চিররঞ্জন সরকার : সে অর্থে আমাদের দেশ স্বাধীন। হ্যাঁ, সেই ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর থেকেই স্বাধীন। এ দেশ কারও গোলাম নয়। গোলামি ঘুচেছে বটে, কিন্তু স্বাধীনতায় বিস্তর গোলমাল বেধেছে! অনেক সমস্যা আছে। রয়েছে অনেক ধরনের গোলমাল। এই ধরনের গোলমাল থাকা উচিত ছিলো না। এতো সংগ্রামের পর এমন মহার্ঘ্য স্বাধীনতা পেয়ে আমাদের তার মূল্য বোঝা উচিত ছিলো!
আমার কাছে কিন্তু স্বাধীনতার সংজ্ঞা আলাদা। আমরা আসলে কোন স্বাধীনতা চাই? কীসের থেকে মুক্তি চাই? স্বাধীনতা চাই নিজের পছন্দ বেছে নেয়ার ক্ষেত্রে, স্বাধীনতা চাই যেকোনো ধরনের রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ থেকে, মুক্তি চাই জঙ্গিবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা থেকে, দুর্নীতি থেকে, পুঁজিবাদ থেকে, মুক্তি চাই গরিবি থেকে, বেকারত্ব থেকে।
এ সবের থেকে মুক্ত না হলে কীসের স্বাধীনতা ভোগ করবে দেশের মানুষ? ক্ষমতাবানেরা ‘ভ্রষ্টাচার’ করছে, অন্যায় করে পার পেয়ে যাচ্ছে। একদল ষড়যন্ত্র করছে, যে পাকিস্তানকে অস্বীকার ও পরাস্ত করে দেশের স্বাধীনতা, সেই পাকিস্তান ও পাকিস্তানপন্থীদের সঙ্গে গোপন সম্পর্কের মাধ্যমে, আঁতাত করে মৈত্রী গড়ে দেশকে পেছনে নিতে চেষ্টা করছে। আরেকদল সুশাসন কায়েমে শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ। লুটপাটতন্ত্রকে থামাতে তো পারেইনি, উল্টো লাই দিয়ে মাথায় তুলেছে। এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোটা অনেক বেশি প্রয়োজন। এর বিরুদ্ধে নির্ভীকভাবে প্রতিবাদ করারও স্বাধীনতা চাই।
জঙ্গিদমনে বড় বড় অভিযান চালানো হয়েছে। আবার জঙ্গিবাদের পৃষ্ঠপোষক ও ভাবাদর্শের দলকে প্রশ্রয়ও দেয়া হচ্ছে। জঙ্গিবাদকে অনেক ক্ষেত্রেই ইস্যু বানানো হচ্ছে। যেন দেশে আর কোনো সমস্যা নেই। আরে, জঙ্গিবাদের শেকড়টাও বুঝতে হবে। আদর্শহীনতা ও গরিবি থেকে জঙ্গিবাদ সৃষ্টি হচ্ছে। সর্বগ্রাসী দারিদ্র্য দূর হলে জঙ্গিবাদও দূর হতে পারে। সম্পদের অভাবে গরিবি আসতে পারে, আবার আদর্শের অভাব থেকেও গরিবি আসে।
আমার কাছে স্বাধীনতার এই লড়াই আসলে গরিবির বিরুদ্ধে লড়াই। এখনো দেশের ১৫ থেকে ২০ ভাগ মানুষ অতিদরিদ্র। তারা ঠিক মতো খেতে পাচ্ছে নাÑএর বিরুদ্ধে লড়াইটা আমাদের কাছে অনেক বেশি জরুরি। অনেক বেশি জরুরি বেকারির বিরুদ্ধে লড়াইটা। দেশের বেকার মানুষেরা কাজের জন্য, উপার্জনের জন্য হন্যে হয়ে ঘুরছে। বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। তারপর সেখান থেকে সর্বশান্ত হয়ে দেশে ফিরে আসছে। নারীরা উপার্জনের আশায় বিদেশ গিয়ে নির্যাতিত হয়ে ফিরে আসছে। এর কোনো প্রতিকার হচ্ছে না।
