আশীষ কুমার দে : বুড়িগঙ্গা নদীর তলদেশে জমে থাকা পলিথিনের স্তরসহ বিপুল পরিমাণ কঠিন বর্জ্য অপসারণের জন্য প্রয়োজন অত্যাধুনিক ‘গ্রেব ড্রেজার’; যা এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের কোনো রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার নেই। তবে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) বিদেশ থেকে এই ড্রেজার আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রথম পর্যায়ে এ বছরই একটি গ্রেব ড্রেজার আনা হবে। সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।
সূত্র মতে, গত বছরের শেষদিকে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকে অনুমোদন হওয়া প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকায় ৩৫ ড্রেজার ও সহায়ক জলযান ক্রয় প্রকল্পের মধ্যে একটি গ্রেব ড্রেজার রয়েছে। এটি আনা হবে নেদারল্যান্ড থেকে। খুব শিগগির এ সংক্রান্ত দরপত্র আহ্বান করা হবে বলে সূত্র জানায়।
২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত বাংলাদেশ নৌবাহিনীর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বুড়িগঙ্গা নদী দূষণের জন্য দায়ী মূলত শিল্পবর্জ্য। নদীতে পড়া বর্জ্যের ৬০ শতাংশ শিল্পখাতের। এর মধ্যে ৪০ শতাংশ ট্যানারি, ২০ শতাংশ অন্য শিল্পের। এর বাইরে ১৫ শতাংশ কঠিন বর্জ্য, ১৫ শতাংশ অন্য ও ১০ শতাংশ নৌযান বর্জ্য। প্রতিবেদনে বলা হয়, বুড়িগঙ্গা নদীতে প্রতিদিন ঢাকা শহরের ৪ হাজার ৫০০ টন আবর্জনা ও ২২ হাজার লিটার বিষাক্ত ট্যানারিবর্জ্য পড়ছে। এছাড়া পলিথিন জমে নদীটির তলদেশ ১০-১২ ফুট ভরাট হয়ে গেছে।
পরিবেশবাদীদের আন্দোলন ও আইনি লড়াইয়ের মুখে সরকার ট্যানারি কারখানাগুলোকে সাভারে স্থানান্তর করে। কিন্তু বছরের পর বছর নদীতে জমে থাকা পলিথিনসহ বিভিন্ন ধরনের কঠিন বর্জ্য এখনও অপসারণ করা হয়নি। বিশেষজ্ঞদের মতে, সম্প্রতি বুড়িগঙ্গাতীরের বিপুলসংখ্যক অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ হলেও গুরুত্বপূর্ণ এ নদীকে দূষণমুক্ত ও প্রবহমান করতে হলে ব্যাপক ড্রেজিং (খনন) করতে হবে। কিন্তু এসব বর্জ্য অপসারণ না করে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় খনন সম্ভব নয় বলে সংশ্লিষ্টদের অভিমত।
রাজধানীর গা-ঘেষে প্রবাহিত বুড়িগঙ্গা ঢাকা নদীবন্দরের অধীন অন্যতম নদী। ঢাকার সঙ্গে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন জেলার নিরবিচ্ছিন্ন নৌ যোগাযোগ রয়েছে। এই যোগাযোগের কেন্দ্রস্থল হচ্ছে সদরঘাট টার্মিনাল; যা বুড়িগঙ্গার তীরে অবস্থিত। অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল অধ্যাদেশ (আইএসও)- ১৯৭৬ এর অধীনে প্রণীত বিধি অনুযায়ী, স্বীকৃত নৌপথ খনন করে প্রয়োজনীয় নাব্যতা সংরক্ষণের দায়িত্ব বিআইডব্লিউটিএর। সুতরাং বুড়িগঙ্গার ওপর দিয়ে প্রবাহিত নৌপথসহ এই নদী খননের এখতিয়ারও এই সংস্থার, অন্য কারো নয়। এছাড়া নৌযান চলাচলের উপযোগী নাব্যতা সৃষ্টির জন্য যেকোনো নদী বা নৌপথ খননের ক্ষেত্রে বিআইডব্লিউটিএর জবাবদিহিতাও রয়েছে; যা অন্য কোনো সংস্থার নেই।
এ বিষয়ে ৫৩ নৌপথ খনন প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) ও বিআইডব্লিউটিএর অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (পূর্ত) রকিবুল ইসলাম তালুকদার বলেন, বুড়িগঙ্গার তলদেশে জমে থাকা কঠিন বর্জ্য অপসারণের জন্য তাঁরা নেদারল্যান্ড থেকে একটি গ্রেব ড্রেজার ক্রয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এর মূল্য এক শ’ কোটির ওপরে। ইতোমধ্যে একনেকে পাস হওয়া ৩৫ ড্রেজার ও সহায়ক জলযান ক্রয় প্রকল্পের মধ্যে এ বিষয়টি উল্লেখ রয়েছে বলে রকিবুল ইসলাম তালুকদার জানান।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের নৌযান ও নৌযন্ত্র কৌশল বিভাগের বিভাগীয় প্রধান এবং বেসরকারি সংগঠন নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য অধ্যাপক ড. মীর তারেক আলীও বিষয়টিকে ইতিবাচকভাবেই দেখছেন। কেনিয়ার রাজধানী নাইরোবিতে অবস্থানরত এ বিশেষজ্ঞ ফেসবুক মেসেঞ্জারে জানান, বিআইডব্লিউটিএর উদ্যোগটি ভালো বলে মনে হচ্ছে।
ড. মীর তারেক বলেন, যেসব এস্কেভেটরের সাহায্যে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় নদী খনন ও বা যেসব ড্রেজার দিয়ে নৌপথের পলি অপসারণ করা হয় সেগুলো দিয়ে বুড়িগঙ্গা খনন করা সম্ভব নয়। বছরের পর বছর পলিথিনসহ বিভিন্ন ধরনের কঠিন বর্জ্য জমে থাকায় এর তলদেশ ভরাট ও শক্ত হয়ে গেছে। এগুলো অপসারণের জন্য গ্রেব ড্রেজারের মতো শক্তিশালী খননযন্ত্র প্রয়োজন। তবে দরপত্র তৈরি, মূল্য নির্ধারণ সহ আনুসঙ্গিক ইত্যাদি বিষয়ে প্রথম থেকেই সুপরিকল্পনা, অভিজ্ঞ লোকজনের সমন্বয়ে কমিটি গঠন দরকার বলে মন্তব্য করেন তিনি।
আপনার মতামত লিখুন :