আলতাফ পারভেজ: করোনা নিয়ে আমেরিকার মিডিয়াগুলোতে এ মুহূর্তে মাতম চলছে। এই আহাজারির একটা বড় অংশ হলো কিউবায় কেন এখনো রোগটি শনাক্ত হয়নি। হ্যাঁ কিউবায়ও ২-৪ জন করোনায় আক্রান্ত মানুষ হয়তো মিলবে শেষ পর্যন্ত। তবে দুনিয়াজুড়ে স্বাস্থ্য নিয়ে ... আলাপ উঠলে তাতে কিউবার প্রসঙ্গ আসবেই। করোনার সূত্রে আবার সেই আলাপ বিশেষ মনোযোগ পাচ্ছে গত কয়েকদিন। স্বাস্থ্য খাতে কিউবার অর্জনগুলো থেকে শিক্ষা না নিয়ে আসলে উপায় নেই কারও। বিশেষ করে যারা নাগরিকদের সুস্থ জীবনকে মূল্যবান মনে করে। কিউবাকে ঘিরে আমেরিকার অর্থনৈতিক অবরোধে আছে ৬০ বছর হলো। এই অবরোধে ওষুধও আটকানো হয়। কিন্তু ছোট্ট কিউবায় পাঁচ বছর পর্যন্ত শিশুমৃত্যুর হার আমেরিকার চেয়েও কম। হাজারে ৫.৫ জন। আর যুক্তরাষ্ট্রে ৬.৫ জন। হয়তো অনেকেই জানি আমরা বিশ্বে শিশুমৃত্যুর গড় হার হাজারে ৩০-এর নিচে নামানোর বহু চেষ্টা চলছে। আবার মানুষের বেঁচে থাকার গড় দৈর্ঘ্যওে দেশটি অনেক এগিয়েছে প্রায় ৭৯ বছর এখন। এটা আমেরিকায়ও একই সমান। কিন্তু কিউবায় জনপ্রতি স্বাস্থ্য খরচ আমেরিকার তুলনায় দশভাগের একভাগ মাত্র।
দেশটি নানা রোগের ভ্যাকসিন নিয়েও গবেষণা করছে। ১৯৮৫ সালে তারা মেনিনজাইটিসের ভ্যাকসিন বের করে। কিছুদিন আগে তারা লাঙ ক্যান্সারের ভ্যাকসিনও বের করেছে। মা থেকে সন্তানে এইচআইভি ছড়ানো পুরোপুরি বন্ধ করতে পেরেছে তারা ২০১৫ সালে। ‘করোনা’ মোকাবেলায় চীন যে কিউবার ওষুধ প্রযুক্তি ‘ইন্টারফেরন আলফা টু-বি’ ব্যবহার করছে সেটা ইতোমধ্যে বিশ্ববাসী জানে। কিউবায় স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় এসব অর্জন এসেছে পরিকল্পিতভাবে। চিকিৎসা সাংবিধানিকভাবে দেশটির ‘অগ্রাধিকারমূলক বিষয়’। এটা সেখানে রাষ্ট্রের দায়িত্বের বিষয়। ওষুধও তাই। জনগণের স্বাস্থ্যকে বাজার অর্থনীতির উপর ছেড়ে দেওয়া হয়নি। জিডিপির ১১ শতাংশ তারা জনস্বাস্থ্যে খরচ করছে। বাংলাদেশে এটা হয়তো ২ শতাংশের মতো। দীর্ঘস্থায়ী অবরোধে বিপন্ন অর্থনীতির মাঝেই কিউবা নাগরিকপ্রতি ডাক্তারের সংখ্যায় বিশ্বে বিস্ময়করভাবে এগিয়ে। হাজারে ছয়জন। যুক্তরাষ্ট্রে হাজারে তিনজনের কম। আর বাংলাদেশে দুই হাজারে একজন। কয়েক বছর আগে পুরো দক্ষিণ আমেরিকা যখন জাইকা ভাইরাসে বিপর্যস্ত কিউবা তখন সেটার মোকাবেলায় মডেল দেশ হয়ে উঠেছিলো। সোয়া কোটি মানুষের দেশটিতে হাসপাতালগুলো ১৫ হাজার বিশেষ কর্মী নামিয়ে দিয়েছিলো ঘরে ঘরে প্রতিরোধমূলক কাজের জন্য। বিশ্বের অন্যতম বড় মেডিকেল কলেজটিও (ইএলএএম) কিউবায়। প্রায় ১১০টি দেশের শিক্ষার্থীরা এখানে পড়তে যায়। টিউশন ফি ছাড়াই সেখানে পড়ে সকলে। এ রকম আরও তথ্য দেওয়া যায়। লেখা বড় করছি না।
