শামসুজ্জামান খান : ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী আবহমানকালের। আমাদের উপমহাদেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং মূল্যবোধÑএই সম্পর্ককে দৃঢ়মূল করেছে। এই উপমহাদেশের সামাজিক, সাংস্কৃতিক বিকাশের ধারা অনেকাংশেই একই কেন্দ্রমূল থেকে উৎসারিত। অন্যদিকে এই উপমহাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসও আদিকাল থেকে একই সূত্রে গ্রথিত থেকে বিভিন্ন কালপর্বে নানা তাৎপর্যে বিন্যস্ত হয়েছে। ইতিহাসের আদি উৎসের দিক থেকে এ অঞ্চলের মানুষের মূল্যচেতনায় অনেক মিল লক্ষ করা যাবে। সেইসঙ্গে কিছু অমিল এবং নানা বৈচিত্র্যপূর্ণ বৈশিষ্ট্য নিয়েই উপমহাদেশের সামগ্রিক সত্তাকে উপলব্ধি করা যায়। আমাদের এ উপমহাদেশের প্রাচীন সাহিত্যে মানুষের যে জীবনযাত্রা বিধৃত, তাতে বহুলাংশে নানা অঞ্চলের জীবনযাপন পদ্ধতির বৈচিত্র্যের মধ্যেও ঐক্যসূত্র লক্ষ করা যায়। অর্থাৎ এই উপমহাদেশের মানুষের বিশ্ববীক্ষা অনেকটা একই ধরনের। উপমহাদেশের গ্র্যান্ড ন্যারেটিভ (এৎধহফ ঘধৎৎধঃরাব) রামায়ণ এবং মহাভারত যেমন এ অঞ্চলের সকল মানুষেরই উত্তরাধিকার হিসেবে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ক্রিয়াশীল, তেমনি আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাসে চাণক্য থেকে শুরু করে আকবর, দারাশিকো এবং বাংলার সুলতান ও নবাবদের মধ্যে শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ্, আলাউদ্দিন হোসেন শাহ্, নবাব আলীবর্দ্দী, মুর্শিদকুলী খাঁ এবং সিরাজউদ্দৌলা হয়ে মহাত্মা গান্ধী, চিত্তরঞ্জন দাশ, সুভাষ বসু, আচার্য্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় প্রমুখের ভূমিকা অনস্বীকার্য। অন্যদিকে লোকজ সাধনায় তুরস্কের আনাতুলিয়া থেকে শুরু করে পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশের শাহ্ আবদুল লতিফ ভিটায়ী এবং বর্তমান ভারতের কবি নানক দাদু হয়ে বাংলাদেশের লালন-হাসনরাজাসহ অসংখ্য সাধকের জীবনসাধনায় যে মানবিক বোধের সোচ্চার উচ্চারণ লক্ষ করি তা গোটা উপমহাদেশেরই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃত। উদার মানবতাবাদী ধর্মসাধকদের জীবন এবং কীর্তিও ভারত ও বাংলাদেশের মানুষকে ঐক্যসূত্রে গ্রথিত করেছে। বড়পীর খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী (রা.), হযরত নিজামউদ্দীন আউলিয়া প্রমুখের সাধনা ভারত-বাংলাদেশের ধর্ম-গোত্র নির্বিশেষে সকল মানুষকেই গভীরভাবে কাছে টেনেছে। ইলতুৎমিশ, আকবর, দারাশিকো যেমন ধর্মনিরপেক্ষ এবং সমন্বয়বাদী ঐতিহ্যের ধারা সৃষ্টি করে উপমহাদেশের সকল মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে প্রয়াসী হয়েছিলেন পূর্ববাংলায়ও তেমনি লোকধর্মের সাধক এবং লোকশিল্পী, কবিয়াল, বয়াতি ও মরমি সাধকেরা সেই ধারারই পরিপুষ্টি সাধনে গোটা গ্রামবাংলায় কাজ করে গেছেন বলে বাংলাদেশ ধর্মনিরপেক্ষ মানবিকতার আদর্শ স্থান হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। উনবিংশ শতাব্দীর শহর কলকাতায় যে রেনেসাঁসের সূচনা, তা আবদ্ধ ছিলো সীমিত সংখ্যক নগরবাসী শিক্ষিত মানুষের মধ্যে। কিন্তু পূর্ববাংলায় লোকজ ও মরমি সাধক এবং শিল্পীদের ভূমিকা এক্ষেত্রে ছিলো অনেক বেশি গভীর এবং সুদূরপ্রসারী। এক্ষেত্রে গ্রামীণ ভারত এবং বঙ্গদেশের লোকমানসের মানবসাধনা ছিলো খুবই তাৎপর্যবাহী।
অন্যদিকে, ইংরেজ ঔপনিবেশিক আমলে ভারতবর্ষ বিশেষ করে বাংলায় যে নবজাগরণের সূত্রপাত, তাতে তৎকালীন কলকাতা শহরের সাহিত্যিক-দার্শনিক-শিল্পী-বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকাই প্রধান। রাজা রামমোহন রায়, বিদ্যাসাগর, অক্ষয় কুমার দত্ত, রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুল ইসলাম যেমন গোটা ভারতের বুদ্ধিবৃত্তিকতাকে তাৎপর্যপূর্ণ মাত্রিকতা দান করেছে, তেমনি তা তৎকালীন পূর্ববাংলার নবজাগ্রত বাঙালি মুসলমানকে আধুনিক চিন্তা-চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেছে। এঁদের সাহিত্য-শিল্প এবং বিজ্ঞানবুদ্ধি ও যুক্তিবাদী আধুনিকতা আমাদের শিক্ষিত সমাজের আলোকিত অংশকে জাতীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে স্বাধীনতা সংগ্রামে অনুপ্রাণিত করেছে। