অজয় দাশগুপ্ত
আমাকে যদি প্রশ্ন করা হয়, কোন বিষয়টি আমার জীবনকে গৌরাবান্বিত করেছে? বলব, আমি মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা দেখেছিলাম। যদি প্রশ্ন করা হয়, কোনটি আমার জন্য বেদনার? বলব, আমার শরীরে আছে পরাধীনতার রক্ত। আমি স্বাধীন বাংলাদেশে জন্মাতে পারিনি। আজ চল্লিশোর্ধ্ব স্বাধীনতা দিবসে যারা এদেশে জন্মে প্রায় প্রবীণ হবার পথে তাদের কাছে আমার একটাই প্রশ্ন, একবারও কি এই স্বাধীন জন্মের জন্য মাতৃভ‚মিকে সালাম বা কুর্নিশ জানিয়েছেন? ভেবেছেন কখনো দেশ স্বাধীন না হলে আপনি যে জাতীয় সংগীতটি গাইতে বাধ্য হতেন তার কোনো অর্থ আপনি বুঝতেন না। একবারও ভেবেছেন বিদেশে আপনার দেশের নামের জন্য পরিচয়ের জন্য ভাবমূর্তি বা ইমেজের জন্য আপনার লজ্জার অন্ত থাকত না? আপনি নিরীহ, ভদ্র বা শান্ত যাই হোন না কেন দুনিয়া আপনার পাসপোর্টটি দেখলেই চোখ কপালে তুলে ভাবত আপনি একজন সন্ত্রাসী। আপনার পাসপোর্টটি দাখিল করার পরপরই সভ্য দেশের এয়ারপোর্টের মানুষদের ভিতর কানাঘুষা শুরু হয়ে যেত। তারা পরস্পর এমনভাবে ফিসফিস করে কথা বলা শুরু করতেন তখন ভাবতে বাধ্য হতেন আপনি একজন দাগী আসামি বা ডাকাত টাইপের কেউ। আপনার দেশের আকাশসীমা দিয়ে উড়ে যাওয়ার সময় বিদেশি বিমান মাটি থেকে গুলি বা রকেট লঞ্চারের ভয়ে রাতে আলো নিভিয়ে দিলে আপনার মনে কী খুব খুশির বাতাস বয়ে যেত? যে ক্রিকেট আপনার প্রাণ সে খেলাটি খেলতে যদি কেউ না আসত কেমন লাগত আপনার?
দুই. আপনি যে দেশে জন্মেছেন বা আমরা যারা যে দেশের নাগরিক হয়ে আজ একটি সুমধুর ভাষার মালিকানা পেয়েছি, সেটি কি আমাদের হাতে থাকত? আপনার কি একবারও মনে হয় না আমাদের পাশের বাংলা রাজ্যটিও বাঙালির? তাদের ভাষা, পোশাক, খাবার, সংস্কৃতি হুবহু আমাদের মতো হবার পরও তাদের কপালে আজ হিন্দির তকমা? তাদের কথাও এখন বোঝা মুশকিল। যত অন্যায়, অপশাসন আর ভেদাভেদ থাকুক না কেন আমাদের সমাজ বাংলাকে কখনো অমর্যাদা করেনি। (অংশবিশেষ)।
উএকবার ভাবুন কত মায়া আর ভালোবাসা আমাদের। এখনো একজন মানুষের জীবন বা মৃত্যুই এদেশের প্রধান আলোচিত বিষয়। স্বাধীনতার সবচেয়ে বড় সুফল আপনি বাদ-প্রতিবাদ কিংবা আনন্দ-বেদনা যখন যাই করেন না কেন সে আপনার নিজস্ব। এমন কেউ নেই যে আপনাকে বলতে পারে তোমার ভাবার বা প্রতিক্রিয়ার অধিকার নেই। সরকার আপনার বিরোধী কিংবা নিজের হতে পারে। রাষ্ট্র কখনো আপনাকে তার ছায়ার বাইরে রাখেনি। এমন একটি দেশ যাদের যারা রক্তে সংগ্রামে এমন একটি ভ‚-খÐ, পতাকা আর সংগীত পেয়েছিল তাদের কি দেশপ্রেমহীনতা মানায়?
