মেজর মো. আখতারুজ্জামান (অব.) : ঋণখেলাপি অতি পরিচিত একটি শব্দ। এটি শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বব্যাপী ব্যাংকিং ব্যবস্থায় ব্যবহৃত একটি শব্দ। সাধারণত ঋণ নিয়ে পরিশোধ না করা হলে তাকে ঋণখেলাপি বলে। তাই খোলা চোখে ঋণখেলাপি অপরাধমূলক কার্যক্রম হিসেবে চিহ্নিত একটি গর্হিত কাজ, যা সাধারণত গ্রহণযোগ্য নয়। কিন্তু ব্যাংকিং কার্যক্রমে তা অহরহ ঘটছে এবং ফুলে-ফেঁপে তা দিন দিন আমাদের ব্যাংকিং ব্যবস্থায় একটি বিশাল অঙ্কে স্ফীত হচ্ছে। তবে ঋণখেলাপি ইচ্ছাকৃত না হলে তা অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে না। কিন্তু বিভিন্ন কারণে আমাদের ব্যাংকিং ব্যবস্থায় ঋণখেলাপি অব্যাহতভাবে বেড়েই চলছে। আমরা কেউই নীতিগতভাবে ঋণখেলাপি মেনে নিতে পারছি না। কিন্তু কোনোভাবেই ঋণখেলাপি বন্ধ তো দূরের কথা, তা নিয়ন্ত্রণেও রাখতে পারছি না। দেশের ব্যাংকিং ও অর্থনীতির তাবৎ দিকপালরা ঋণখেলাপি রোধ বা নিয়ন্ত্রণে রীতিমতো যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন। তারপরও ঋণখেলাপি কিছুতেই নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে না বা নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। সম্প্রতি স্বয়ং অর্থমন্ত্রী আলাদা বিচারক নিয়োগের কথা বলেছেন। যাতে ঋণখেলাপি বন্ধ বা নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে। কিন্তু বাস্তবে আলাদা আদালত করে হয়তো কিছু ঋণখেলাপিকে শাস্তি দেওয়া হবে। কিন্তু ঋণখেলাপি কমার কোনো কারণ হবে না। কারণ ঋণখেলাপি নিজেই একটি অর্থনৈতিক কার্যক্রম। যা যে কোনো ব্যাংকিং ব্যবস্থার অতি স্বাভাবিক ঘটনা। ঋণ কার্যক্রম অব্যাহত থাকলে ঋণখেলাপি থাকবেই। যদি ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনা সঠিক ও সচেতন থাকে, তাহলে হয়তো এর মাত্রা নিম্নমুখী হবে এই যা। কিন্তু ঋণখেলাপি থাকবেই। পৃথিবীর সব দেশে ঋণ থাকলে ঋণখেলাপি হবেই। ঋণখেলাপি সবসময় ইচ্ছাকৃতভাবে হয় না। তাছাড়া ঋণখেলাপি ঋণের একটি শ্রেণি যা ঋণের খাতায় দেখাতেই হবে। কাজেই ঋণ নিলে বা দিলে তা যে শতভাগ পরিশোধিত হবে এর নিশ্চয়তা বিশ্বের কোনো অর্থনীতিবিদ বা ব্যাংকার দিতে পারবে না। ঋণ কার্যক্রমে যে ঋণ একটি নির্দিষ্ট সময়ে অপরিশোধিত থাকবে তা অবশ্যই বুকস অব অ্যাকাউন্টে খেলাপি হিসাবে লিপিবদ্ধ করতে হবে, যা পরবর্তীতে হয় লাভ-লোকসানের সঙ্গে সমন্বয় হবে, অথবা আলাদা হিসাবে পুনর্জীবিত হতে