প্রতীতি শিরিন : প্রায় এক দশক আগে নিমতলীতে এক ভয়াবহ অগ্নিকা-ে অন্তত একশো চব্বিশজনের মৃত্যু হয়েছিলো। বিদ্যুতের ট্রান্সফরমার বিস্ফোরণের ফলে ওই এলাকার একটি রাসায়নিক গুদামঘরে শর্ট-সার্কিটের মাধ্যমে আগুনের সূত্রপাত হয়। পুরান ঢাকার সরু গলিতে এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়িতে দ্রুতই আগুন ছড়িয়ে পড়ে। আর দ্রুত আগুন ছড়িয়ে পড়ার কারণ হিসেবে ওই সময়ই পুরান ঢাকার অপরিকল্পিত অবকাঠামোকে দায়ী করা হয়। ওই অগ্নিকা-ে পরিবার হারানো দুই বোনের অভিভাবকত্বের দায়িত্ব নেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। পরবর্তী সময়ে প্রধানমন্ত্রীর তত্ত্বাবধায়নেই তাদের বিয়ে দেয়া হয়।
নিমতলীর এই ট্রাজেডি থেকে আমরা আসলে কোনো শিক্ষাই নিইনি। সেকারণেই ২০ ফেব্রুয়ারি পুরান ঢাকারই চকবাজার এলাকায় আবারো অগ্নিকা- ঘটে। নিমতলীর মতোই রাতের বেলা এ দুর্ঘটনা ঘটে বলে হতাহতের সংখ্যা কমিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী গ্যাস সিলিন্ডার কিংবা নানা ধরনের ক্যান বিস্ফোরণের ফলে আগুন ছড়িয়ে পড়ে, আর এতে এ পর্যন্ত অন্তত একাশি জনের মৃত্যু হয়। নিমতলীর ঘটনার পরও পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিক পদার্থের গুদাম অপসারণের কোনো ব্যবস্থাই নেয়া হয়নি। বরং চকবাজারের ঘটনা থেকে একটা বিষয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, ছোট ছোট গলির মধ্যে ঠাসাঠাসি ঘরবাড়ির কারণে পুরান ঢাকা বসবাসের কতোটা অযোগ্য হয়ে উঠেছে।
প্রায়ই একটা ভয়ঙ্কর ভবিষ্যৎ বাণী শোনা যায় যে, একটা শক্তিশালী ভূমিকম্পের আঘাতে ঢাকার প্রায় অর্ধেক জনসংখ্যাই ধ্বংস হয়ে যাবে। এটা বলার প্রয়োজন নেই যে, সেরকম কিছু ঘটলে পুরান ঢাকার মানুষ সবার আগে মারা পড়বে। ঢাকার ঐতিহাসিক কেন্দ্রভূমি এই পুরান ঢাকা। বিশ্বের প্রায় সব দেশেই সাধারণত ঐতিহাসিক নিদর্শন সংবলিত শহরগুলোতে বিশেষ গুরুত্ব দেয় সরকার। যেমন : প্রাগ, ভিয়েনা, ইস্তাম্বুল শহরের ঐতিহাসিক কেন্দ্রগুলোর হোটেল, শপিংমল ও স্থানীয় বাসস্থানগুলো সেখানে বসবাসরত বা সেগুলোর মালিকদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ ক্ষতিপূরণ দিয়ে কিনে নিয়েছে সরকার। ওই বাসিন্দারা অন্য কোথাও আশ্রয় নিয়েছে। আর সরকার সেগুলোতে হোটেল বা পর্যটন কেন্দ্র বানিয়েছে। পুরান ঢাকার ক্ষেত্রেও এ ধরনের কিছু করা উচিত।
পানাম সিটি, লালবাগের কেল্লা, আহসান মঞ্জিল-এসবই মুঘল স্থাপত্যের অমূল্য নির্দশন। এসব এলাকার বাসিন্দাদের ক্ষতিপূরণ দিয়ে অন্য কোথাও স্থানান্তর করা উচিত। আর ওইসব নির্দশনগুলো সংরক্ষণে সরকারি ও বেসরকারি কোম্পানিগুলোকে এগিয়ে আসা উচিত। রাসায়নিক গুদামগুলো সরানোই শুধু নয়, পুরান ঢাকার বাসিন্দারা বর্তমানে যা পাচ্ছে তার চেয়ে বেশি কিছু পাওয়া উচিত তাদের। অথচ বারবার অগ্নিকা-ে পশুর মতো জীবন বলি দিচ্ছে তারা। আর এর মাধ্যমে প্রমাণিত হচ্ছে যে, মানুষের জীবন কতো সস্তা, আর আমরাও অতীত থেকে কোনো শিক্ষা নিচ্ছি না।
(লেখক : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। মূল ইংরেজি লেখা থেকে অনূদিত ও সংক্ষেপিত)
আপনার মতামত লিখুন :