ডেস্ক রিপোর্ট : ডিসেম্বরের মধ্যে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন ১২ হাজার মেগাওয়াট ছাড়াবে। ২০০৯ সালের ৬ জুন সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছিল ৩ হাজার ২৬৮ মেগাওয়াট।
এরপর প্রতিবছরই বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়েছে। গত ১৯ সেপ্টেম্বর দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদনের রেকর্ড ছিল ১১ হাজার ৬২৩ মেগাওয়াট। ২৬ নভেম্বর বেসরকারি খাতে ১৫০ মেগাওয়াটের আরও একটি নতুন বিদ্যুৎ কেন্দ্র উৎপাদনে গেছে।
ডিসেম্বরে আসবে আরও ৫০০ মেগাওয়াট। সে হিসাবে এ বছরের শেষ নাগাদ দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন ১২ হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়ে যাবে। আগামী বছর জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারির মধ্যে আসবে আরও ১ হাজার মেগাওয়াটের মতো।
বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, ২০১৮ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ খাতে সরকার টার্গেটের চেয়ে বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করেছে। ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত দুই দফা সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদনের তুলনামূলক চিত্রই বলে দিচ্ছে বিদ্যুৎ খাতের অগ্রযাত্রা।
দেশজুড়ে লোডশেডিংয়ের যে দুর্বিষহ যন্ত্রণা ছিল তা কমে গেছে। যদিও মাঝেমধ্যে বিতরণ ত্রুটিতে গ্রাহকরা ভোগান্তিতে পড়েন। এখন বিদ্যুতের জন্য আগের মতো হাহাকার নেই।
রাজধানীর সব এলাকায় যেখানে প্রতিঘণ্টায় লোডশেডিং হতো, সেই অবস্থা এখন অনেক সহনীয় পর্যায়ে এসেছে। শিল্পে সরবরাহে মারাত্মক সংকটও নেই। বিতরণ কোম্পানি আরইবি (পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড) এখন বাসাবাড়ির পাশাপাশি বড় বড় শিল্প কারখানায় দ্রুতগতিতে বিদ্যুৎ সংযোগ দিচ্ছে। নির্মাণ করছে মাইলের পর মাইল বিতরণ লাইন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমদানি করা তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের সময় এসেছে। বেসরকারি খাতে এখন এলএনজিভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের অনুমতি দেয়া দরকার। তেলভিত্তিক বিদ্যুতের চেয়ে এলএনজিভিত্তিক বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ আরও কম পড়বে।
সংশ্লিষ্টদের মতে, বিদ্যুৎ উৎপাদনের এই সক্ষমতা অর্জনে বেসরকারি খাতের অবদান রয়েছে। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে দেশের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতার প্রায় ৫৫ শতাংশ বেসরকারি খাতের আওতায়। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) সূত্র জানায়, বর্তমানে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনে স্থাপিত ক্ষমতা ২০ হাজার ৩৪৩ মেগাওয়াট।
দশ বছর আগে, ২০০৯ সালে স্থাপিত ক্ষমতা ছিল ৪ হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট। পিডিবির তথ্য অনুযায়ী, বর্তমান স্থাপিত ক্ষমতার মধ্যে বেসরকারি খাতের কেন্দ্রগুলোর ১১ হাজার ৫৭ মেগাওয়াট, যা মোট ক্ষমতার ৫৪ দশমিক ৩৫ শতাংশ।
বেসরকারি খাতের এই উৎপাদন ক্ষমতার মধ্যে ৩ হাজার মেগাওয়াট ক্যাপটিভ ও অল্প কিছু সৌরবিদ্যুৎ রয়েছে। অন্যদিকে প্রায় ২৫০ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎসহ সরকারি খাতের কেন্দ্রগুলোর বর্তমান স্থাপিত ক্ষমতা ৯ হাজার ২৮৬ মেগাওয়াট, যা মোট উৎপাদন ক্ষমতার ৪৫ দশমিক ৬৫ শতাংশ।
তবে উৎপাদনের স্থাপিত ক্ষমতা ২০ হাজার ৩৪৩ মেগাওয়াট হলেও গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী দেশে দৈনিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের গড় ১১ হাজার মেগাওয়াটের মতো। পিডিবির তথ্য অনুযায়ী, গত দশ বছরে দেশে বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা যেমন বেড়েছে তেমনি ব্যবহারকারীর সংখ্যা। পাশাপাশি মাথাপিছু ব্যবহারের পরিমাণও উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। ২০০৯ সালে যেখানে বিদ্যুতের গ্রাহক সংখ্যা ছিল ১ কোটি ৮ লাখ, সেখানে এখন বেড়ে হয়েছে তিন কোটি ১২ লাখ। ২০০৯ সালে দেশের মাত্র ৪৭ শতাংশ মানুষ বিদ্যুৎ সংযোগের আওতায় ছিল। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৯২ শতাংশ।