বেকারদের কাজের বন্দোবস্ত সেভাবে হচ্ছে না। অনিয়ম-দুর্নীতির কবলে পড়ে দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ধুঁকছে। টাকা পাচার অব্যাহত আছে। বিদেশে রাখা কালো টাকা দেশে ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে কোনো উদ্যোগ ও সাফল্য নেই। মতাদর্শগতভাবে দেশকে এগিয়ে নেয়া, মানুষের মাইন্ডসেট পরিবর্তন করা-এসবে তেমন কোনো আগ্রহ কারো মধ্যেই দেখা যাচ্ছে না। দেশে ধর্মান্ধতা দিন দিন বাড়ছে। বাড়ছে ভোগবাদ, অবক্ষয়, নারী নির্যাতন। কর্পোরেট-রাজ প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে। ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানি যেমন দেশ শাসনের নামে লুট করতো, এখনও অনেক ক্ষেত্রে তেমনটাই চলছে! আমাদের দেশের একটা বড় ট্র্যাজেডি হলো, উন্নয়নের খাতে এমনিতেই বরাদ্দ কম, আর যেটুকু খরচ হচ্ছে সেটাও গরিব মানুষের কাছে পুরোটা পৌঁছাচ্ছে না। চাটার দল খেয়ে ফেলছে গায়ে-খাটার দলের টাকা।
দীর্ঘদিনেও আমরা গণতন্ত্র চর্চায় এগিয়ে যেতে পারিনি। একদল গ্রেনেড হামলা করে আরেক দলকে শেষ করে দিতে চেয়েছে। আরেক দল তার প্রতিশোধ নিতে আইনকে ব্যবহার করছে নিজ স্বার্থে। গণতন্ত্রের ভিত্তি ভিন্নমত প্রকাশের স্বাধীনতা। বিতর্কের ক্ষেত্রটিই গণতন্ত্রের প্রকৃত জন্মভূমি। আজ যদি দেশের মানুষ, যেকোনো কারণেই হোক, মনে করেন যে সরকারবিরোধী মতকে দেশদ্রোহী বলে চিহ্নিত করলেই দেশ শক্তিশালী হবে, সে অধিকার তাদের আছে। কিন্তু তাদের ভেবে দেখতে হবে, দেশের ভেতরের স্বাধীনতাগুলো খর্ব করে কি দেশকে প্রকৃতই শক্তিশালী করা যাবে? মাঝে মাঝে মনে হয়, আমাদের অধৈর্য, দর্পিত নেতারা স্থির করেছেন, দেশটার শক্তিশালী হওয়ার পথে অন্তরায় মানুষের সত্য ও তথ্য জানার গণতান্ত্রিক অধিকার। তাই তারা তাদের যা কিছু বিরোধিতার টুঁটি টিপে ধরছেন। বিজয় দিবসে এইটুকু আশা করি, সবাই স্মরণ করবেন যে স্বাধীনতা শুধু বিদেশি রাজার শাসন থেকে স্বাধীনতার প্রশ্ন নয়, দারিদ্র্য, অশিক্ষা, অস্বাস্থ্য, অসাম্যের হাত থেকে মুক্তির প্রশ্নও বটে। স্বাধীনতার লড়াই শুধু সীমান্তে নয়, ঘরেও।
প্রকৃত স্বাধীনতার জন্য আমাদের সংগ্রাম অব্যাহ রাখতে হবে। যখন দেশের সব মানুষ তার অধিকার ফিরে পাবে, গরিব মানুষ থাকবে না, লুটপাট, বেকারত্ব থাকবে না, পিছিয়ে পড়া বলে কেউ থাকবে না, তার পরে না হয় বলবো সত্যিকারের স্বাধীন হয়েছি!
লেখক : কলামিস্ট