শেখ মিরাজুল ইসলাম : ১৪৯৮ সালে ভাস্কো দ্যা গামা উত্তমাশা অন্তরিপ পেরিয়ে ভারতবর্ষের সন্ধান পান। ১৫১০ সালে পর্তুগীজরা গোয়া দখল করলো। ১৫৩৪ সালে গোয়া’র গভর্নর নুনো দ্য কুন বা পাঁচটা জাহাজে দুইশ জন নাবিক ও মাঝি মাল্লা দিয়ে ক্যাপ্টেন মার্টিন এফেনসো ডি মেলো জুসারটিকে বঙ্গ অঞ্চলের সঙ্গে বাণিজ্য করতে চট্টগ্রাম বন্দরে পাঠালেন।
দক্ষিণবঙ্গের উপকূলবাসী সর্বপ্রথম লাল চামড়ার ইউরোপিয়ানদের তাদের তীরে লাল ঝা-ার পাল তোলা সমুদ্রগামী জাহাজ ভিড়তে দেখলো। তখন চলছিলো সুলতান গিয়াসউদ্দীন মাহমুদ শাহের রাজত্বকাল। পর্তুগীজরা সুলতানকে আশ্বস্ত করলো আফগানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তারা সহায়তা করবে। সুলতানের কাছে তারা চট্টগ্রামে দুর্গ বানানোর অনুমতি চাইলো। কিন্তু জুসারটির দলের সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে পড়লো সুলতানের সৈন্যরা। ভুল বোঝাবুঝির জের ধরে সুলতান গিয়াসউদ্দীন সব পর্তুগীজ নাবিকদের বন্দি করে রাখলেন। গোয়ার গভর্নর এবার নয়টি জাহাজে এন্টিনিও ডি সিলভা মেনেসেসের নেতৃত্বে সাড়ে তিনশ লোক পাঠালেন আটকেপড়া পর্তুগীজদের উদ্ধার করতে। সুলতান পাত্তা দিলেন না পর্তুগীজ উদ্ধারকারীদের। ডি সিলভার লোকজন চট্টগ্রামের আশপাশের গ্রামগুলোতে প্রতিশোধমূলকভাবে লুণ্ঠন ও অত্যাচার চালালো। গিয়াসউদ্দীন শাহ ধৈর্য ধরলেন। তাড়াহুড়া করলেন না। জানতেন এই ফিরিঙ্গিদের সাহায্য লাগতে পারে ভবিষ্যতে। তিনি মুক্ত করে দিলেন বন্দি পর্তুগীজদের। এর বিনিময়ে ১৫৩৭ সালে আফগান শের খান গৌড় আক্রমণ করলে সুলতান গোয়ার গভর্নরের সাহায্য চান। তাকে সাহায্য করতে গোয়া থেকে পেরেজ ডি সাম্পায়ো চট্টগ্রামের দিকে আসার পথে খবর পেলেন শের খানের হাতে সুলতান নিহত হয়েছেন। পরবর্তীতে পর্তুগীজদের আনাগোনা বঙ্গোপসাগর সীমানায় ক্রমে বৃদ্ধি পেতে থাকলো। তারা চট্টগ্রাম-কলকাতা-হুগলীতে আস্তানা গেড়ে খৃস্টান ধর্মের প্রচারে জোর করে স্থানীয় অধিবাসীদের ধর্মান্তরিত করতে লাগলো। স্থানীয়রা তাদের গালমন্দ করতো ‘হার্মাদ’ নামে। মূলত ইউরোপের চিনি শিল্প বিকাশে আখক্ষেতে কাজ করার জন্য শ্রমিক হিসেবে এশিয়া ও আফ্রিকা হতে স্থানীয়দের জাহাজে তুলে নিয়ে দাস হিসেবে বিক্রি করতো পর্তুগীজরা। রেশমি-মসলিন কাপড়, মসলাপাতির আড়ালে এটাই ছিলো তাদের মূল ব্যবসা।
পর্তুগীজদের পেছন পেছন ভারত মহাসাগরের কর্তৃত্ব নিতে হাজির হলো হল্যান্ডের নাবিকেরা। ১৬০২ সালে আমস্টারডামে প্রতিষ্ঠিত করা হলো ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। আটলান্টিক ও ভারত মহাসাগরে ছড়িয়ে পড়লো ডাচ নৌবহর। যেখানে পর্তুগীজ ও স্পেনের জাহাজ পেলে সেটাকেই আক্রমণ করে ডুবিয়ে দিতে থাকলো। উদ্দেশ্য ছিলো দাস ব্যবসার একক দখল নেয়া এবং ইন্দোনেশিয়া-মালয়েশিয়া এলাকার মসলা দ্বীপপুঞ্জগুলোর সঙ্গে একচেটিয়া ব্যবসা করা।