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর পূর্ব বাংলায় যে নতুন শিক্ষিত মুসলিম সমাজ গড়ে ওঠে, তারা ইতিহাসের ঐ অংশ থেকে দিকনির্দেশনা লাভ করে পরবর্তীকালে ভাষাআন্দোলন এবং স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালি জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হয়। এটাই ছিলো ইতিহাসের স্বাভাবিক এবং ’কাক্সিক্ষত গতিধারা। এক্ষেত্রেও ভারত এবং বাংলাদেশের মিলিত প্রয়াস বিশেষভাবেই উল্লেখ করার মতো। ভাষাভিত্তিক বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষে যে রাজনৈতিক আন্দোলন পরিচালিত হয়, তার সর্বোচ্চ স্তরে মুক্তিযুদ্ধেও ভারত-বাংলাদেশের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস ইতিহাসেরই এক অমোঘ পদক্ষেপ। এটা না হয়ে অন্যরকম হলেই তাকে আমরা বলতাম, ইতিহাসের বিকৃতি। দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাই ছিলো সেইরকম ইতিহাসের এক বিকৃত পদযাত্রা। শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পূর্ববাংলার বাঙালিকে ঐক্যবদ্ধ করে যে স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়, তাতে বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ইতিহাসের বিকৃতির অবসান ঘটেছে। এ কাজে ভারত-বাংলাদেশের যৌথ সহযোগিতা বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখযোগ্য। বিশেষ করে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর অসাধারণ ভূমিকা আমরা চিরদিন কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করবো। গত বছর বঙ্গভবনে একটি বিশেষ অনুষ্ঠানে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীকে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অনন্য ভূমিকার জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে যে সম্মাননা দেয়া হয়েছে তা ছিলো খুবই উপযোগী। এই অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতি মোহাম্মাদ জিল্লুর রহমান এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উপস্থিত থেকে শ্রীমতী গান্ধীর পুত্রবধূ এবং ভারতীয় কংগ্রেসের বর্তমান সভানেত্রী শ্রীমতী সোনিয়া গান্ধীর হাতে এ পুরস্কার তুলে দেয়ার মাধ্যমে শুধু যে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর ঐতিহাসিক নেতৃত্ব এবং ভূমিকার প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়েছে তা-ই নয়, বাংলাদেশ এবং ভারতের সম্পর্ক সুদৃঢ় হয়েছে বলে আমরা মনে করি। আমরা এই সুচিন্তিত সিদ্ধান্তের জন্য শেখ হাসিনার সরকারের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই।
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক বর্তমানে নতুন ও নিবিড় সৌহার্দ্যপূর্ণ রূপ নিতে চলেছে। রবীন্দ্রনাথের সার্ধশত বার্ষিকী উদ্যাপনের মধ্য দিয়ে দুই দেশের সাংস্কৃতিক সম্পর্কের নববিন্যাস ঘটেছে। ইতোমধ্যে কূটনৈতিক পর্যায়ে সম্পর্কোন্নয়নের ক্ষেত্রে যতোটা অগ্রগতি হয়েছে, তা অনেকটাই বাস্তবরূপ নিয়েছে ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফরের সময় সম্পাদিত নানা চুক্তি সম্পাদনের মধ্য দিয়ে। আমরা আশা করবো, গোটা উপমহাদেশ এবং তার বাইরেও জঙ্গিবাদ ও উগ্র সংঘর্ষবাদিতার যে ডামাডোল চলছে, তার মধ্যেও ভারত এবং বাংলাদেশ অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সুসম্পর্ক স্থাপনের মধ্য দিয়ে তার বিপরীতে গোটা বিশ্বের জন্য একটি শান্তিপূর্ণ উন্নয়নের ধারা প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হবে। এক্ষেত্রে দুই দেশের নেতৃত্বকেই গভীরভাবে নিজ নিজ দেশের মানুষের অনুভূতিকে বুঝে নিয়ে তাদের জন্য কল্যাণকর হয়, এমন ধরনের আর্থ-সামাজিক চুক্তি সম্পাদনে প্রয়াসী হতে হবে এবং সেই প্রয়াস জনসমর্থনধন্য হলে দুই দেশের সম্পর্ক টেকসই হবে। তার ফলে আমাদের এই অঞ্চলকে একটি অশান্তিমুক্ত-গণতান্ত্রিক-মানবিক-যুক্তিবাদী-রাজনৈতিক বলয়ের অঞ্চলে পরিণত করা সম্ভব হবে। দুই দেশের নেতৃত্বের দূরদৃষ্টি এবং প্রজ্ঞাই এই নবপ্রয়াসকে সাফল্যম-িত করে তুলতে পারে। আমরা দুই দেশের শীর্ষ পর্যায়ের নেতৃত্বের প্রয়াসকে অর্থপূর্ণভাবে বাস্তবায়িত হতে দেখতে চাই। বাংলাদেশ এবং ভারতের সকল মানুষের কল্যাণই হোক দুই রাষ্ট্রের সুদৃঢ় সম্পর্কের ভিত্তি।
লেখক : সাবেক মহাপরিচালক, বাংলা একাডেমি ও লোকসংস্কৃতি বিশেষজ্ঞ