নাসির উদ্দিনের ফেসবুক থেকে : মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে দেশে একটি নাটক মুক্তি পেয়েছে। দেশের বহুল প্রচারিত মর্যাদাহীন একাধিক সংবাদপত্র ও অনলাইন মাধ্যম এর মুক্তিদাতা। কোনো ব্র্যান্ডিং বা শিরোনাম না থাকায় আমি এর নামকরণ করেছি আলাদীনের দুই চেরাগ। দুইপক্ষের দুই ব্যাংক হচ্ছে এই দুই আশ্চর্য চেরাগ। রূপকথার কাহিনির মতোই তাদের কাজ কারবার। এমন চেরাগ হাতে পেয়েই একজন আব্দুল হাই বাচ্চু উঠে যান সকল ক্ষমতার উর্ধ্বে। একজন মখাআ'র নাম উঠে যায় দেশের সেরা ধনীদের তালিকায়। এমন আরও অনেক চেরাগ আলী এদেশে গড়ে উঠেছেন রাতারাতি। সেরকম দুই চেরাগ আলীই আলাদীনের দুই চেরাগের পরিচালক ও প্রযোজক।
ঘটনার সূত্রপাত বাংলাদেশ ব্যাংকের অফসাইট সুপারভিশন নামের একটি তথাকথিত প্রতিবেদন থেকে। অস্তিত্বহীন এই তদন্ত প্রতিবেদনের সূত্র উল্লেখ করে তৈরীকৃত একটি সংবাদ সাংবাদিকদের হাতে ধরিয়ে দেয়া হয় একটি ব্যবসায়িক গ্রুপের পক্ষ থেকে। বাংলাদেশ প্রতিদিন, যুগান্তরসহ বেশ কিছু পত্রিকা ও অনলাইন এই সংবাদটি ফলাও করে প্রচার করে। কার্যত বাংলাদেশ ব্যাংকের অফসাইট সুপারভিশন নামের ঐ তদন্তটিকে বলা হচ্ছে অস্তিত্বহীন। এই অস্তিত্বহীন তথ্যের ভিত্তিতে প্রকাশিত সংবাদটি সর্বত্র ছাপা হয় প্রায় অভিন্ন ভাষায়। মনে হবে এটি সংবাদ নয় প্রেস রিলিজ। সংবাদে এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও নাসা গ্রুপের কর্ণধার নজরুল ইসলাম মজুমদারের বিরুদ্ধে দুই হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ করা হয়।
বলা হয়, বন্ডেড ওয়্যারহাউসের অপব্যবহার করে আমদানি-রপ্তানি জালিয়াতির মাধ্যমে তিনি এই টাকা লোপাট করেছেন। নাসা গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণসীমার অতিরিক্ত ঋণগ্রহণের অনিয়ম, এবং বন্ডের সুবিধা নিয়ে আমদানি বেশী রপ্তানী কম করে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি। এছাড়া ব্যাংক খাতের (বিএবি সভাপতি) নেতৃত্বের প্রভাব খাটিয়ে ব্যবসার অন্তরালে তার মালিকানাধীন নাসা গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে আমদানি-রপ্তানি দেখিয়ে ২১০ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছেন। আমদানিকৃত পণ্য বাইরে খোলাবাজারে বিক্রির কথাও বলা হয়েছে সংবাদটিতে। এসব করতে গিয়ে ঋণের বিপরীতে শর্ত পরিপালনের বাধ্যবাধকতাও লঙ্ঘন করা হয়েছে।
সংবাদটি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল বা অথেনটিক মনে করেনি বলে প্রথম আলোসহ কিছু পত্রিকা ও অনলাইন সংবাদটি প্রকাশ করেনি। এটি ছিলো আলাদীনের চেরাগের দুই মালিক গ্রুপের বিনোদনের প্রথম পর্ব।
