মৌরী সিদ্দিকা : ভারতের রাজনীতিতে বিজেপি’র অবস্থান সুসংহত হয়েছিল ‘রথ যাত্রা’ নামে এক কর্মসূচির মধ্যে দিয়ে। -বিবিসি
এই রথযাত্রার পরিকল্পনা হয়েছিল জঙ্গী হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির এক প্রচারমূলক মিছিল হিসেবে। এর সংগঠক ছিলেন বিজেপির নেতা লাল কৃষ্ণ আদভানি। সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, ভারতের মোট ৮ হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে অযোধ্যা পর্যন্ত যাবে। এই রথ যাত্রার মূল দাবি ছিল অযোধ্যায় রামমন্দির নির্মাণের পক্ষে জনমত সংগঠিত করা। জায়গাটি ভারতের সংখ্যালঘু মুসলমানদের কাছেও পবিত্র।
সে সময় সাংবাদিক হিসেবে সেই রথযাত্রা প্রত্যক্ষ করেছিলেন আর কে সুধামন। তার পর কিভাবে বিজেপির উত্থান হয়েছে তাও দেখেছেন তিনি। কথা বলেছেন বিবিসির ফারহানা হায়দারের সাথে।
গুজরাটের সোমনাথ শহর থেকে যখন এই মিছিল শুরু হয়। অযোধ্যায় রাম মন্দির নির্মাণের এই কর্মসূচি শুরু করা ছিল আদভানির দিক থেকে এক মাস্টারস্ট্রোক। এর লক্ষ্য ছিল ক্ষমতায় যাবার জন্য ভারতের হিন্দু ভোটকে নিজেদের দিকে টেনে আনা’ - বলছিলেন সাংবাদিক।
রথযাত্রার নেতৃত্বে ছিলেন আদভানি। তিনি বসেছিলেন একটি ট্রাকে যাকে সাজানো হয়েছিল রামচন্দ্রের রথের আকার দিয়ে। এর মধ্যে ছিল সবরকম সুযোগ সুবিধা। ছিল শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত একটি কক্ষ - যাতে আদভানি জনসভার ফাঁকে ফাঁকে বিশ্রাম নিতে পারতেন।’
‘রথের সামনের দিকটা ছিল খোলা, যেখানে এসে আদভানি জনতার উদ্দেশ্যে ভাষণ দিতে পারতেন।’ ‘একটা প্রাচীন যুগের রথের আকৃতিতে বানানো টয়োটা ট্রাকটি দেখতে হয়েছিল বেশ অন্যরকম। এটা সাজানো হয়েছিল রামের ছবি এবং গেরুয়া রঙ দিয়ে - যা বিজেপির রঙ। ফলে ট্রাকটার একটা পৌরাণিক চেহারা ছিল, তবে ভেতরে ছিল সব আধুনিক সুযোগ সুবিধা।’
১৯৯০ সালের ২৫শে সেপ্টেম্বর এই রথযাত্রা শুরু হয়েছিল। যাত্রা শুরুর আগে মন্দিরে পূজো দেন এল কে আদভানি। আদভানির সাথে এই রথযাত্রায় ছিলেন বিজেপির বেশ কয়েকজন সদস্য - যার মধ্যে ছিলেন উদীয়মান তারকা এবং আদভানির অনুসারী নরেন্দ্র মোদী।
আদভানির বক্তৃতা ছিল মূলত রামমন্দির এবং কেন এই মন্দির বানাতে হবে - তার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে।’ বিজেপির হিন্দু নেতারা বলতেন, ভারতে তাদের ভাষায় ধর্মনিরপেক্ষতার নামে খুব বেশি মাত্রায় আপোষ করা হয়েছে। তারা বলতেন, এখন সময় এসেছে ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের কথা বলার।
মুসলিমদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানোর অভিযোগ বিজেপি অস্বীকার করতো, কিন্তু তাদের জনসভাগুলো থেকে লোকেরা ঠিক এই বার্তাটি নিয়েই ঘরে ফিরতো।
সুধামন বলেন, এটা আসলেই বিপুল সাড়া ফেলেছিল। এতে জনসমাগমও হয়েছিল ব্যাপক। এতে সাজানো কিছু ছিল না। সুধামন বলেন, আমি কিছু মহিলাকে দেখেছি, তারা হাতের বালা খুলে আদভানির পায়ের কাছে রেখে বলেছিল, এ থেকে যে অর্থ পাওয়া যাবে তা রাম মন্দির নির্মাণের জন্য ব্যবহার করতে।’
যতই দিন যাচ্ছিল, রথযাত্রা ততই জনপ্রিয়তা পাচ্ছিল। বাবরি মসজিদের জায়গায় রামমন্দির নির্মাণের দাবি ভারতের রাজনীতিতে চরম সা¤প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি করে। সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার কারণে তিনি যখন বিহারের সমস্তিপুর পৌঁছালেন, তখন বিহারের মুখ্যমন্ত্রী তাকে গ্রেফতার করলেন। আদভানি ও তার হাজার হাজার সমর্থককে গ্রেফতার করা তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ভি পি সিংএর কোয়ালিশন সরকারের প্রতি সমর্থন তুলে নেয়া বিজেপি। ভারত পতিত হয় এক রাজনৈতিক সংকটে। এর ফলে পরের বছর অর্থাৎ ১৯৯১ সালেই অনুষ্ঠিত হলো লোকসভা নির্বাচন, এবং তাতে বিজেপির আসনসংখ্যা অনেক বেড়ে গেল। এদিকে এই রথযাত্রার ফলে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৯২ সালে উগ্র হিন্দু করসেবকরা বাবরি মসজিদ ভেঙে দেয়। ধর্মীয় সহিংসতার কারণে ভারতে এক বিস্ফোরক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গায় প্রায় ২ হাজার লোক নিহত হয়।
বিজেপি ভারতে প্রথম সরকার গঠন করে ১৯৯৬ সালে, এবং তার পর থেকে তারা একাধিকবার ক্ষমতায় এসেছে।