সরকারের পরিকল্পনা হচ্ছে, আগামী ১ বছরের মধ্যে দেশের শতভাগ মানুষকে বিদ্যুৎ সংযোগের আওতায় নিয়ে আসা। অর্থাৎ আগামী ১ বছরের মধ্যে দেশে সবার জন্য বিদ্যুৎ নিশ্চিত হচ্ছে। সরকারের এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখে আসছে বেসরকারি খাত।
বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীদের সংগঠন ‘বাংলাদেশ ইন্ডিপেন্ডেন্ট পাওয়ার প্রোডিউসারস্ অ্যাসোসিয়েশন (বিআিইপিপিএ)-এর সভাপতি মুহম্মদ লতিফ খান জানান, বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়নে সরকারের আহ্বানে সাড়া দিয়ে এবং সরকারি নীতি সহায়তার সুযোগে গত ১০ বছরে তারা এ খাতে প্রায় এক লাখ কোটি টাকা (১২ বিলিয়ন বা ১২০০ কোটি মার্কিন ডলার) বিনিয়োগ করেছেন। ২০৪০ সাল নাগাদ এ খাতে আরও প্রায় সাড়ে চার লাখ কোটি (৫০ বিলিয়ন বা ৫ হাজার কোটি ডলার) বিনিয়োগের উদ্যোগ নিয়েছেন তারা।
বেসরকারি বিনিয়োগের পাশাপাশি সরকারের সঙ্গে যৌথ বিনিয়োগেও (পিপিপি) বিদ্যুৎ খাতের অনেক প্রকল্প বাস্তবায়নের পরিকল্পনা রয়েছে। সরকারের বিদ্যুৎ খাত মহাপরিকল্পনা-২০১৬ অনুযায়ী, পিপিপির আওতায় ৫৫টি নতুন বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়িত হবে। এগুলোর মোট উৎপাদন ক্ষমতা হবে প্রায় ১২ হাজার মেগাওয়াট।
বিআইপিপিএ’র সহ-সভাপতি গোলাম রব্বানি বলেন, শুধু উৎপাদন খাতে নয়, বিদ্যুৎ সঞ্চালন এবং বিতরণ ব্যবস্থার উন্নয়ন ও সম্প্রসারণেও বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি করছে সরকার। সঞ্চালন ও বিতরণ ব্যবস্থায় বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণ উৎসাহিত করার জন্য সরকার নীতি প্রণয়নের কাজ শুরু করেছে। বিদ্যুৎ খাতের কয়েকটি মেগা প্রকল্পেও বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এই মেগা প্রকল্পগুলো মূলত কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা সর্বমোট প্রায় ৩ হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের প্রক্রিয়ার মধ্যে আছেন।
তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বেসরকারি উদ্যোক্তা বলেন, সরকারের কিছু ভুল সিদ্ধান্তের কারণে অনেক ভালো ভালো দেশীয় বিনিয়োগকারী বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের কাজ পাননি। আবার একই কারণে অনেক বেসরকারি উদ্যোক্তা কাজ পেয়েও যথাসময়ে উৎপাদনে আসতে পারেননি। সরকারের উচিত এসব মাথায় রেখে আগামীতে নতুন নতুন বেসরকারি বিনিয়োগকারীকে বিদ্যুৎ কেন্দ্র, বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন ও বিতরণ লাইন নির্মাণে কাজ দেয়া। তাহলে বিদ্যুৎ খাতে টেকসই উন্নয়ন হবে।
বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব আহমেদ কায়কাউস বলেন, বর্তমান সরকার ক্ষমতার আসার পর বিদ্যুতের যে মহাপরিকল্পনা হাতে নিয়েছে, তাতে ২০২১ সালের মধ্যে দেশের মানুষ শতভাগ বিদ্যুৎ পাবে। তিনি বলেন, বিদ্যুতের উৎপাদন যেমন বাড়ছে তেমনি বাড়ছে চাহিদাও।
চাহিদা পূরণে সরকার বদ্ধপরিকর। মহাপরিকল্পনার স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এবার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পালা। সেখানে আছে বড় বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্র।
পিডিবি চেয়ারম্যান খালেদ মাহমুদ বলেন, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে আগামী বছর বেশ কয়েকটি বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্র উৎপাদনে আসবে। বর্তমানে মাতারাবাড়ি, রামপাল ও পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাজ দ্রুত এগিয়ে চলেছে। এগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট করে।
সূত্র : যুগান্তর