলে আছে। ভিভি জানে না তা। ওকে তা বলতেও ইচ্ছা করে না। ও মাস্টার্স করেছে লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্স (এলএসসি) থেকে। পৃথিবীর সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান -এর একটি এলএসসি। সোয়াস- এ পিএইচডি করতে এসে এরমধ্যেই পার্ট টাইম টিচিং – এর কাজ করছে ও। আমাদের ল’ ডিপার্টমেন্ট-এর শিক্ষকরা একনামে চেনে ওকে। ওর সঙ্গে তুলনা হয় না আমার।
ভিভির সঙ্গে আমার মিল শুধু এক জায়গাতে। দুজনারই সুপারভাইজার ফিলিপ স্যান্ডস। পরিবেশ আইন বিশেষজ্ঞ হিসেবে মাত্র ৩৮ বছর বয়সেই ফিলিপের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে আটলান্টিকের দুই পাড়ে। সে জন্যই হোক, আর আমার অতি নিন্মস্তরের গবেষণা দেখেই হোক আমাকে ঠিক মানুষ মনে করে না ও। একমাসে একদিন সময় দেয়। সেও পনের মিনিটের জন্য।
আমি তার সামনে বসা মাত্র কোথা থেকে রাজ্যের ফোন আসা শুরু হয়। অত্যন্ত ব্যস্ত ভঙ্গিতে ফোনে গল্প করে সে। তার ফাঁকে ফাঁকে আমাকে একটা দুটো প্রশ্ন করে। উত্তরে আমি অদ্ভুত ইংরেজিতে এমন এলোমেলো কথা বলি যে আমারই বুকের রক্ত হিম হয়ে যায়।
এসব কথা কাউকে বলা যায়না, ভিভিকে না। দেশে কাউকে তো না-ই। দেশ ছাড়ার আগে বিচিত্রায় ফাটানো সব রিপোর্ট করেছি। নিষিদ্ধ কয়েকজন-এর মতো কিছু উপন্যাস লিখে ধরাকে সরা জ্ঞান শুরু করেছি। বেয়াদব এবং অহংকারী হিসেবে কুখ্যাতি উপভোগ করেছি প্রানভরে।এখন আমার এমন পরিনতি জানলে কতরকম বিকৃত হাসি হাসবে মানুষ। মুখ দেখাব কিভাবে আমি? প্যাসিফিক আইল্যান্ড অথবা স্যুইসাইড-এই চিন্তাই বরং কিছুটা শান্তি দেয় আমাকে।
ভিভির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে লন্ডন হাউজের রাস্তায় নামি। পথে রাসেল স্কয়ারের হিরণ্ময় আলো। স্কয়ারের পাশে পাব । পাবের সামনের পেভমেন্ট –এ টেবিল ঘিরে বসা প্রাণোচ্ছল মানুষ, বিয়ার ভরা গ্লাস, উদ্দাম সংগীত । বার্কলেস ব্যাংক- এর দেয়াল সেঁটে থাকা প্রেমিক-প্রেমিকার ঘন চুম্বন ।
উইপিং উইলোর মতো বুকটা হু হু করে ওঠে আমার । আহারেঃ কতো আনন্দে থাকে মানুষ । পিএইচডি করার চিন্তা নেই কারো। ফেসবুক থেকে
আপনার মতামত লিখুন :