থাকবে। যদি ব্যাংকের লাভ-লোকসানের সঙ্গে খেলাপি ঋণ প্রতি বছর সমন্বয় হয়ে যায় তাহলে বছরের শুরুতে কোনো খেলাপি ঋণ থাকবে না। কিন্তু যদি লাভ-লোকসানের সঙ্গে সমন্বয় না করে তা আলাদা খেলাপি ঋণ হিসাবে রেখে দেওয়া হয় তাহলে খেলাপি ঋণ পুনর্জীবিত হতে থাকবে। যা একদিন বিশাল অঙ্কের পরিমাণ হিসাবে একটি ভয়াবহ চিত্র প্রকাশ পাবে। অথচ বাস্তবে এর কোনো অর্থনৈতিক প্রভাব থাকবে না। অর্থনীতিতে একটি খারাপ চিত্র ফুটে উঠবে যা বস্তুত বায়বিক, এর কোনো বাস্তবিক প্রভাব নেই। কারণ হলো ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণকে আলাদা হিসাবে রেখে দিয়ে তাদের বার্ষিক আয়-ব্যয়ের হিসাব করে মুনাফা নিয়ে নেয় কিন্তু খেলাপি ঋণ যে কোনো ব্যাংকের বাস্তব লোকসান যা তারা তাদের ব্যবহৃত হিসাব পদ্ধতির নামে আলাদা হিসাবে রেখে দিয়ে লভাংশ ভাগ-বাটোয়ারা করে নিয়ে যায়, যা প্রকৃতপক্ষে অপরাধমূলক কার্যক্রম। যদি খেলাপি ঋণ আলাদা খাতায় বা হিসাবে রক্ষিত না হতো তাহলে অবশ্যই তা ব্যাংকের বার্ষিক লাভ-লোকসানে অন্তর্ভুক্ত হতো এবং তখন খেলাপি ঋণ বার্ষিক লাভ-লোকসানের সঙ্গে সমন্বয় হয়ে যেত এবং তখন পুনর্জীবিত খেলাপি ঋণ দেখানোর কোনো সুযোগ থাকত না এবং এত বড় আকারের ঋণখেলাপি দেখিয়ে জাতিকে ধোঁকা দেওয়া সম্ভব হতো না এবং ব্যাংকের পক্ষে এমনভাবে একচেটিয়া মুনাফাও করতে পারত না।
খেলাপি ঋণ যদি পুনর্জীবিত না করে প্রতি বছর ব্যাংকের লাভ-লোকসানের সঙ্গে সমন্বয় করা হতো তাহলে ব্যাংকগুলো অবশ্যই এত লাভ করতে পারত না এবং ব্যাংক রাতারাতি বিশাল ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে দাঁড়াতে পারত না। ব্যাংক বিশেষ করে বাণিজ্যিক ব্যাংক একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান যাদের ব্যবসায়ের মূল পণ্য হলো নগদ অর্থ এবং ঋণ কার্যক্রম। ব্যাংকের আয়ের উপাদান হলো সুদ ও কমিশন। ব্যাংক তাদের লেনদেনকৃত নগদ অর্থের ওপর তাদের ইচ্ছামাফিক সুদ আরোপ করতে পারে যার ফলে মুদ্রা তার প্রকৃত মূল্য হারায় এবং মুদ্রার মানের তারতম্য হয়। ব্যাংকিং ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখা এবং ব্যাংকের মুনাফা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে রাষ্ট্র সুদ ব্যবসাকে অব্যাহতভাবে অনুপ্রাণিত করে যাচ্ছে অথচ রাষ্ট্র এই সুদ ব্যবসায় কোনো রকম হস্তক্ষেপ বা নিয়ন্ত্রণ করতে চায় না বা চাইলেও তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। ব্যাংক