গত ২৭ মে প্রথম আলোসহ বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের মাধ্যমে আমরা বিনোদনের দ্বিতীয় পর্বও দেখেছি। গুলশান থানায় একটি মামলার বরাত দিয়ে এসব নিউজে বলা হয়, অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে ৫শ কোটি টাকা ঋণ দিতে এক্সিম ব্যাংকের এমডিকে চাপ এবং গুলি করে হত্যার চেষ্টা হয়েছে। বিদেশি নিরাপত্তা কর্মীদের দিয়ে নির্যাতনের হুমকি এবং সাদা কাগজে স্বাক্ষর রাখার অভিযোগও ছিলো সংবাদে। এবারের অভিযোগকারী আগের পর্বের অফসাইট সুপারভিশনের ভিকটিম এক্সিম ব্যাংক। আর অভিযোগ সিকদার গ্রুপের এমডি রন হক সিকদার ও তাঁর ভাই দিপু হক সিকদারের বিরুদ্ধে। গত ৭ মে বনানীর সিকদার হাউসে ঘটনাটি ঘটেছে বলে মামলায় উল্লেখ করা হয়েছে।
অবস্থদৃষ্টে দেখা যাচ্ছে, দুটি গ্রুপ তাদের প্রতিপক্ষের দুর্বল জায়গা চিহ্নিত করেই খেলায় নেমেছে। যেমন নাসা গ্রুপের অনিয়মের জায়গা গুলো যথার্থ। দেশের সকল গ্রুপই এ অনিয়ম করে থাকে। ব্যবসায়ীদের কাছে এসব অভিযোগ পান্তাভাত। আবার সিকদার গ্রুপের কর্ণধার জয়নুল হক সিকদার এবং তাঁর সন্তানদের দোর্দণ্ড প্রতাপ এবং দাপট সম্পর্কে সবাই ওয়াকিবহাল। তারা দেশে একজনকে ছাড়া অন্য কাউকে পরোয়া করে না। স্বভাবতই সকল মহল এই দুটি অভিযোগকে যে বিশ্বাস করবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু ঘটনা এই দুই অভিযোগের মধ্যের নয়। ঘটনা হচ্ছে যা কেউ দেখছে না, দেখছে শুধু চেরাগের দুই মালিক।
এখন চলছে তৃতীয় পর্ব। প্রথম পর্বে আমরা কিছু মিডিয়াকে সরব দেখেছি। দ্বিতীয় পর্বে তারা প্রায় নিরব, সরব হয়েছে প্রথম আলো। পত্রিকাটি তার দ্বিতীয় পর্বের ভূমিকার পক্ষাবলম্বনকে গ্রহনযোগ্য করতে আজ বৃহস্পতিবার সে বিশিষ্ট ব্যাংকার ইব্রাহীম খালেদকেও মাঠে নামিয়েছে। পত্রিকাটির একজন সাংবাদিক বাংলা সিনেমার ডায়লগ ব্যাবহার করে মতামত কলাম লিখেছে। প্রথম আলো যা সচরাচর করে থাকে। অর্থাৎ একটি সংবাদ ছাপানোর পক্ষে ক্যাম্পেইন করে এর বিশ্বাসযোগ্যতা দাঁড় করানো। ভয়, পাছে পত্রিকাটির বিশ্বস্ততায় না আঁচড় পড়ে যায়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে দুই গ্রুপের দ্বন্দ্বে পত্রিকাগুলোর পক্ষাবলম্বন কি বিনা স্বার্থে?
একসময়ের ঘনিষ্ট এই দুই গ্রুপ পরস্পরের দুর্বলতাগুলোর কিছু পালক সামনে এনেছে। এরা কেউ বলছে না কোন গ্রুপ কোন ব্যাংক থেকে কত শ বা হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। ঐসব ঋণের বিপরীতে ইকুইটি যথাযথ দেয়া আছে কিনা। বা কে কিভাবে ব্যাংকটিকে তার পারিবারিক প্রোপার্টি বানিয়েছে। অর্থাৎ কেউ কাউকে উলঙ্গ করছে না। কারণ ওরা যে আকাশে বাস করে সেখানে বসতি অভিন্ন। তাদের নাটাই যেখানে, সেখান থেকে টান পড়লে খেলা শেষ।
এখন নাটাইয়ের টানের অপেক্ষা চলছে। সেই টানের খবর আম জনতা জানবেও না। নতুন কোনো এক ঘটনা পেলে আম জনতা না বুঝে হৈচৈ শুরু করবে। বাঙ্গালির যা স্বভাব। একদিন চতুর্থ ও শেষপর্বে দেখা যাবে ওরা দুইভাই গলাগলি করছে। ২ হাজার কোটি টাকার অভিযোগ এবং এমডিকে গুলি করার অভিযোগও তখন দৃশ্যপট থেকে হাওয়া হয়ে যাবে। এ-র মাধ্যমে হয়তো আশ্চর্য প্রদীপ তাদের জন্য চিচিংফাঁক বলে নতুন করে ধন যোগ করবে।
এই হচ্ছে আমার সোনার বাংলা, এই আমার স্বাধীনতা। যে দেশের মুক্তিযোদ্ধারা মাস শেষে ক'টা টাকা ভাতার (ভিক্ষার) অপেক্ষায় থাকে। আর অমুক্তিযোদ্ধা চেরাগ আলীর দল আশ্চর্য চেরাগের বদৌলতে দেশের ডুগডুগি বাজায়।
ফেসবুক থেকে