তিন. কে আপনাকে বলেছে সবটাই খালি নেগেটিভ? আপনি অপপ্রচারে কিংবা ষড়যন্ত্রে বুঁদ থাকলে ভিন্নকথা। তা না হলে আপনি দেখতে পাবেন তরতর করে এগিয়েছে অনেককিছু। এমন সমাজ বা এমন শক্ত জায়গা আমাদের যৌবনে ছিল না। আমরা কবে বিদেশ থেকে জাহাজে করে জন, মাইকেল, কেলি শেলীদের ফেলে দেওয়া কাপড় আসবে তারপর সেকেন্ডহ্যান্ড মার্কেট থেকে কিনে পরব সে আশায় দিন গুনতাম। তখন জিন্স কড বা সূতি সবকিছু ছিল অনুদানের মাল। আমাদের জীবনের এক বিরাট অংশে আমরা জানতাম চাল না এলে ভাত জুটবে না এদেশে। শুধু কি তাই? বিদেশের চাল সময়মতো আসেনি বলে জাতির জনকের শাসনের সময় তাকে হত্যার চক্রান্ত পোক্ত হতে পেরেছিল। আর আজ? কাপড় আমরা বানাই। দুনিয়ার দেশে দেশে বড়লোকদের বাজারে শপিং মলে মেইড ইন বাংলাদেশ এখন ইজ্জতের মালামাল। আমাদের আর খাদ্যের জন্য অন্য কারও দয়ার ওপর নির্ভর করতে হয় না। আমাদের ঔষধ একদা কবিরাজি আর হোমিওপ্যাথি হলেও এখন আমরা এলোপ্যাথিক ঔষধ রপ্তানি করি। আমাদের যত টিভি, যত চ্যানেল, যত সংবাদপত্র, যত অনলাইন পোর্টাল অনেক দেশে তার একশ ভাগের একভাগও দেখা যায় না। নেই নেই আর হতাশ হবার ভাবটা আমাদের মজ্জাগত। তা না হলে আপনি ঠিকই দেখতে পাবেন কতদূর এগিয়েছে বাংলাদেশ।
চার. অনেক পাপ ও সাফ হয়েছে এই দেশে। যেসব মানুষেরা রাজনীতির নামে এদেশ ও জনগণের বিরুদ্ধে কাজ করত যারা তদের প্রভু পাকিস্তানকে ভুলতে পারেনি। যারা ছলে-বলে-কৌশলে দেশকে আফগানিস্তান বানাতে চেয়েছিল, আজ তারা হতদ্যোম। তাদের অগ্রজেরা যারা আমাদের ভাই-বোন, মা-বাবাদের প্রাণ নিয়েছিল। ইজ্জত লুটেছিল তাদের অনেকেই ঝুলে গেছে। এটা ইতিহাসের দায়। সময় মিটিয়েছে। এই দেশ তা এমনই। যখনই মনে হয় তার আর বোধকরি সময় নেই বা সে আর পারবে না তখনই রুখে দাঁড়ায়। এই মাটিও এমন, সহ্য করতে করতে একসময় উঠে দাঁড়ায়। এমন আঘাত করে দুশমনের বাবারও সাধ্য নেই পাল্লা দেয় তার সঙ্গে। আজ যেসব তরুণ-তরুণী বা যৌবনের মানুষেরা এদেশ নিয়ে নেগেটিভ ভাবেন তাদের কাছে বলি, প্রণত হও। আনত হও। নিজের বিবেকের কাছে প্রশ্ন রাখো, তোমরা দেশকে কি দিচ্ছ? সেসব মানুষ ও তাদের কর্মের কাছে যাও যারা নিজেদের জীবন যৌবন তুচ্ছ করে আমাদের একটি পরিচয় ভ‚মি দিয়ে গেছে।
পাঁচ. স্বাধীনতা কোনো পুস্তকে ইতিহাসে বা আকৃতিতে ধরে না। কোনো দিবসেও তাকে বাঁধা যায় না। তার একটাই পরিচয় সে মুক্ত। সে অর্থে আমাদের আরও বহুদূর যেতে হবে। সে কারণে বাংলাদেশের ভিতরে-বাইরে বিশ্বাস-অবিশ্বাস আর বিভেদের জঞ্জাল সাফ করে যেদিন আমরা মুক্তকণ্ঠে জয় বাংলার জয় বলতে শিখব স্বাধীনতা সেদিনই তার জীবনকে নিরাপদ মনে করবে। জয় হোক বাংলাদেশের। তার অস্তিত্ব হোক অবিনাশী। হীনমন্যতার দিন শেষ। যা কিছু অর্জন তাকে সামনে নিয়ে এগোনো এখন অবশ্যই সম্ভব। আমরা পারিনি। পরাধীনতার রক্ত পারেনি। যারা মুক্ত দেশের প্রজন্ম তারা নিশ্চয়ই নিজেদের বড় ভাবতে শিখছে। কারণ এই ভাবনাটার নামই স্বাধীনতা। আর যারা বড় তারা সেভাবেই বড় হয়ে উঠেছে বিশ্বে।
লেখক: সিডনি প্রবাসী, কলামিস্ট ও বিশ্ববিদ্যালয় পরীক্ষক