মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কানাডায় অনুষ্ঠিত বিশ্ব শীর্ষ ক্ষমতাধর ৭ রাষ্ট্রের সংস্থা জি-সেভন আউটরিচ সম্মেলনে যোগদান করেছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, গ্রেট ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি, জাপান ও ইতালি এই সংস্থার সদস্য রাষ্ট্র। এক সময় পুঁজিবাদী দুনিয়াকে সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ রাখার জন্য এই সংস্থা বিশেষ ভূমিকা রাখত। শুধু অর্থনৈতিক বিষয়াদিতেই নয়, রাজনৈতিকভাবে উক্ত ধনী রাষ্ট্রসমূহ নিজেদের প্রভাব বৃদ্ধি, সমাজতন্ত্রের প্রভাব রোধ করা, তৃতীয় বিশ্ব বলে খ্যাত সদ্য স্বাধীন দেশগুলোর ওপর নজর রাখতেও কৌশল নির্ধারণ করত বলে সকলে জানত। ১৯৯০-৯১ এর দিকে সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ার বাস্তবতা ভেঙে যাওয়ার পর জি-সেভেনের নীতি-কৌশলেও এরপর পৃষ্ঠা ৭, কলাম
(শেষ পৃষ্ঠার পর) পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে। বিশ্ব রাজনীতি, অর্থনীতি, কুটনীতি ইত্যাদিতে গত প্রায় তিন দশকে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে গেছে। এখন জি-সেভেন আর আগের দর্শনে নেই, এর প্রতিপক্ষ সংস্থার ভেতর ও বাইরে বেড়ে উঠেছে। অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে জার্মানি, চীন, রাশিয়ার অবস্থান নতুনভাবে মোড় নেওয়ার শঙ্কা এখন আর আদর্শিক জায়গায় নেই, বরং রাষ্ট্র রাষ্ট্রতে গড়ে উঠেছে। কানাডা সম্মেলনে মার্কিন প্রেসিডেন্টের বক্তব্য ও অবস্থান সেই দ্বন্দ্ব ও দূরত্বের নজির বহন করে। তারপরও বিশ্বে পরাশক্তি সমূহের সংস্থাটি টিকে আছে, এগিয়েও যাচ্ছে। পরিস্থিতির ওপরই এর মধ্যকার সম্পর্কের নানা রূপ দেখা দিতে পারে। কানাডা সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যে অবস্থান নিয়েছেন তা আমেরিকার স্থায়ী নীতি হয়তো নাও হতে পারে। তবে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে যত বিরোধই দেখা যাক না কেন তা বিশ্ব ব্যবস্থার সাম্প্রতিক সম্পর্কের উত্তেজনার প্রতিফলন হলেও এই রাষ্ট্রগুলো জি-সেভেনের মতো সংস্থাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার মতো নয় মোটেও। সে কারণেই জি-সেভেনকে পৃথিবীর বাকি রাষ্ট্রগুলো গভীর পর্যবেক্ষণে রাখছে, এর প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে কিভাবে নিজেদের অবস্থান ও সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটানো যায় সেই বিবেচনা কাজ করছে। তেমন বাস্তবতার জি-সেভেনের সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তৃতীয়বার অংশগ্রহণের আমন্ত্রণ এবং তাতে যোগদান বিশেষ গুরুত্ব বহন করে।
আগের দুইবার তিনি জি-সেভেন আউটরিচ সম্মেলনে যোগদান করে বাংলাদেশের উন্নয়ন কৌশল নিয়ে কথা বলেছেন, যা জি-সেভেন ভুক্ত দেশগুলোর উন্নয়নশীল দেশগুলোর অভিজ্ঞতা কিছুটা হলেও বুঝতে সাহায্য করেছে। এবার দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট, ভিয়েতনামের প্রধানমন্ত্রী, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীসহ আরও কয়েকজন বিশেষ অধিবেশনে ভাষণ দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবারের সম্মেলনে দেশের আর্থ-সামাজিক অগ্রগতির পাশাপাশি রোহিঙ্গা সমস্যাটি বিশেষভাবে উপস্থাপন করেছেন। এই লাখো রোহিঙ্গা কত নিরাপদে মিয়ানমারে ফিরে যেতে পারে সে ব্যাপারে উন্নত দেশগুলোর করণীয় নির্ধারণের আহবান জানিয়েছেন। জি-সম্মেলনে উপস্থিত বিশ্ব নেতৃবৃন্দ রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রস্তাব বিশেষভাবে সমর্থন করেছেন। বাংলাদেশ সীমিত সম্পদ দিয়ে এমন একটি জটিল মানবিক বিষয়কে বহন করে চলছে, যা আঞ্চলিক ও বিশ্ব শান্তি শৃঙ্খলার জন্য হুমকির কারণ হয়ে দঁড়াতে পারে। সে কারণেই তিনি জি-সেভেন ভুক্ত দেশ সমূহকে এই সমস্যার সমাধানে যথাযথ ভূমিকা রাখতে আবেদন জানিয়েছেন। কানাডার প্রধানমন্ত্রীসহ বিশ্ব নেতৃবৃন্দ শেখ হাসিনার দৃষ্টিভঙ্গি ও দৃঢ় ভূমিকার প্রশংসা করেছেন। বাংলাদেশকে এভাবে বারবার পৃথিবীর শীর্ষ রাষ্ট্র সমূহের সম্মুখে তুলে ধরার মাধ্যমে বাংলাদেশের উদারবাদী নীতির প্রকাশ ঘটছে সর্বত্র, বাংলাদেশের মর্যাদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশ্ব পরিসরে বাংলাদেশ যে যোগ্য, সাহসী ও দূরদর্শী নেতৃত্বের মাধ্যমে উপস্থাপিত হচ্ছে তা বিশেষভাবে উল্লেখ করার মতো। জি-সেভেন আউটরিচ সম্মেলনকে আমরা সেভাবেই দেখতে চাই।
লেখক : অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, বাউবি