অ্যাড. তৈমূর আলম খন্দকার: ব্রিটিশ থেকে পাকিস্তান, পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ; কিন্তু শোষণ ও নির্যাতনের পরিবর্তন হয়নি, পরিবর্তন হয়েছে পদ্ধতি। লুটেরারা জনগণের সম্পদ লুন্ঠনের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে তাদের নিজস্ব পন্থায়, যার গতি পূর্বের চেয়ে কম নয় বরং বেশি। ব্রিটিশ এ দেশকে লুট করার জন্য এসেছিল, সফল হয়েছে, লুটকে গতিশীল করতে দেশি যে দালালদের সহযোগিতা নিয়েছিল তাদেরও ভাগ্যের উন্নয়ন হয়েছে, কিন্তু ছিন্নমূল হয়ে রয়েছে এ দেশের সাধারণ জনগণ যারা দিন দিন গরীব হচ্ছে এবং নুন আনতে পান্থা ফুরানো অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে। চাহিদার তুলনায় অভাবে নেই এ দেশের কয়টি পরিবার রয়েছে এ লুটেরা ও তাদের তাবেদার ছাড়া। একটু গোড়ার দিকে তাকালে লুটের এ নির্মম চিত্র সহজেই অনুমান করা যায়। বাংলার সম্পদ লুন্ঠনে ইংরেজরা একা ছিল না। তাদের পাশে ছিল এ দেশিয় দালাল, গোমস্তা ও বেনিয়া গোষ্টি। গধপধষধু: ঊংংধুং ড়হ খড়ৎফ পষরাব (পৃষ্ঠা-৬৩) বইতে লর্ড মেকেল লিখেছেন যে, ‘কোম্পানির কর্মচারীরা তাদের প্রভু ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জন্য নয়, নিজেদের জন্য, প্রায় সমগ্র অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের ওপর একচেটিয়া অধিকার প্রতিষ্ঠা করে। দেশি লোকদেরকে তারা অত্যন্ত কম দামে উৎপন্ন দ্রব্য বেচতে এবং অন্যদিকে খুবই চড়া দামে বিলেতি পণ্য কিনতে বাধ্য করত। কোম্পানি তাদের অধিনে একদল দেশি কর্মচারী নিয়োগ করত।
এই দেশিয় কর্মচারীরা যে এলাকায় যেত, সে এলাকা ছারখার করে দিত। সেখানে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করত। ব্রিটিশ কোম্পানির প্রতিটি কর্মচারী ছিল তার উচ্চপদস্থ (ইংরেজ) মনিবের শক্তিতে বলিয়ান। আর এই মনিবদের প্রত্যেকের শক্তির উৎস ছিল খোদ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী। (তাদের ব্যাপক লুন্ঠন ও শোষণের ফলে) শীঘ্রই কলকাতায় বিপুল ধন-সম্পদ স্তূপীকৃত হলো। সেই সাথে তিন কোটি মানুষ দুর্দশার শেষ ধাপে এসে দাঁড়াল। বাংলার মানুষ শোষণ ও উৎপীড়ন সহ্য করতে অভ্যস্ত একথা ঠিক, কিন্তু এ ধরনের (ভয়ংকর) শোষণ ও উৎপীড়ন তারাও কোনদিন দেখেনি। (সূত্রঃ সুপ্রকাশ রায় প্রণীত ভারতের কৃষক বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রার্ম পৃঃ ১০ ) ঘুষের প্রচলন যে বৃটিশ আমল থেকেই শুরু হয়েছিল তা ১৭৭৩ সালে ঋড়ঁৎঃয চধৎষরধসবহঃধৎু জবঢ়ড়ৎঃ (পৃষ্ঠা ৫৩৫) এ উল্লেখিত মন্তব্য থেকে প্রমাণ পাওয়া যায়। উক্ত প্রতিবেদনে বলা হয় যে, উৎকোচ নামক দুর্নীতি এদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ব্যাপকভাবে আমদানি করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারীরা ১৭৫৭ থেকে ১৭৬৬ সাল পর্যন্ত মাত্র দশ বছরে ষাট লাখ পাউন্ড আত্মসাত করেছিল।’ ব্যবসায়ের নামে ইংরেজ বণিক কোম্পানির এই দস্যুতার মুখে বহু শিল্প কারিগর উৎপাদনের জন্য অপরিহার্য নিজেদের বুড়ো আঙ্গুল কেটে ফেলে অসহনীয় উৎপীড়ন থেকে বাঁচার চেষ্টা করে। অনেকে বাড়ি-ঘর ছেড়ে বন-জঙ্গলে পালিয়ে যায়। ১৭৫৮ থেকে ১৭৬৩ এই ছয় বছরে কৃষকদের সাথে কারিগরদের একটি অংশ স্থায়ী বেকারে পরিণত হয়। ইংরেজ লেখক রেজিনাল্ড রেনল্ডস উল্লেখ করেছেন, ওই সময়ের মধ্যে ঢাকার বিশ্বখ্যাত মসলিনের এক তৃতীয়াংশ কারিগর ইংরেজ বণিকদের শোষণ-পীড়নে অস্থির হয়ে বনে-জঙ্গলে পালিয়ে গিয়েছিল। (সূত্র: রেজিনাল্ড রেনল্ডাস প্রণীত সাহিবস ইন ইন্ডিয়া, পৃঃ ৫৪)। লেখক : কলামিষ্ট ও আইনজীবি (এ্যাপিলেট ডিভিশন) ঃধরসঁৎধষধসশযধহফধশবৎ@মসধরষ.পড়স