জনগণকে উচ্চ সুদে রাখা অর্থ জমা রাখার নামে প্রকাশ্য জোচ্চুরি ও ধোঁকা দিচ্ছে আবার অন্যদিক দিয়ে জনগণের কাছ থেকে সংগৃহীত অর্থ চড়া সুদে ঋণের বাজারে খাটিয়ে বিশাল অঙ্কের মুনাফা কামিয়ে নিয়ে ব্যাংকের কর্মকর্তা থেকে মালিকরা ফুলে-ফেঁপে দিন দিন বিশাল হচ্ছে। জনগণের জমাকৃত অর্থ কখনই ব্যাংক পরিচালকদের বা স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর মূলধন জোগানের ভাণ্ডার হতে পারে না। তা ছাড়া জনগণের অর্থের সঠিক ও নিরাপদ বিনিয়োগ করার দায়িত্ব ব্যাংক তথা ব্যাংকের ম্যানেজমেন্টের দায়িত্ব যা কোনো অবস্থাতেই ব্যাংকের মালিকদের সম্পত্তি হতে পারে না। কিন্তু ব্যাংকগুলোর বেশির ভাগই এখন অনৈতিক আর্থিক কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত, যার ফলে দেশে অব্যাহত হারে খেলাপি ঋণ বাড়ছে, যার সুযোগ নিয়ে ব্যাংকগুলোতে একশ্রেণির দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা তৈরি হচ্ছে, যারা ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে চুষে খাচ্ছে। ব্যাংক কর্মকর্তাদের উচ্চ হারে বেতন, সুযোগ-সুবিধা, তাদের রাজকীয় অফিস, অফিস ব্যবস্থাপনা, কেনাকাটা, অতি ঘন ঘন বিদেশ সফরের বিশাল খায় খরচ বাদ দিয়েও ব্যাংকগুলো প্রতিবছর যে হারে মুনাফা করে তাতেই বোঝা যায়, তারা কেন খেলাপি ঋণকে বার্ষিক আয়-ব্যয়ের সঙ্গে সমন্বয় না করে প্রতি বছর তা পুনর্জীবিত করে দেখাচ্ছে। যদি খেলাপি ঋণকে বার্ষিক আয়-ব্যয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা হতো, তা হলে ব্যাংক ম্যানেজমেন্টকে খেলাপি ঋণের জন্য জবাবদিহি করতে হতো। কিন্তু খেলাপি ঋণ আলাদা করে দেখিয়ে পুনর্জীবিত করার কারণে খেলাপি ঋণ ব্যাংকের লাভ-লোকসানে কোনো দায় সৃষ্টি করছে না এবং এর সব দায়-দায়িত্ব ঋণগ্রহীতার মাথার ওপর গিয়ে পড়ছে। খেলাপি ঋণ পুনর্জীবিত করে দেখানোর ফলে আজ খেলাপি ঋণ নিয়ে এত হৈচৈ হচ্ছে এবং জনমনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হচ্ছে। আমরা সবাই এখন ডালাওভাবে ঋণখেলাপিদের এককভাবে দায়ী করছি। কিন্তু সব ঋণখেলাপিকে এক পাল্লায় না মেপে আমরা যদি ঋণখেলাপির কারণগুলো চিহ্নিত করে তার পরে ঋণখেলাপিদের দায়ী করে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে পারতাম, তাহলে খেলাপি ঋণের সংস্কৃতি বাংলাদেশে গড়ে উঠত না। অনেকে বলেন, ব্যাংক থেকে টাকা ঋণ নাও তারপরে দেশ থেকে পালিয়ে যাও!
