ডেস্ক রিপোর্ট : আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে মানিকগঞ্জ-৩ আসনে চলছে ভোটের হাওয়া। বড় দলগুলোর হেভিওয়েট একাধিক সম্ভাব্য প্রার্থী দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন নির্বাচনী ময়দান। বিএনপির টার্গেট হারানো আসন পুনরুদ্ধার আর আওয়ামী লীগ আসন ধরে রাখার চেষ্টায় চালাচ্ছে নানা কৌশল। এখানে বিএনপির হেভিওয়েট হিসেবে জনপ্রিয়তার শীর্ষে অবস্থান করছেন সাবেক মন্ত্রী, প্রয়াত হারুনার রশিদ খান মুন্নুর কন্যা, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও জেলা বিএনপির সভাপতি আফরোজা খান রিতা। দলীয় চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া বছর কয়েক আগে মানিকগঞ্জের সিংগাইরের একটি জনসভায় আফরোজা খান রিতাকে মানিকগঞ্জ-৩ আসনের দলীয় প্রার্থী ঘোষণা করায় তিনিই হচ্ছেন এখানকার বিএনপির একক প্রার্থী। আর আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থী হিসেবে পুনরায় মনোনয়ন পেতে মাঠে আছেন স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী জাহিদ মালেক স্বপন ছাড়াও দলের একাধিক সম্ভাব্য প্রার্থী।
আর ১৪ দলের শরিক দল জেলা জাসদের সভাপতি ইকবাল হোসেন খান জোটের মনোনয়ন না পেলেও তিনি এককভাবে নির্বাচন করার ঘোষণা দিয়েছেন। এছাড়া নির্বাচনের আগে গণফোরাম ছেড়ে দেয়ায় বঙ্গবন্ধু সরকারের সাবেক সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মফিজুল ইসলাম খান কামাল আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশীদের ভাবনার কারণ হয়ে উঠেছেন।
মানিকগঞ্জ-৩ আসনটি জেলা শহর ও পৌরসভাকেন্দ্রিক হওয়ায় ভোটার ও দলীয় নেতাকর্মীদের কাছে এটি অতি গুরুত্বপূর্ণ আসন। কারণ এই আসন জুড়েই জেলার সবগুলো রাজনৈতিক দলগুলোর প্রধান আন্দোলন-সংগ্রাম পরিচালিত হয়ে আসছে। মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার ১০টি, সাটুরিয়ার ৯টি ইউনিয়ন ও মানিকগঞ্জ পৌরসভা নিয়ে গঠিত এই আসনে ১৯৭৩ সালের নির্বাচন পরবর্তী ২০১৪ সালের নির্বাচন পর্যন্ত বিএনপি ৬ বার, আওয়ামী লীগ ২ বার ও জাতীয় পার্টি ২ বার জয়লাভ করে।
মানিকগঞ্জ-৩ আসনটি বরাবরই ছিল বিএনপির দুর্গ। ১৯৯১ সাল থেকে ’৯৬ সালের নির্বাচন পর্যন্ত বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য প্রয়াত নিজাম উদ্দিনের সঙ্গে আওয়ামী লীগের কোনো প্রার্থীই জয়লাভ করতে পারেনি। ১৯৯৭ সালে নিজাম উদ্দিন ইন্তেকাল করলে আসনটি শূন্য হয়ে যায়। সে সময় উপনির্বাচনে বিএনপি থেকে মনোনয়ন দেয়া হয় অ্যাডভোকেট ওহাব আলী খানকে। তার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে হেরে যান আওয়ামী লীগের শক্তিশালী প্রার্থী ঢাকা সিটির সাবেক মেয়র প্রয়াত কর্নেল এম এ মালেক। এরপর ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপির হেভিওয়েট প্রার্থী হিসেবে বিএনপির চেয়ারপারসন মনোনয়ন দেন বিশিষ্ট শিল্পপতি ও বর্ষীয়ান নেতা হারুনার রশিদ খান মুন্নুকে। ওই নির্বাচনে তার প্রধান প্রতিপক্ষ ছিলেন প্রয়াত কর্নেল মালেকের পুত্র আওয়ামী লীগের প্রার্থী জাহিদ মালেক স্বপন। সে নির্বাচনে বিশাল ভোটে জয় পান সাবেক মন্ত্রী প্রয়াত হারুনার রশিদ খান মুন্নু। ২০০১ সালের নির্বাচনে দল থেকে তাকে একই সঙ্গে মানিকগঞ্জ-৩ ও মানিকগঞ্জ-২ আসনে দলীয় মনোনয়ন দিলে দুটোতেই মুন্নুর কারিশমায় বিপুল ভোটে জয় পায় বিএনপি। পরে তিনি মানিকগঞ্জ-২ আসন ছেড়ে মানিকগঞ্জ-৩ আসন (সদর) রেখে দেন। তার বড় কন্যা মুন্নু গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আফরোজা খান রিতাকে একজন দক্ষ ও জনপ্রিয় রাজনীতিবিদ হিসেবে তৈরি করায় মানিকগঞ্জ জেলা বিএনপিতে বর্ষীয়ান নেতাদের শূন্যতা পূরণ হয়েছে। জেলা বিএনপি ও তার অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের কাছে এখন আফরোজা খান রিতাই হচ্ছেন জেলা বিএনপির অভিভাবক।
জেলা বিএনপির কর্ণধার হিসেবে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে তার প্রধান চ্যালেঞ্জ মানিকগঞ্জ-৩ আসনসহ জেলার সবগুলো আসন পুনরুদ্ধার করা। আফরোজা খান রিতা সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় নেতাকর্মীদের নিয়ে সার্বক্ষণিক কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি শুধু মানিকগঞ্জ-৩ আসন নিয়েই বসে নেই। জেলার তিনটি আসনেই বিএনপিকে আরো বেশি সু-সংগঠিত করতে কাজ করে যাচ্ছেন। দীর্ঘদিন ধরেই জেলাব্যাপী দলীয় সকল কর্মকাণ্ড, কর্মসূচি তার নেতৃত্বে এবং দিকনির্দেশনাতেই চলছে। নেতাকর্মীদের সুখে-দুঃখে, বিপদে-আপদে তিনি সবসময়ই পাশে থাকছেন।
মানিকগঞ্জ-৩ আসনে ১৯৭৩ সালে প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য হয়েছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মফিজুল ইসলাম খান কামাল। এরপর টানা ৩৫ বছর আওয়ামী লীগের কোনো প্রার্থী এখানে নির্বাচিত হতে পারেনি। এ আসনে সাধারণ ভোটাররা ছিল বিএনপির প্রতি অন্ধভক্ত। তবে ৩৫ বছরের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটে ২০০৮ সালের নির্বাচনে। সে সময় আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান বিশিষ্ট ব্যবসায়ী জাহিদ মালেক স্বপন। বিএনপির হেভিওয়েট প্রার্থী হারুনার রশিদ খান মুন্নুকে পরাজিত করেন তিনি। এরপর ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে বিজয়ের ধারা অব্যাহত রাখেন। উপহার হিসেবে পান মন্ত্রিত্ব। আগামী নির্বাচনেও স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী জাহিদ মালেক স্বপন দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশী হিসেবে ভোটের মাঠে জোরেশোরেই নেমেছেন। তবে এই আসনে আওয়ামী লীগের ভেতর অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও গোপন বিরোধ রয়েছে। এই অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের জের হিসেবে আগামী নির্বাচন আওয়ামী লীগের জন্য কঠিন হয়ে উঠতে পারে বলে স্বয়ং মন্তব্য আওয়ামী লীগের ভেতরেই। সর্বশেষ জেলা আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে বেশ কয়েক জন ত্যাগী নেতৃবৃন্দ পদ-পদবি থেকে বঞ্চিত হওয়ার বিষয়টা নির্বাচনের আগেই সামনে আসতে পারে। শুধু জেলাই নয়, উপজেলা পর্যায়েও আওয়ামী লীগের অনেক ত্যাগী নেতৃবৃন্দও কমিটিতে স্থান না পাওয়ায় ভেতরে ভেতরে ক্ষোভ রয়েছে। তবে আগামী নির্বাচনে এখানে আওয়ামী লীগের শক্তিশালি প্রার্থী হিসেবে স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী জাহিদ মালেক স্বপন রয়েছেন নিজ দলের অন্যসব মনোনয়ন প্রত্যাশী প্রার্থীদের চাইতে এগিয়ে। এলাকায় রয়েছে