মো. মহিবুবুল হক: আমি জীবনে সফল হতে চাইনি, বড় হতে চাইনি, আমি স্রেফ আমার আগ্রহের কাজটা করে যেতে চেয়েছি। ভবিষ্যতেও তাই করবো। কী আশা জাগানিয়া,আত্মবিশ্বাসের কথা!! চারপাশে ছোট ছোট বঞ্চিত হবার ইতিহাস যার ভাবনার জগতে নতুন আলো ফেলে তিনিতো এমন হবেনই। তিনি বিশ্বাস করেন অর্থের বিকেন্দ্রীকরণের কথা। তিনি বলেন, গরিবের হাতে অর্থ বন্টন আর ব্যয়ের অধিকার দিলে দারিদ্র জাদুঘরে যাবে। মানুষের ক্ষমতায়নের মূলে আছে অর্থের সুষম ও উৎপাদনশীল বন্টন। এ কথাগুলোই গবেষণার নিবন্ধে আর আলোচনার প্রতিটি ছত্রে বলে যাচ্ছেন বাঙালি অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক অভিজিত বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়। দ্বিতীয় বাঙালি হিসাবে অমর্ত্য সেনের পর নোবেল পুরস্কারে নিজেকে ও নিজের জাতিকে গৌরবান্বিত করেছেন। ম্যাসাচুসেট্স ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজির (এম.আই.টি) অধ্যাপক অভিজিত। এবার (২০১৯) অর্থনীতিতে নোবেল পান তাঁর স্ত্রী এসথার ডুফলো ও মাইকেল ক্রেমারের সাথে। এ ত্রয়ী অর্থনীতিবিদের মূল ভাবনা আছে Poor Economics গ্রন্থে। এখানেই তাদের চিন্তার দর্শন ও ফলাফলের নিরীক্ষা আছে বিষদভাবে। ফরাসি স্ত্রী এসথার ডুফলো অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন মাদার তেরেসা হতে, আর ছয় বছর বয়সে স্বামী অভিজিত বিনায়ক অনুপ্রেরণা পেলেন বিশ্বখ্যাত পরিসংখ্যানবিদ প্রশান্ত চন্দ্র মহালনবিশ ও বুদ্ধদেব বসু হতে।
মাদার তেরেসার জীবন নিয়ে রচিত একটি কমিক বই পড়ে ডুফলো অবাক হলেন, কারণ সেখানে কলকাতার শহুরে জীবনে জনপ্রতি মানুষের জন্য ১০ বর্গফুট জায়গা বরাদ্ধের চিত্র তুলে ধরা হয়েছিল।
সরেজমিনে তা দেখার জন্য ডুফলো যখন কলকাতায় আসলেন, তখন শহুরে চিত্রের সাথে কমিক বইয়ে লিখিত বর্ণনার মিল পেলেন না। কলকাতার তিনি যেদিকে তাকান সেদিকেই খালি জায়গা, গাছ, পিচ ঢালা রাস্তায় খালি ফুটপাত। বয়স তাঁর তখন ২৪। MIT এর স্নাতক শ্রেণির শিক্ষার্থী। মনে একটা প্রশ্নই ঘুরপাক খেতে লাগলো, শহরের এতো মানুষ কোথায় গেল।
অন্যদিকে স্বামী অভিজিতের কাছে তার ছয় বছরে বয়সে তথ্য ছিল গরীবেরা কোথায় থাকে। কলকাতার তাদের বাড়ির পেছনে দিকে ভেঙ্গে পড়া বাড়িগুলোতে গরীবেরা থাকতো। গরীবদের বাচ্চাদের ছিলো অফুরন্ত সময়, তারা যেকোন খেলায় অভিজিতকে হারিয়ে দেবার সামর্থ্য রাখতো। এ কারণেই অভিজিত তাদের ইর্ষা করতো।
এভাবেই তিনি ও তার মতো মানুষেরা অবহেলিত জনগোষ্ঠীর জীবনকে মহিয়ান করে তুলেছেন তাদের লেখায় ও ভাবনায়।
মূলত এভাবেই দুজনের ভাবনায় দারিদ্র উঠে আসে।ব্যক্তি অভিজিত জীবনের প্রারম্ভে পরিসংখ্যানের প্রতি অন্য রকম আগ্রহে ভাসতেন, গনিতেও বেশ দক্ষ ছিলেন। প্রথমে পদার্থ বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলেন, গনিতকে বেশি কাজে লাগাবেন এই উদ্দেশ্যে, কিন্তু মজা পেলেন না। বেছে নিলেন অর্থনীতি। তাঁর বাবা-মা দুজনেই অর্থনীতির শিক্ষক ছিলেন।
