এম নজরুল ইসলাম : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ব্যক্তি প্রসঙ্গ প্রবন্ধগুচ্ছে গুরুসদয় দত্তের স্ত্রী সরোজনলিনী দত্ত সম্পর্কে বলেছেন, “অর্থভাণ্ডারে মূল্যবান সামগ্রী লইয়া মানুষ গর্ব করে। কিন্তু তাহার চেয়ে বড়ো কথা স্মৃতিভাণ্ডারের সম্পদ। সেই মানুষই একান্ত দরিদ্র যাহার স্মৃতিসঞ্চয়ের মধ্যে অক্ষয় গৌরবের ধন বেশি কিছু নাই। সাধারণত আমরা যখন খাঁটি বাঙালির মেয়ের আদর্শ খুঁজি তখন গৃহকোণচারিণীর ’পরেই আমাদের দৃষ্টি পড়ে। গৃহসীমানার মধ্যে আবদ্ধ যে সংকুচিত জীবন তাহারই সংকীর্ণ আদর্শের বহুবেষ্টনরক্ষিত উৎকর্ষ দুর্লভ পদার্থ নহে। তাহার উপাদান অথবা তাহার ক্ষেত্র অপ্রশস্ত, তাহার পরীক্ষা অপেক্ষাকৃত অকঠোর।”
বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ রেহানার ক্ষেত্রেও কবিগুরুর এই বাক্যগুলো একেবারে মিলে যায়। জীবনের সংগ্রামে তিনি মাধুর্যের দ্বারা শোভন ও ত্যাগের দ্বারা সব কিছু কল্যাণময় করেছেন। আদর্শ স্থাপন করেছেন তিনি।
জওয়াহেরলাল নেহরুর স্ত্রী কমলা নেহরু সম্পর্কে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘অপরিসীম তাঁর ধৈর্য, বীরত্ব তাঁর বিরাট, কিন্তু সকলের চেয়ে বড়ো তাঁর সুদৃঢ় সত্যনিষ্ঠা। পলিটিক্সের সাধনায় আত্মপ্রবঞ্চনা ও পরপ্রবঞ্চনার পঙ্কিল আবর্তের মধ্যে তিনি নিজেকে কখনো হারিয়ে ফেলেননি। সত্য যেখানে বিপদজনক, সেখানে সত্যকে তিনি ভয় করেন নি, মিথ্যা যেখানে সুবিধাজনক সেখানে তিনি সহায় করেন নি মিথ্যাকে। মিথ্যার উপচার আশু প্রয়োজনবোধে দেশপূজার যে অর্ঘ্যে অসংকোচে স্বীকৃত হয়ে থাকে, সেখানে তিনি সত্যের নির্মলতম আদর্শকে রক্ষা করেছেন। তাঁর অসামান্য বুদ্ধি কূটকৌশলের পথে ফললাভের চেষ্টাকে চিরদিন ঘৃণাভরে অবজ্ঞা করেছে। দেশের মুক্তি সাধনায় তাঁর এই চরিত্রের দান সকলের চেয়ে বড়ো দান।’
শেখ রেহানার জীবনাচার লক্ষ করলে আমরা তাঁর ভেতরে কমলা নেহরুর এই গুণের পরিচয় পাই। তিনি সত্যের নির্মলতম আদর্শকে রক্ষা করেছেন। আত্মপ্রবঞ্চনা ও পরপ্রবঞ্চনার পঙ্কিল আবর্তের মধ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলেননি। সত্যকে তিনি ভয় করেননি। মিথ্যার সুবিধা ভোগে প্রবৃত্ত হননি কোনো দিন। আমরা জানি, ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট বাংলাদেশ নামের জাতিরাষ্ট্রের মহান স্থপতির দুই কন্যার জীবনধারা সম্পূর্ণ পাল্টে দিয়েছিল। সেই বদলে যাওয়া জীবনধারায় খাপ খাইয়ে নেওয়া শেখ রেহানা নিজেকে গড়ে তুলেছেন সম্পূর্ণ অন্যভাবে। নিজের অতীত তিনি বিস্মৃত হননি। নিজের বড় বোন দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতা, তিনবারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু শেখ রেহানা এক আশ্চর্য শক্তিবলে এই পরিচয়ের গণ্ডির বাইরে রেখেছেন নিজেকে। রাজনৈতিক পরিবারের সদস্য হয়েও সব সময় রাজনীতি থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখলেও তাঁকে রাজনীতিবিচ্ছিন্ন কিংবা রাজনীতিবিমুখ ভাবার কোনো কারণ নেই। যথেষ্ট রাজনীতিসচেতন শেখ রেহানা আড়াল থেকেই তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন।
অন্য রকম হওয়ার কথা ছিল তাঁর জীবন। জাতির জনকের কন্যা তিনি। রাজনীতির চড়াই-উতরাই দেখেছেন খুব কাছ থেকে। জীবনের অনেকটা পথ রীতিমতো লড়াই করেই কাটাতে হয়েছে তাঁকে। বলতে গেলে জীবনের শুরুতেই জীবনযুদ্ধের সৈনিক তিনি। তারুণ্যের উষালগ্নে, যখন তাঁর ভেসে যাওয়ার কথা উচ্ছলতার স্রোতধারায় তখনই হোঁচট খেতে হয়েছে। থমকে দাঁড়াতে হয়েছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টের সেই অভিশপ্ত দিনে হারিয়েছেন মা-বাবা, ভাইদের। হারিয়েছেন স্বদেশের আশ্রয়। আশ্রয়হীন পরিবেশে দেশে দেশে ঘুরেছেন। ছিল না নিশ্চিত নিরাপত্তা, জীবনযাপনের নিশ্চয়তাও ছিল অনুপস্থিত। জীবনযুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হয়েছে তাঁকে। বেছে নিতে হয়েছে অন্য রকম এক সংগ্রামী জীবন। লড়াই করেছেন দারিদ্র্যের সঙ্গে। কিন্তু জীবনের সত্য থেকে বিচ্যুত হননি কোনো দিন।
মঞ্চে পাদপ্রদীপের আলো যেখানে পড়ে, সে জায়গাটি জ্বলজ্বল করে। পাশেই অন্ধকার। সেই অন্ধকারেও এমন কেউ কেউ থাকেন, যাঁদের আলোয় মঞ্চ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। সাদা চোখে সে আলোর বিচ্ছুরণ দেখা যায় না, অনুভব করা যায়। তেমনই একজন মানুষ শেখ রেহানা। যে পরিবারে তাঁর জন্ম, সেখানে তাঁর ওপরও আলো পড়ার কথা। কিন্তু নিজেকে সে আলো থেকে সযত্নে সরিয়ে রেখেছেন তিনি। তাঁকে স্পর্শ করেনি কোনো মোহ। যেন এক অন্তর্গত মানুষ হিসেবেই নিজেকে গড়ে তুলেছেন তিনি। বাংলাদেশের রাজনীতিতে পঁচাত্তরের পটপরিবর্তন, সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যা, বড় বোন শেখ হাসিনার রাজনীতিতে যোগদান, আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয় অংশগ্রহণ তো তাঁকেও সমানভাবে আলোড়িত করার কথা। রাজনীতির অন্য রকম টান থাকে। রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান হিসেবে রাজনীতির পথটিই তিনি বেছে নিতে দ্বিধা করবেন না, এটাই স্বতঃসিদ্ধ। কিন্তু এই সরল সমীকরণ তিনি বিবেচনায় না এনে বেছে নিলেন আটপৌরে গার্হস্থ্য জীবন। আপাতত এ চিত্রই উন্মুক্ত সবার সামনে।
রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হওয়ার সব সুযোগ থাকা সত্ত্বেও নিজেকে আড়াল করে রাখার মধ্য দিয়ে যে নির্মোহ জীবনাচারের পরিচয় পাওয়া যায়, তা অতুলনীয়। পাদপ্রদীপের আলোয় আসার আকাঙ্ক্ষা সবারই থাকে। ইতিবাচক আলোচনার কেন্দ্রে থাকার ইচ্ছা দমন করা সহজ কাজ নয়। এর জন্য সাধনার প্রয়োজন হয়। সেই সাধনায় উত্তীর্ণ এক নারী শেখ রেহানা। তাই বলে এটা ভাবলে চলবে না যে একেবারেই রাজনীতিসচেতন নন তিনি। রাজনীতি তাঁর রক্তে। যথেষ্ট রাজনীতিসচেতন শেখ রেহানা, তার পরও নেপথ্যের নিভৃতচারী। তিন সন্তানকে শিক্ষিত করে গড়ে তুলেছেন তিনি। মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিক আজ নির্বাচিত ব্রিটিশ এমপি।
আমরা যদি একটু আলাদা করে বিশ্লেষণ করি, তাহলে দেখা যাবে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে শেখ রেহানার অবদান একেবারে কম তো নয়ই, বরং উপেক্ষা করার মতো নয়। প্রত্যেক রাজনৈতিক নেতৃত্বের নেপথ্যে আরো একজনকে পাওয়া যায়, যাঁর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতা ছাড়া সাফল্য লাভ ছিল প্রায় অসম্ভব। শেখ রেহানা তেমনই একজন, যিনি সব সময় বড় বোনের পাশে থেকেছেন, তাঁকে সাহস জুগিয়েছেন। প্রবাসে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব সব সময় তাঁকেই পেয়েছে কাণ্ডারি হিসেবে। অর্থভাণ্ডারের মূল্যবান কোনো সামগ্রী নয়, স্মৃতিভাণ্ডারের সম্পদই তাঁর কাছে মহামূল্যবান। তিনি গৃহকোণচারিণী; কিন্তু গৃহসীমানার মধ্যে সংকুচিত নয় তাঁর জীবন। ঘরে ও বাইরে সমানভাবে চিরায়ত কল্যাণী তিনি। সর্বক্ষেত্রে তিনি অপরিসীম ধৈর্যের পরীক্ষা দিয়েছেন। সত্যনিষ্ঠায় সুদৃঢ় থেকেছেন। মিথ্যাকে আশ্রয় করেননি। সত্যের নির্মলতম আদর্শ রক্ষা করেছেন সব সময়। নিজের ছেলে-মেয়েদের মানুষ করে তোলার ব্যাপারে আপস করেননি। মিথ্যা সুবিধার ভোগবাদিতায় আকৃষ্ট হননি। প্রতিকূল পরিবেশে লড়াই করেছেন।
প্রকৃতিই বোধ করি তাঁকে আদর্শ এক মানুষে পরিণত করেছে। জীবনের যে সময়ে উচ্ছলতায় ভেসে যাওয়ার কথা তখনই পেয়েছেন সবচেয়ে বড় আঘাত। এর পর থেকেই তো শুরু হয়েছে জীবনসংগ্রাম; যে সংগ্রাম এখনো শেষ হয়নি তাঁর।
আজ তাঁর জন্মদিন। জন্মদিনে অনেক অনেক শুভেচ্ছা জানাই তাঁকে। তাঁর জয় হোক। আজকের দিনে তাঁকে অভিনন্দন জানাই কবিগুরুর ভাষায়, ‘সন্ত্রাসের বিহ্বলতা নিজেরে অপমান।/সঙ্কটের কল্পনাতে হোয়ো না ম্রিয়মাণ/মুক্ত করো ভয়,/আপনা-মাঝে শক্তি ধরো, নিজেরে করো জয়।/দুর্বলেরে রক্ষা করো, দুর্জনেরে হানো,/নিজেরে দীন নিঃসহায় যেন কভু না জানো।/মুক্ত করো ভয়,/নিজের ’পরে করিতে ভর না রেখো সংশয়।/ধর্ম যবে শঙ্খরবে করিবে আহ্বান/নীরব হয়ে নম্র হয়ে পণ করিয়ো প্রাণ।/মুক্ত করো ভয়,/দুরূহ কাজে নিজেরই দিয়ো কঠিন পরিচয়।’
লেখক : অস্ট্রিয়াপ্রবাসী লেখক, মানবাধিকারকর্মী ও সাংবাদিক
nazrul@gmx.at
সূত্র : কালের কন্ঠ