কামরুল হাসান মামুন : আমি জানতাম ওমর রহমান সম্পদই আমাদের একমাত্র ছাত্র যে কিনা আমেরিকান ন্যাশনাল ল্যাব অর্থাৎ ইৎড়ড়শযধাবহ ন্যাশনাল ল্যাবে ঃবহঁৎবফ পজিশন পেয়েছে। এখন জানলাম আমার আরও দুই ছাত্র তৌফিক হাসান এবং হাসনাইন হাফিজ আমেরিকার বিখ্যাত খড়ং অষধসড়ং ঘধঃরড়হধষ ল্যাবে পোস্ট-ডকের অফার পেয়েছে। আমার আরেক ছাত্র সাব্বিরও আরেক ল্যাবে পোস্ট-ডক পেয়েছে এবং ওর গবেষণা প্রোফাইল যেই গতিতে এগোচ্ছে তাতে নিশ্চিত ও একদিন খুব ভালো করবে। এখন বুঝুন পৃথিবীর সর্বনি¤œ বাজেট বরাদ্দ সত্ত্বেও আমাদের ছাত্রছাত্রীদের মেধারগুণে ওই পর্যন্ত যেতে পেরেছে। সঠিকভাবে মানসম্পন্ন আরও ভালো মানের শিক্ষক নিয়োগ দিলে, আরও বেশি বরাদ্দ দিয়ে ভালো পরিবেশের নিশ্চয়তা দিলে আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি আমাদের ছাত্রছাত্রীরা বিশ্বকে সত্যিকার অর্থে তাক লাগিয়ে দিতে পারতো। অনেকেই বলে তাদের পেছনে শ্রম ও অর্থ ব্যয় করে কি লাভ? তারা তো দেশে ফিরে আসবে না।
প্রথম কথা হলো তারাই একেকজন আমাদের বাংলাদেশের সত্যিকারের অ্যাম্বাসেডর। তারা যতো ভালো করবে বাংলাদেশ সম্বন্ধে বিশ্বের সেরা মানুষদের মাঝে একটি পজিটিভ ধারণা সৃষ্টি হবে। চীন, ভারত এবং কোরিয়া যা ইতোমধ্যেই এই কাজটি করে ফেলেছে। আমাদের ছাত্ররা পোটেনশিয়াললি তাদের চেয়ে অনেক বেশি মেধাবী। আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বের ব্যর্থতার কারণে আমরা পিছিয়ে পড়ছি। তারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এমনভাবে রাজনীতি ইঞ্জেক্ট করেছে যে ওই মেধাবীদের একটি অংশ আসতে চাইলেও আসতে পারে না। তাদের মধ্যে শঙ্কা আসলে চাকরি পাবে না। এক রাজনৈতিক দলের এক নেতার এক ছেলের কথা বলি। ছেলেটি খুবই মেধাবী। ভালো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভালো সুপারভাইজারের অধীনে পিএইচডি করে আরেক সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পোস্ট-ডক করে দেশে ফিরে আসার জন্য খোঁজ-খবর নিতে গেলে তাকে স্পট জানিয়ে দেয়া হয় তাকে নেয়া হবে না। ক্ষতি হলো কার? অথচ শুনেছি বাপ রাজনীতিবিদ হলেও ছেলের মধ্যে রাজনীতির ছিটেফোঁটাও নেই।
থাকলেইবা কি? দুয়েকজন ভালোরা ফিরে এসেছে তো। তাদের আসার পেছনে আমাদের অনেকের ছোটখাটো অনুপ্রেরণা ছিলো। কিন্তু আসার পর থেকে প্রশাসনের পক্ষ থেকে এমন বাঁশ দিচ্ছে যাতে ফিরে আসার প্রায়শ্চিত্ত হয়। ভারত আইন করে দিয়েছে কেউ যদি ওয়ার্ল্ড ৎধহশরহম-এ থাকা ৫০০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো একটি থেকে পিএইচডি করে ফিরে আসে তাকে সরাসরি সহকারী অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ দেবে। আমরা কেন এমন নিয়োগের ব্যবস্থা করি না। করলে আমাদের ভালো শিক্ষকের যে সংকট আছে সেটা অনেকটা কেটে যেতো। কিন্তু করবো না, কারণ এতে বিরোধীদলের রাজনীতির লোকজন যদি ঢুকে যায়? আরে বাবা, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষকদের দলীয় লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি উঠিয়ে দিন। এই দলীয় লেজুড়বৃত্তির রাজনীতির কারণে শিক্ষকরা এখন সাদাকে সাদা বলতে পারেন না। তারা সবাই কালার ব্লাইন্ড হয়ে গেছে।
এর ফলে ছাত্রদের মাঝ থেকে শিক্ষকদের উপর আস্থা বিশ্বাস উঠে গেছে। শিক্ষক তো শিক্ষকতা আর গবেষণা করবে। রাজনীতি করতে গেলে শিক্ষকতা ও গবেষণায় টানতো পড়বেই। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় বলে যা ইচ্ছে তা করার লাইসেন্সই আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে নষ্ট করে ফেলেছে। লেজুড়বৃত্তি রাজনীতি না করা মানে রাজনীতি বন্ধ নয়। রাজনীতি করবে, কিন্তু সেটা এক্টিভিস্ট হিসেবে নয়। মূল কাজকে অবহেলা করে নয়। আমি তো এখন শিক্ষক দেখি না। আমি কেবল ফুল টাইম রাজনীতিবিদ আর পার্ট টাইম শিক্ষক দেখি। এসব করে দেশের বারোটা বাজিয়ে ছাড়ছে। আবার বলছি লেজুড়বৃত্তি রাজনীতি না করা মানে রাজনীতি বন্ধ নয়। শিক্ষকরা সত্যি কথা বলবে। সমস্যার কথা জানাবে। অন্যায়ের প্রতিবাদ করবে। ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করবে। এগুলো করতে হলে কোনো একটি দলের এক্টিভিস্ট হওয়ার তো দরকার নেই। দল করা মানে একটি দলের আনুগত্য গ্রহণ করা। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তো থাকবে মুক্ত। সম্পূর্ণ মুক্ত। না হলে সত্য দেখবে কীভাবে? ছাত্রছাত্রীদের সত্য চেনাবে কি করে? ফেসবুক থেকে