প্রচ্ছন্নভাবে পিতা-মাতার পেশাগত আনন্দ হয়তো তাকে টেনে ছিলো বিপরীত দিক থেকে। ১৯৬১ সালে মুম্বাইয়ে জন্ম নেয়া অভিজিত, যার বেড়ে ওঠা কলকাতার বাঙ্গালি সমাজে হয়ে উঠেন অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক অভিজিত বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়। বর্তমানে অধ্যাপনা করছেন এম আইটি, আমেরিকাতে। এখন তিনি অবশ্য মার্কিন নাগরিক।
তিনি অবদুল লতিফ একশন ল্যাবের সহপ্রতিষ্ঠাতা। এ ল্যাব ২০০৩ সালের প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই বিষয়ভিত্তিক গবেষণা করে পৃথিবী হতে দারিদ্র নির্মূলে বদ্ধপরিকর। পৃথিবীতে প্রতিনিয়তই বিষয়ভিত্তিক নানা তত্ত্ব উদঘাটিত হচ্ছে, একই বিষয়ের এক তত্ত্ব আরেক তত্ত্বের প্রতিরুপ, একই রকমের তত্ত্বের মধ্যকার সাদৃশ্যকে খুঁজে এনে ফলিতজ্ঞান বিতরণই কার্যকর পন্থা হতে পারে বলে অধ্যাপক অভিজিৎ বিশ্বাস করেন। এ বিষয়ের ব্যাপকতা সামাজিক বিজ্ঞানে আরো অধিক। তিনি চান দারিদ্র নির্মূলের উপর প্রতিষ্ঠিত তত্ত্ব সমূহের মূল বক্তব্য এক করে কার্যকর কিছু করা, যাতে করে সুফল স্বল্প সময়ের মধ্যেই দৃশ্যমান হয়।
অভিজিত দারিদ্র উৎপাটনে ম্যানুফাকচারিং শিল্পকে বেশি কার্যকর মনে করেন। যদিও এই নিয়ে ভারতে বর্তমান বিজেপি সরকারের বাণিজ্যমন্ত্রী পীযূষ ঘোষাল কড়া সমালোচনা করে বলেছেন, অভিজিৎ বামঘেঁষা অর্থনীতিবিদ। যার বক্তব্য লোকসভার আলোচনায় কোন কাজে আসবে না। এই বিরোধিতার কারণ অবশ্য অন্য, কারণ তিনি কংগ্রেস কতৃক প্রবর্তিত 'ন্যায়' প্রকল্প যা গরিব বেকারদের জন্য মাসিক বিমার নীতির স্বপ্নপুরুষ।
তার নোবেল প্রাপ্তির পর বিজেপি নেতা রাহুল সিনহার বক্তব্য অত্যন্ত শ্রুতিকটুই মনে হলো। তিনি তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন দ্বিতীয় স্ত্রী বিদেশি হলে নোবেল পাওয়া যায়।এরপর মন্ত্রীর প্রতি শ্লেষ ছুড়ে দিলেন নোবেলজয়ীর মা নির্মল বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি নেতা রাহুল সিনহার মন্তব্যকে বাঙ্গালির চরিত্রের সবচেয়ে নগ্ন আচরণ বলে উল্লেখ করেছেন।
মানুষ যেখানে আবিষ্কারের নেশায় নিদ্রাহীন, আমরা সেখানে ব্যক্তির চরিত্র নিয়ে অতিউৎসাহী। অভিজিতকে একজন দল নিরপেক্ষ, নীতি প্রবর্তনে আত্মবিশ্বাসী মানুষই মনে হলো। কারণ পেশাগত অর্থনীতিতে রাজনীতি গৌণ, জনস্বার্থ ও আপমরের কল্যাণই মূখ্য। উন্নয়নশীল বাংলাদেশে যা আজো অধরা। এ অধরা চমকপ্রদ উন্নয়নের ফিরিস্তির মধ্যে সুশাসন নিশ্চিতের কথাই আড্ডার ছলে বলে বেড়াচ্ছেন আমাদের বাঙ্গালি বাবু অধ্যাপক অভিজিত ব্যানার্জি।
লেখক পরিচিতি: সহকারী অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ভান্ডারিয়া সরকারি কলেজ, পিরোজপুর।