আমরা ঋণখেলাপিদের তিন ভাগে ভাগ করতে পারি। প্রথম ভাগ বৃহত্তর ঋণখেলাপি, যারা খেলাপি ঋণের পরিমাণের প্রায় ৭০ ভাগ কিন্তু সংখ্যায় হাজারেরও কম। দ্বিতীয় ভাগ মধ্যম ঋণখেলাপি। যারা সংখ্যায় ১০ হাজারের কম এবং পরিমাণে মোট খেলাপি ঋণের ২০ শতাংশ। তৃতীয় ভাগ হলো সবচেয়ে দুর্ভাগ্যপীড়িত হাজার হাজার ঋণগ্রহীতা, যারা পেটের ধান্দায় এবং বেঁচে থাকার তাগিদে বিভিন্ন ক্ষুদ্র ও দৈনন্দিন ব্যবহারের জন্য ঋণ নিয়েছিল এবং তাদের ঋণখেলাপির পরিমাণ মোট খেলাপি ঋণের মাত্র ১০ শতাংশ। কিন্তু এই ১০ শতাংশ খেলাপি ঋণের হাজার হাজার গ্রহীতার ওপর ব্যাংকের এবং সরকারের হম্বিতম্বি সবচেয়ে বেশি। তাদের ওপর সব ঋণদাতার খড়গহস্ত। বেচারারা তাদের বাড়িঘর বন্ধক রেখে কনজ্যুমার বা গৃহনির্মাণ বা কৃষি ঋণ নিয়েছিল; কিন্তু প্রতিকূল অবস্থার কারণে তাদের ঋণ সময়মতো পরিশোধ করতে পারেনি। যার ফলে তারা বিশাল সংখ্যায় ঋণখেলাপি। অথচ একজন বড় ঋণখেলাপির যে পরিমাণ সুদ মাফ করা হয় তা এই ক্ষুদ্র ঋণ গ্রহীতাদের তাবৎ আসল টাকাও তার চেয়ে কম। তাই বলে জনগণ ঋণখেলাপিদের ঋণ মাফ করে দেওয়ার পক্ষে নয়। ঋণ মাফ করে দিয়ে খেলাপি ঋণের সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসা যাবে না। যদিও স্বাভাবিক খেলাপি ঋণ দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে না। কারণ ঋণ যা প্রদান করা হয়েছে তা দেশের জিডিপিতে এবং জনগণের মৌলিক চাহিদা পূরণে পরোক্ষভাবে বিনিয়োগ হয়েছে যা জনজীবনে প্রভাব রেখেছে। কিন্তু সমস্যা হয়েছে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের ঋণ নিয়ে। কারণ ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের অর্থ দেশের মুদ্রাস্ফীতি ও দুর্নীতির সঙ্গে সরাসরি জড়িত এবং জিডিপিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। এই ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপির পেছনে শুধু ঋণগ্রহীতাই দায়ী নয়, এর সঙ্গে ব্যাংকের মালিকপক্ষ, ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন নির্বাহীরা, ব্যাংক নিয়ন্ত্রণকারী কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি অসাধু স্বার্থান্বেষী মহল, অর্থ মন্ত্রণালয়ের কতিপয় দুর্নীতিবাজ ও রাজনৈতিক আশ্রিত কর্মকর্তা এবং কিছু ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক ব্যক্তি সরাসরি দায়ী। ব্যাংকের কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ সব সময় ব্যাংক ও মুদ্রা নিয়ন্ত্রণের জন্য অত্যন্ত যুগোপযোগী ও সুন্দর সুন্দর প্রচুর নির্দেশনা দিয়ে আসছেন। কিন্তু সরষের মধ্যে ভূত থাকার কারণে সেসব নির্দেশনা তেমন কাজে আসছে