মুসবা তিন্নি : [২] দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যোগ দিতে চেয়েছিলেন প্রাক্তন সেনাকর্মী সিরিল ব্রোমলি। তো অনুশীলনের সময় জঙ্গলে একটি গাছের উপর গিয়ে পড়েন তিনি। ‘কাটা সাপের মতো উন্মত্ত’ অবস্থায় তাকে নিয়ে আসা হয় হাসপাতালে। সে যাত্রায় যুদ্ধে যাওয়ার স্বপ্ন ঘুচে যায় ব্রোমলির। বেঁচে ফিরে তিনি আরেক সেনাকর্তার গল্প বলেছিলেন, যিনি অজান্তেই গাছের পাতা ব্যবহার করে টয়লেট পেপারের কাজ সারছিলেন। শেষমেশ যন্ত্রণার চোটে গুলিতে নিজেকে শেষ করে দেন। ১৯৬৩-তে উদ্ভিদবিদ আর্নি রাইডারের মুখ, বুক ও হাতে সামান্য ছোঁয়া লাগে একটি গাছের। পুরোপুরি যন্ত্রণামুক্ত হতে সময় লেগেছিল ৩ বছর। মারাত্মক সেই বিষবৃক্ষের নাম ‘গিম্পি গিম্পি’, ডাকনাম ‘সুইসাইড প্ল্যান্ট’।
[৩] জগতের সবচেয়ে বেদনাদায়ক এই ‘আত্মঘাতী উদ্ভিদের’ সর্বাঙ্গে রোঁয়া রয়েছে। ফলে সামান্য ছোঁয়াতেই আপনি একসঙ্গে অসংখ্য হুল ফোটার তীব্র যন্ত্রণা অনুভব করবেন। সঙ্গে সঙ্গে বমি করতে শুরু করবেন এবং অনেক বছর ধরে সেই যন্ত্রণা বয়ে চলবেন, যদি তা সহ্য করতে পারেন। ‘মনে হবে, গায়ে অ্যাসিড ঢেলে দেওয়া হয়েছে এবং একই সঙ্গে বৈদ্যুতিক শক দেওয়া হয়েছে।’ জানাচ্ছেন উদ্ভিদবিদ মেরিনা হারলি। আর এই ভয়ঙ্কর গাছকে আপনার স্পর্শ করার দরকারও পড়বে না। খুব অল্প আন্দোলনেই বিষাক্ত রোঁয়াগুলি উড়তে থাকে বাতাসে। গ্রীষ্মে মনে হবে যেন বিড়াল। অত্যন্ত সূক্ষ্ম সূঁচের মতো বিঁধে যাবে শরীরে। তাই গিম্পি গিম্পি সম্পর্কে ভয়ানক সব গল্পের অন্ত নেই।
[৪] যদি এই রোঁয়া গায়ে লাগে, তা আপনি সন্না দিয়েও তুলতে পারবেন না। ভীষণ সূক্ষ্ম এবং তীক্ষ্ম রোঁয়া একসঙ্গে সমূলে তোলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপায় হচ্ছে গরম মোমের প্রলেপের সাহায্য নেওয়া। কিন্তু তাতেও সতর্ক থাকতে হবে। অসংখ্য রোঁয়ার মধ্যে কোনওটি যদি ভেঙে ত্বকের ভেতরে রয়ে যায়, দীর্ঘ বছর আপনাকে কষ্ট সহ্য করতে হবে। এমনকী গবেষকদের দাবি, শতাব্দী ধরে সংরক্ষিত শুকনো পাতা থেকেও হুলবিদ্ধ হওয়া সম্ভব। বিশ্বাস করুন বা না করুন, গিম্পি গিম্পি ফুল-ফলও দেয়। অবশ্যই, রঙিন ও মোহময়ী সে ফুল এবং ফলের গায়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রোঁয়া থাকে। এই ফল স্বাভাবিকভাবে প্রাণীদের খাওয়ার জন্য আকৃষ্ট করে। তবে অস্ট্রেলিয়ার জঙ্গলনিবাসী এই গিম্পি গিম্পি যেন সর্বক্ষণ পশুপাখিদের বলছে, ‘তফাত যাও’।
[৫] উদ্ভিদবিদ মেরিনা হারলি গিম্পি গিম্পি সম্পর্কে বিশদ তথ্য সংগ্রহ করতে অস্ট্রেলিয়ার বৃষ্টি অরণ্যে কাটিয়েছেন তিন বছর। নিজের সুরক্ষায় হাতে ওয়েল্ডিং গ্লাভস এবং প্রায় গোটা শরীর মুড়ে রাখেন বিশেষভাবে নির্মিত মোটা কাপড়ে। যদিও তীব্র অ্যালার্জির প্রতিক্রিয়া নিয়ে তাঁকেও হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। চিকিৎকরা পরামর্শ দেন, যাতে তিনি ভবিষ্যতে কখনও ওই গাছের ছায়াও না মাড়ান। নিরুপায় হয়ে তিনি তা মেনেও নিয়েছিলেন। গিম্পি গিম্পির পাতাগুলি অনেক সময় পোকায় কাটার মতো অবস্থায় দেখেছেন হারলি। দেখে ছোট পতঙ্গের কাজ মনে হতে পারে। কারণ, তারা সহজেই বিষাক্ত হুল এড়িয়ে যেতে পারে। কিন্তু অনেক সময় নির্ভুলভাবে চেখে পড়েছে পাতায় ছিঁড়ে খাওয়ার মতো চিহ্ন। তার মানে, কোনও অজানা প্রাণী সেই পাতা খাচ্ছে। কে সেই প্রাণী?
[৬] জানতে তিনি একটি কৌশল নেন। শিকারী যেমন ফাঁদ পাতে, সেভাবেই কয়েকটি গিম্পি গিম্পিকে ভারি পাথর চাপা দিয়ে রাখেন, যাতে সহজে খাদকের পরিচয় মেলে। এতেই ধরা পড়ে যায় লালপায়ে প্যাডেমেলনরা। একমাত্র খর্বকায় ক্যাঙারু-সদৃশ এই প্যাডেমেলনরাই গিম্পি গিম্পির হুলের বিষের প্রতিরোধক্ষমতা তৈরি করতে পেরেছে। আত্মঘাতী উদ্ভিদের পুষ্টিকর পাতাকে তাদের পছন্দের খাদ্য বানিয়ে ফেলেছে। ক্রমে মেরিনা হারলি বুঝতে পারেন, এই বিষবৃক্ষ তবে সবার ঘৃণার পাত্র নয়। প্রকৃতপক্ষে স্থানীয় অভিজ্ঞ পশুপাখি বা পোকামাকড়ের কাছে গিম্পি গিম্পি তেমন সমস্যা নয়। তারা পারতপক্ষে তাকে এগিয়ে চলে। মারাত্মক সমস্যা কেবল মানুষ, ঘোড়া বা কুকুর প্রভৃতি জঙ্গলের নবাগত প্রাণীদের। তাই পূর্ব অস্ট্রেলিয়ার বৃষ্টি অরণ্য অভিযানের সময় সাবধান। কারণ, আপনি ক্যাঙারুর থলিতে ঢুকতে পারবেন না। তবে শুধুশুধু নিজের অপমৃত্যু ডেকে আনবেন কেন বলুন!
সূত্র : দ্যা স্কাল, উইকিপিডিয়া, ইতিহাস ও মিথলজি