প্রশ্ন হলো চরম অর্থনৈতিক অবরোধে থেকেও মধ্য আয়ের একটা দেশ স্বাস্থ্য খাতে এতো সব কিছু কীভাবে অর্জন করলো কীভাবে? উত্তর সহজ, মানুষের শরীর-স্বাস্থ্যকে সমাজ পরিকল্পনায় সর্বাগ্রে রেখেছে তারা। এটা সেখানে একটা সমন্বিত পরিকল্পনায় হয়েছে। যেমন : গর্ভবতী একজন নারী সেখানে ১০ মাসে অন্তত ১২ দফা ডাক্তারের দেখা পান। আবার মাতৃত্বকালীন ছুটি ১২ মাস। আবার দেশটির পার্লামেন্টের অর্ধেক বেশি সদস্য নারী। শিশুরা জন্মের পর সেখানে স্বাভাবিক অবস্থাতেই প্রতি ১৫ দিনে একবার চিকিৎসকের নজরদারি পায়। কিউবার সব ডাক্তারদের অর্ধেক নিযুক্ত প্রাথমিক স্বাস্থ্য খাতে। প্রতি ৩০০টি পরিবারের জন্য ডাক্তার-নার্সদের একটা দল দায়িত্বপ্রাপ্ত। এভাবে সমন্বিত অনেক পদক্ষেপ একসঙ্গে করে সেখানে স্বাস্থ্য খাতের ভিত গড়া হয়েছে। এ সব লেখা পড়ে অনেকে ভাববেন, কমিউনিস্ট আদর্শকে এখানে প্রমোট করা হচ্ছে। আসলে কিউবার এই অর্জন পুরো বিশ্বের শুভচিন্তার মানুষদের এক বহু পুরনো স্বপ্ন সফল করার নিরীক্ষা মাত্র। যে স্বপ্নের মূলকথা হলো চিকিৎসা হতে হবে মানুষের মৌলিক অধিকার।
নিজ দেশের পাশাপাশি বিশ্বের প্রায় দেড়শ দেশে এ পর্যন্ত কিউবার প্রায় তিন লাখ স্বাস্থ্যকর্মী কাজ করেছে। এখনো এ রকম অন্তত ৫০ হাজার মানবসম্পদ বিভিন্ন দেশে আছে। প্রচুর বিদেশিও কিউবায় চিকিৎসা নিতে যায়। বছরে এ সংখ্যা অন্তত ২০ হাজার। পর্যটনের পরই এ খাত থেকে তাদের আয় বেশি। মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার আয় করছে তারা ডাক্তার রপ্তানি করে আর চিকিৎসাসেবা দিয়ে। সেই ডলার আবার তারা দেশের মানুষের সুস্বাস্থ্যের জন্যই বিনিয়োগ করছে। কিউবার অভিজ্ঞতা থেকে একটা বিষয় স্পষ্ট জনপ্রতিনিধিরা যদি সিদ্ধান্ত নেন জনস্বাস্থ্য হবে তাদের সর্বাগ্রের চিন্তা তাহলে এ রকম একটা স্বাস্থ্য ব্যবস্থা বিশ্বের সব দেশ পেতে পারে। এর জন্য প্রথম সিদ্ধান্তটি নিতে হবে এই যে, নাগরিকদের স্বাস্থ্য ব্যবসায়ীদের হাতে ছেড়ে দেওয়া হবে না। এই সিদ্ধান্ত নেওয়া গেলে আজ ও আগামীকালের সব ভাইরাসযুদ্ধে জয়ও সহজ হয়ে যাবে। বিষয়টি আসলে নাগরিকদের হাতে এবং নাগরিকদের প্রতিনিধিদের হাতে। ফেসবুক থেকে