না। যেমন ব্যাংক পাড়ায় ঘুরলে প্রায়ই দেখা যায় ঋণের জন্য শাখা থেকে হেড অফিস পর্যন্ত সাধারণ ঋণগ্রহীতারা ১০-২০ কোটি টাকার বা কম অঙ্কের ঋণের জন্য মাথা খুঁড়ে মরছেন। এই ডকুমেন্ট দেও তো ওই ডকুমেন্ট দাও। CRM বা ক্রেডিট রিস্ক ম্যানেজমেন্টের বিশাল ফরম পূরণ কর, যার জন্য একজন এমবিএ পাস লোক নিতে হয়। না হলে কোনো কোম্পানির দারস্থ হতে হয়। শুধু তাই নয়, লাগাতার তিন বছরের নিরীক্ষিত হিসাব প্রদান করতে হয়। স্টক রিপোর্ট দিতে হয়। তার ওপর ঋণের দ্বিগুণ পরিমাণ নিষ্কণ্টক সম্পত্তির নির্ভেজাল একগাদা দলিল-দস্তাবেজ জমা দিতে হয়। তার পর ভাগ্য ভালো হলে ঋণ অনুমোদন হয় তাও ১৩৭টি শর্ত পূরণ সাপেক্ষে এবং সম্পত্তি বন্দক দিয়ে। সব শর্ত পালন করে তার পরই ঋণের টাকা পাওয়া যায়। শুধু তাই নয়, ঋণগ্রহীতার নিজ খরচে ব্যাংকের কর্মকর্তাদের নিয়ে প্রতিষ্ঠান ও স্টক পরিদর্শন করাতে হয়। তারপর কর্মকর্তাদের সন্তুষ্ট করাতে পারলে তাদের পরিদর্শন রিপোর্ট পাওয়া যায় এবং সেই রিপোর্টটি বড় সাহেবদের মনমতো হলে তারপর ঋণের অর্থ ছাড় করা হয়। ক্ষুদ্র এবং মধ্যম পরিমাণ ঋণ নেওয়া একটি যুদ্ধ এবং সেই যুদ্ধে জয়ী হতে পারলেই ঋণ নেওয়া সম্ভব। কিন্তু সেই যুদ্ধের বিভিন্ন খরচাদি বহন ও কালক্ষেপণের কারণে ঋণ পরিশোধের ক্ষমতা গ্রহীতা হারিয়ে ফেলে। যার ফলে ঋণটি খেলাপি হয়ে যায়। তা ছাড়া ঋণ পেতে বিভিন্নভাবে হয়রানি এ কালক্ষেপণের কারণে ঋণগ্রহীতা ব্যাংক কর্মকর্তা বা কর্তৃপক্ষের প্রতি বৈরী হয়ে পড়ে। যার ফলে ক্ষুদ্র ও মধ্যম অঙ্কের ঋণ প্রায়ই খেলাপি হয়। তবে এই ঋণ সম্পূর্ণভাবে আদায় যোগ্য। এসব ঋণ প্রথমবার খেলাপি হয়ে পড়লেও ব্যাংক যদি সহানুভূতির সঙ্গে এই ঋণখেলাপিদের সমস্যাগুলোর সঠিক পরিচর্যা করে তাহলে পরবর্তীতে এই ক্ষুদ্র ও মধ্যম ঋণগুলো আর খেলাপি থাকে না। কিন্তু সমস্যা হয়েছে বৃহত্তর খেলাপি ঋণগুলো নিয়ে। বৃহৎ ঋণগুলো দেওয়া হয় সমাজের তথাকথিত উচ্চ ও প্রভাবশালীদের। এই ঋণগুলোর অনুমোদন প্রক্রিয়ার কোনো নিয়মকানুন মানা হয় না। সম্পূর্ণ ঋণ প্রক্রিয়ায় ব্যাংক ব্যবস্থাপনার প্রভাবশালী পরিচালক, ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন সব নির্বাহী, বা পরিচালকদের অনুগত শাখা প্রধান ও তার সাঙ্গপাঙ্গ মিলে বিভিন্ন ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে রকেট গতিতে এসব ঋণ অনুমোদন করা হয় এবং অনুমোদনের সঙ্গে সঙ্গে সেই ঋণ বিতরণ করা হয়। এমন কি নিয়মকানুন না থাকলেও নিয়ন্ত্রণকারীর অনুমোদন সাপেক্ষে লিখে সেই ঋণ বিতরণ হয়ে যায় এবং চমৎকারভাবে নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান যথাযথ অনুমোদন দিয়েও দেয়। এসব ঋণ কখনই ফেরত আসে না এবং আসবেও না। সব আইনের হাত সেখানে বাঁধা। এসব ঋণের সিংহভাগ খেলাপি। তাই খেলাপি ঋণ ব্যাংকের লাভ-লোকসানের সঙ্গে সমন্বয় হলে এই বড় অঙ্কের খেলাপি শতভাগ বন্ধ হয়ে যাবে বলে জনগণের বিশ্বাস।