তার ঘন ঘন যাতায়াত। পাশাপাশি সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে মাঠে আছেন এফবিসিসিআই’র পরিচালক ও জেলা আওয়ামী লীগের শিল্পবিষয়ক সম্পাদক তাবারাকুল তোসাদ্দেক হোসেন খান টিটো। ব্যবসায়ী নেতা হিসেবে তার আলাদা একটা পরিচয় রয়েছে সর্বমহলে। এই প্রথমবারের মতো মনোনয়ন প্রত্যাশী হিসেবে চালাচ্ছেন গণসংযোগ। নির্বাচনী এলাকার আনাচে কানাচে তরুণ এই নেতার ব্যানার ও ফেস্টুন শোভা পাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে তরুণদের নেতৃত্ব দিতে হবে। সেই নেতৃত্বের সুযোগ নিতেই তিনি দলীয় মনোনয়ন চাইবেন বলে জানিয়েছেন।
আরেক মনোনয়ন প্রত্যাশী আমেরিকা প্রবাসী ড. রফিকুল ইসলাম গণসংযোগে নেমেছেন। গণসংযোগ চালাতে গিয়ে সম্প্রতি নিজ দলের নেতাকর্মীদের হাতে মারধরের শিকারও হয়েছেন। এছাড়া আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন চাইবেন জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক বদরুল ইসলাম খান বাবলু। সে এখানে নিজেকে যোগ্য প্রার্থী হিসেবে মনে করেন এবং মনোনয়ন পাবার বিষয়ে আশাবাদী। তার দাবি সে প্রতিনিয়তই গণসংযোগ চালাচ্ছেন।
একসময় এখানে জাতীয় পার্টির একটা অবস্থান ছিল। এরশাদ সরকারের সময় দলটি এখানে দুইবার সংসদ সদস্য পদ পেয়েছিলো। এরপর ১৯৯১ সালের নির্বাচনের পর থেকে ভোটের রাজনীতিতে দলটি আর ফিরে আসতে পারেনি। ২০০৮ ও ২০১৪ সালের নির্বাচনে তারা মহাজোটবদ্ধ থাকায় এখানে জাতীয় পার্টি তাদের দলীয় কোনো প্রার্থী দেয়নি। তবে আগামী নির্বাচনে তাদের সুর ভিন্ন। জেলা জাতীয় পার্টি নেতৃবৃন্দ তাদের প্রার্থী দেবে- এমনটা জানিয়ে জেলা জাতীয় পার্টির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট হাসান সাঈদ বলেন, আওয়ামী লীগ আমাদের ঘাড়ে পা দিয়ে ক্ষমতায় এসেছে। যার ফলে আমরা তৃণমূলে বরাবরই মনোনয়ন বঞ্চিত হয়ে আসছি। তৃণমূলের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আমাদের আলোচনা হয়েছে। আমরা এই মহাজোটে থাকতে চাই না। আগামী নির্বাচনে আমরা জেলার তিনটি আসনেই প্রার্থী দেবো। সেক্ষেত্রে এই নেতার মতে মানিকগঞ্জ-৩ আসনে জাতীয় পার্টির মনোনয়ন চাইবেন কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম মহাসচিব জহিরুল আলম রুবেল, জেলা জাতীয় পার্টির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট হাসান সাঈদ ও জেলা জাতীয় পার্টির সহ-সভাপতি এম হাবিবুল্লাহ।
১৯৭৩ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন বীর মুক্তিযোদ্ধা মফিজুল ইসলাম খান কামাল। তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক। পরে তিনি ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে গণফোরাম গঠন করেন। অতি সম্প্রতি তিনি গণফোরাম থেকে পদত্যাগও করেছেন। তবে কি কারণে পদত্যাগ করেছেন কিংবা তার আগের ঘরে ফিরে যাবেন কিনা সে বিষয়ে এই মুহূর্তে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি নন। তবে সুষ্ঠু পরিবেশ থাকলে তিনি আগামী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ঘোষণা দিয়েছেন। নির্বাচনের বছর খানেক আগে গণফোরাম ছেড়ে দেয়াটাকে ভাবিয়ে তুলেছেন এই আসনে আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থীদেরকে। সূত্র : মানবজমিন