১৬০৮ সালে ডাচ নাবিকেরা আরাকান রাজ্যে পৌঁছে একটি উল্লেখযোগ্য বন্দরের ঠিকানা খোঁজেন। তারা সেই বন্দরটিকে উল্লেখ করেছিলেন ঐড়ড়ভংঃধফঃ মানে প্রধান নগর হিসেবে। তিনি আরও শুনেছেন সেই বন্দরটির অপর নাম খরঃঃষব ইবহমধষধ, যেখান থেকে খুব সহজে মেঘনার মোহনা দিয়ে হুগলী হয়ে ভারতবর্ষের যেকোনো প্রান্তে চলে যাওয়া যায় নদী পথে। ততোদিনে পর্তুগীজরা সেই বন্দরকে ঘিরে ব্যবসা বাণিজ্যের পাশাপাশি দস্যুবৃত্তি শুরু করে দিয়েছে। তাদের সঙ্গী হয়েছে আরাকান এলাকার স্থানীয় জলদস্যুরা। নিশ্চয় বুঝতে পারছেন সেই বন্দরের নাম ‘চট্টগ্রাম’। ১৬১৭ হতে ১৬২৩ সালের মধ্যে ডাচরা পর্যায়ক্রমে ইন্দোনেশিয়া, মালাক্কা ও শ্রীলঙ্কার মসলা দ্বীপগুলো পর্তুগীজ ও ব্রিটিশদের হাত থেকে উদ্ধার করে নিজেদের আয়ত্তে নিয়ে আসে। ওদিকে ১৬৩২ সাল থেকে ১৬৫১ সাল পর্যন্ত পর্তুগীজরা আরাকান রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় জলদস্যু থিরির সঙ্গে সন্ধি করে সন্দ্বীপ ও চট্টগ্রাম এলাকা দখল করে রেখেছিলো। ১৬৩২ সালে মুঘল স¤্রাট শাহজাহান পর্তুগীজদের হুগলীতে অবস্থিত শিল্প কারখানা ও ব্যবসা জব্দ করেন। ডাচরা সেই সুযোগে মুঘলদের সঙ্গে সন্ধি করে সেসব এলাকা নিজেদের দখলে নিলেও বঙ্গোপসাগরের জলসীমা পর্তুগীজ, আরাকান, ইংরেজ, ফ্রেঞ্চ, ডাচদের দখলে বিভক্ত থেকে যায়। ‘জোর যার মুল্লুক তার’ অবস্থা চলতে থাকে দক্ষিণের জলসীমায়। ডাচরা ইন্দোনেশিয়ায় ঘাঁটি গেড়ে আরাকান-পর্তুগীজদের সঙ্গে লড়াই চালাতো আর মুঘলরা কখনো ফ্রেঞ্চ বা কখনো ডাচদের সহায়তায় পর্তুগীজ-আরাকানী মিয়ানমারীদের ঠেকিয়ে রাখতো। বিনিময়ে ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি গুজরাট, হুগলী, রাজমহল, মালদা, ঢাকা, আগ্রা, আজমীর নানা স্থানে ছড়িয়ে পড়েছিলো।
১৬৬০ সালে ডাচদের আগ্রাসন ঠেকাতে পর্তুগাল-ইংল্যান্ড বন্ধুত্বের চুক্তি করে। সে হিসেবে পর্তুগালের রাজার মেয়ে ক্যাথরিনের সঙ্গে ইংল্যান্ডের রাজা দ্বিতীয় চার্লসের বিয়ে হয়। পরবর্তীতে ইংল্যান্ডের সঙ্গে এক সন্ধি চুক্তি করে ইন্দোনেশিয়া –মালয়েশিয়ার বিস্তীর্ণ উপকূল নিজেদের অধীনে রেখে ১৭৫৯ সালে ডাচরা ভারত উপমহাদেশ হতে তাদের ব্যবসা গুটিয়ে নেয়। শুরু হয় ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়ার রাজত্বকাল। এখন আবার একবিংশ শতাব্দীতে আরাকান অঞ্চলকে ঘিরে ভারত, চীন, পাকিস্তান, তুরস্ক, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া সেই শত বছর আগের অসমাপ্ত বাণিজ্য যুদ্ধটা নতুন করে যেন শুরু করলো। নিশ্চিত থাকুন... এবারও আতশ কাচের নিচে ঘটনার কেন্দ্রবিন্দুতে যে বন্দরটির নাম বড় হরফে দেখা যাবে, তার নাম ‘চট্টগ্রাম’। ফেসবুক থেকে