পরিশেষে খেলাপি সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসার জন্য কতিপয় সুপারিশ করা হলো : (১) প্রতি বছরের খারাপ খেলাপি ঋণ ব্যাংকের প্রতি বছরের লাভ-লোকসানের সঙ্গে সমন্বয় করা হোক, (২) খেলাপি ঋণের কারণ ও চাহিদা নিরূপণ করে যদি দেখা যায় পরবর্তী সময়ে আদায় হয়ে যাবে তাহলে বার্ষিক আয়-ব্যয়ের সঙ্গে সমন্বয় না করে মেয়াদ বৃদ্ধি করে প্রয়োজনে ত্বরিত অতিরিক্ত ঋণ দেওয়ার নিয়ম রাখা হোক, (৩) ঋণপ্রাপ্তিতে CIB-এর নিষেধাজ্ঞা রহিত করা হোক এবং CIB শুধু ঋণের তথ্য হিসাবে কাজ করবে যা কোনো অবস্থাতেই ঋণপ্রাপ্তির বাধা হিসেবে গণ্য হবে না, (৪) ঋণ পুনঃতফসিল করার জন্য ডাউন পেমেন্ট নিয়ম সবার জন্য রহিত করা হোক, (৫) কোনো ব্যাংক কোনো আর্থিক বছরে লোকসান দিলে তাত্ক্ষণিকভাবে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে দায়-দায়িত্ব দিয়ে চাকরিচ্যুত করতে হবে, (৬) ঋণ অনুমোদনে ও দৈনন্দিন ব্যাংক পরিচালনায় পরিচালনা পর্ষদের কর্তৃত্ব রহিত করতে হবে এবং সব ধরনের ঋণ অনুমোদন ও দৈনন্দিন পরিচালনা ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার অধীনে নির্বাহীরা পরিচালনা করবেন, (৭) ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদের সাপ্তাহিক বা মাসিক নিয়মিত সভা নিষিদ্ধ করতে হবে, (৮) খেলাপি ঋণের সব দায়ভার ব্যাংক বহন করবে, (৯) পরিচালনা পর্ষদ ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীসহ ব্যাংকের টপ ম্যানেজমেন্ট তথা বিভাগীয় প্রধান, অডিটর ও অডিটর কোম্পানি ও পরিদর্শন টিম নিয়োগ ও প্রত্যাহার, বিশেষ অবস্থা বিবেচনা ও সিদ্ধান্ত, বার্ষিক আর্থিক প্রতিবেদন বিবেচনা ও অনুমোদন এবং ব্যাংকিং ও কোম্পানি আইনে প্রদত্ত কার্যক্রম পরিচালনা করবে।
ঋণখেলাপি অব্যাহতভাবে চলতে পারে না। ঋণখেলাপি যদিও কোনো অপরাধ নয়, কিন্তু ইচ্ছাকৃত খেলাপি অবশ্যই অপরাধ; কিন্তু সেই অপরাধ প্রভাবশালীরা করে যার ফলে আইন বা বিচারের সেখানে কিছু করা খুব কঠিন হয়ে যায়। তাই জনগণের প্রত্যাশা প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার এবং বাস্তবভিত্তিক কিছু কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ঋণখেলাপি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার চেষ্টা অনেক বেশি ফলপ্রসূ হতে পারে। লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য।
সুত্র : বাংলাদেশ প্রতিদিন