মুসবা তিন্নি : [২] ভারতীয় জাতীয়তাবাদের শুরুর দিকে বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে তৈরি হওয়া রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল মুসলিম লিগ। ঢাকার নবাব সলিমুল্লাহ ছিলেন এই মুসলিম লিগের অন্যতম নেতা। যদিও পরে ভারত-পাকিস্তান বিভাজন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে এই মুসলিম লিগ ইতিহাসের অন্ধকার দিকে থাকে, তবে তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নবাব সলিমুল্লাহ কেবলমাত্র স্রোতের অভিমুখে গমন করেছেন বলা যেতে পারে। ১৯০৮ সাল নাগাদ নবাবের দরবারে চরম অর্থসংকট দেখা যায়, সেই সময় তিনি আসাম ও পূর্ববঙ্গ সরকারের থেকে ১৪ লাখ রুপি ঋণ নেন। শর্ত ছিল ৩০ বছরের মধ্যে বার্ষিক ৩ শতাংশ সুদে সমস্ত দেনা শোধ করতে হবে।
[৩] এই ঋণের বিনিময়ে নবাব বন্ধক রেখেছিলেন বহুমূল্য ধনরত্ন। তার মধ্যে একটি ছিল প্রমাণ আকারের হীরা, দরিয়া-এ-নূর। নগদ পাঁচ লাখ রূপি মূল্যের এই হীরা ছাড়াও ছিল ১০৮ রকম আলাদা রত্ন। বিশ্বখ্যাত হীরক খন্ডটির অর্থ সমুদ্রের আলো। ঢাকার নবাবের সমস্ত সম্পদ গচ্ছিত রাখা ছিল ব্রিটিশ শাসন কালের স্টেট ব্যাংকে , পরে তা সরিয়ে নিয়ে আসা বাংলাদেশের সোনালী ব্যাংকে।
[৪] ইতিহাস বলে মোঘল সাম্রাজ্যের রত্ন ভান্ডারের সেরা আকর্ষণ ছিল কোহিনূর ও দরিয়া ই নূর। মোঘল সাম্রাজ্যের পতনের পর পারস্যের নাদির শাহ যখন দিল্লি আক্রমণ করেন তখন হীরক খন্ড দু’টি তার রাজকোষে চলে যায়। পরবর্তীতে তার উত্তরাধিকারীর সেই রত্ন নিয়ে কাশ্মীরে পালিয়ে আসেন এবং তা কালের নিয়মে পাঞ্জাবের রঞ্জিত সিংয়ের হস্তগত হয়। তার উত্তরাধিকারী দিলীপ সিংকে যুদ্ধে হারিয়ে রত্ন দু’টির দখল নেয় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী। আর তার নেপথ্যে ছিলেন লর্ড ডালহৌসী। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী কোহিনূর ও দরিয়া-ই-নূর দুটি লন্ডনে পাঠিয়ে দেয় রাণী ভিক্টোরিয়াকে উপঢৌকন হিসেবে। কোহিনূর ব্রিটিশ রাণীর পছন্দ হলেও দরিয়া-ই-নূর তার মনে ধরেনি। তিনি সেটি ফেরত পাঠিয়ে দেন কোম্পানীকে।
[৫] ব্রিটিশ সরকারের অনুমোদনক্রমে কলকাতার হ্যামিল্টন অ্যান্ড কোম্পানি ১৮৫২ সালের নভেম্বরে দরিয়া-ই-নূরের নিলামের আয়োজন করে এবং ঢাকার নওয়াব খাজা আলীমুল্লাহ ৭৫ হাজার টাকায় এটি নিলামে ক্রয় করেন। ১৯০৮ সালে নওয়াব খাজা সলিমুল্লাহ দরিয়া-ই-নূর হীরকটি সরকারের নিকট বন্ধক রেখে যখন ঋণ গ্রহণ করেছিলেন তখন এর মূল্য নিরূপণ করা হয়েছিল ৫ লক্ষ টাকা।
[৬] ১১২ বছর আগে নেয়া ঋণ আজও পরিশোধিত হয়নি ফলে সেই সম্পদও হয়ে গেছে সরকারী সম্পত্তি। ভূমি সংস্কার দপ্তরের বিভিন্ন রিপোর্ট ও চিঠিপত্র থেকে এই বিপুল রত্নভান্ডারের সম্বন্ধে বেশ কিছু তথ্য জানা গেছে , যদিও বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে এবিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। বছর চারেক আগে ২০১৬ সালে এই রত্নভান্ডারের পরিদর্শনের জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয় যদিও তার পরবর্তী কার্যকলাপের কোনো খবর পাওয়া যায়নি। ২০১১ সালে আরও একটি উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল ভূমিমন্ত্রীর দপ্তর থেকে। সেই কমিটির সামনে একটি সিল করা বাক্স পেশ করা হয়েছিল যার ভিতরে সমস্ত রত্ন ছিল। কিন্তু সেই বাক্স খোলা হয়নি তাই জানাও যায়নি নবাব সলিমুল্লাহর সম্পদের বিবরণ।
[৭] শতবর্ষের বেশি সময় ধরে লকারে থাকা গচ্ছিত সম্পদের মূল্য কত হতে পারে সে বিষয়ে এক সরকারী কর্মচারী বলেন, সংখ্যাটা কয়েকশো কোটি ছাড়াবে আজকের দিনে। বাংলাদেশের জাদুঘর কর্তৃপক্ষ অনেকবারই হিরেটি দাবী করেছে জাদুঘরে প্রদর্শনের জন্য, তাদের মতে এই মহামূল্যবান সম্পদকে সাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা উচিত। জাদুঘরের নিরাপত্তা যথেষ্ট সাবলীল, এরকম সম্পদের রক্ষায় কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে কোনো মন্তব্য করা হয়নি এ বিষয়ে। আদৌ কখনও জনসমক্ষে এই সম্পদ আসবে কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।
[৮] নবাব সলিমুল্লাহ রাজনৈতিক পরিচয়ের বাইরেও একজন দক্ষ শাসক ছিলেন। তাঁর মাত্র ৪৩ বছরের জীবনকালে ঢাকা শহরে বহু উন্নতি করেছিলেন। ঢাকার বিদ্যুৎ ব্যবস্থা, টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা, পানির ব্যবস্থা, হাসপাতাল, স্কুল-কলেজ সবই তিনি বানিয়ে যান। তাঁর সময়ে বানানো প্রতিষ্ঠান গুলির মধ্যে আহছানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুল, মিটফোর্ড হাসাপাতাল এছাড়াও আরও বেশ কিছু এখনও স্বমহিমায় বিদ্যমান। সূত্র : ইতিহাস ও মিথলজি । সম্পাদনা : খালিদ আহমেদ