যুগান্তর : দেশে হেপাটাইটিস, চিকেনপক্স ও সার্ভিক্যাল ক্যান্সারসহ বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধী বিদেশি ভ্যাকসিনের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। ভ্যাকসিন উৎপাদন ও সরবরাহকারী কয়েকটি প্রতিষ্ঠান এ দেশ থেকে ব্যবসা গুটিয়ে নেয়া এবং অন্য প্রতিষ্ঠানের আমদানি বন্ধ থাকায় এ সংকট সৃষ্টি হয়েছে। ফলে এ সংক্রান্ত ব্যাধি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা।
সংশ্লিষ্টদের মতে, দেশের বাজারে বিভিন্ন রোগের ১৯টি ভ্যাকসিন বাজারজাত করতো বহুজাতিক ওষুধ প্রস্তুকারক প্রতিষ্ঠান গ্লাস্কোস্মিথক্লাইন (জিএসকে)। প্রতিষ্ঠানটি সম্প্রতি বাংলাদেশ থেকে তাদের এ সংক্রান্ত ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছে। অন্য আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো চাহিদা অনুযায়ী ভ্যাকসিনের জোগান দিতে পারছে না। দেশীয় কয়েকটি ওষুধ কোম্পানি কয়েক ধরনের ভ্যাকসিন উৎপাদন করলেও চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকায় ঘাটতি থেকে যাচ্ছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ভাইরোলজি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, জিএসকের ব্যবসা বন্ধ হওয়ায় ওই কোম্পানির তৈরি শিশু ও প্রাপ্তবয়স্কদের হেপাটাইটিস-বি ভাইরাসের জন্য এনজেরিক্স নামে দুটি, হেপাটাইটিস-এ প্রতিরোধে হেভারিক্স, চিকেনপক্সের জন্য ভারিলোরিক্স, মিজলেস ও রুবেলা ভাইরাস প্রতিরোধে প্রিওরিক্স (এমএমএমআর) সার্ভিক্যাল ক্যান্সার প্রতিরোধে সারভারিক্স ও ডায়রিয়ার জন্য রোটারিক্স ভ্যাকসিন না থাকায় অনেক রোগী সময়মতো জীবনরক্ষাকারী প্রতিষেধক থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। পাশাপাশি টিটেনাসের জন্য ইনফানরিক্স, বুস্টরিক্স, মেনিনজো-কোক্কালের জন্য এসিডব্লিও ভ্যাক্স, হেপাটাইটিস-এ এর জন্য এমব্রিক্স, হেপাটারিক্স, হেপাটাইটিস-বি এর জন্য ফেন্ডরিক্স, ইনফ্লুয়েঞ্জার জন্য ফ্লুয়ারিক্স ও ফ্লুলাভাল ছাড়াও ইনফানরিক্স আইভিপি, কিনরিক্স, মেনহিবরেক্স, মেনিটোরিক্স, পেডিয়াট্রিক্সসহ ১৯টি ভ্যাকসিনের সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেছে।
এছাড়া নিউমোনিয়া প্রতিরোধে সনোফির তৈরি নিউমো-২৩, ইনফ্লুয়েঞ্জার জন্য ট্রিমাভ্যাক্স-১০ ভায়াল, জলাতঙ্কের চিকিৎসায় ফ্যাভিরাব সোল ও টিটেনাসের জন্য টেটাভ্যাক্স ০.৫ এমএল বাজারে নেই বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। জরায়ুমুখ ক্যান্সার প্রতিরোধে হেলথ কেয়ায় লিমিটেডের আমদানি করা গার্ডাসিল, নিউমোনিয়ার জন্য নিউমোভ্যাক্স-২৩ সরবরাহ নেই বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।
এ ব্যাপারে ভ্যাকসিন আমদানিকারক কোম্পানি সনোফি বাংলাদেশ লিমিটেডের বিপণন বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, বর্তমানে তাদের কোম্পানির ৮টি ভ্যাকসিন বাজারে রয়েছে। তবে আগের নিউমো-২৩ সোল ভ্যাকসিনটি উৎপাদন করা হচ্ছে না বলে আমদানি বন্ধ। আর টেটাভ্যাক্স ০.৫ এমএল ভ্যাকসিনটি দুটি দেশীয় প্রতিষ্ঠান বাজারজাত করায় সরকার (কর্তৃপক্ষ) আমদানির অনুমোদন বন্ধ রেখেছে। তাই এ ভ্যাকসিনটি তারা আমদানি এবং সরবরাহ করতে পারছে না। এক্ষেত্রে কিছু সংকট থাকতে পারে। তবে আগামীতে চার ধরনের সংক্রামক রোগের সমন্বিত ভ্যাকসিন ও ডেঙ্গুর ভ্যাকসিন আমদানি করা হবে।
ভ্যাকসিন সরবরাহ কম থাকার ব্যাপারে হেলথ কেয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের একজন পদস্থ কর্মকর্তা জানান, আমরা আমেরিকান একটি কোম্পানির কাছ থেকে ভ্যাকসিন আমদানি করতাম। ওই কোম্পানি সরকারের পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরে কিছু ওষুধ সরবরাহ করত। সরকারের সঙ্গে ওই চুক্তি বাতিল হওয়ায় তারাও বাংলাদেশে ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছে। এ বছরের মার্চ-এপ্রিল নাগাদ আমাদের সঙ্গে কথা হয়েছিল ভ্যাকসিনগুলো রফতানি করবে তারা। সে সম্ভাবনা অনেকটা ক্ষীণ।
বিএসএমএমইউর একজন অধ্যাপক বলেন, দেশি প্রতিষ্ঠানের ভ্যাকসিন থাকা উচিত যেটা নিজেরা প্রমোট করতে পারব। যদিও দেশীয়ভাবে কিছু ভ্যাকসিন উৎপাদন হচ্ছে কিন্তু মান নিয়ে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। কারণ দেশে কোয়ালিটি সম্পন্ন প্ল্যান্ট নেই। ফলে বাইরে থেকে কাঁচামাল এনে শুধু বোতলজাত করা হচ্ছে। যেগুলোর কোনোভাবেই পোস্ট ভ্যালু ইভালুয়েশন করা হচ্ছে না (অর্থাৎ বাজারে বিক্রি পরবর্তী কার্যকারিতা মূল্যায়ন হচ্ছে না)। এমনকি ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল ছাড়াই মানুষের কাছে বিক্রি করা হচ্ছে।
সামগ্রিক বিষয়ে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের পরিচালক রুহুল আমিনের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ইনসেপ্টা ও বেক্সিমকো বেশকিছু ভ্যাকসিন উৎপাদন ও সরবরাহ করেছে। কিছু ভ্যাকসিন আমদানি করতে হচ্ছে। মূলত বিশ্ববাজারে ভ্যাকসিনের সরবরাহ কম থাকায় এমনটা হয়েছে। সার্ভিক্যাল ক্যান্সারের ভ্যাকসিনটা একেবারেই পাওয়া যাচ্ছে না। জিএসকে এ দেশ থেকে চলে যাওয়ায় এ সমস্যা তৈরি হয়েছে। তবে এ সমস্যা দ্রুত কেটে যাবে।