রাজেকুজ্জামান রতন : আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সাহেব গতকাল দুর্নীতিপরায়ণ সকল নেতা কর্মীদেরকে সতর্ক করে বলেন, বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে আদালতের রায় সকলের জন্য একটি সতর্কবার্তা। তার এই কথা যদি শুধু একটা মন ভুলানো, লোক শুনানো কথা হয়, তাহলে সে ক্ষেত্রে কিছু বলার নেই। যদি তারা সেটাকে সতর্কতা হিসেবে মনে করেন, তাহলে তাদেরকে অনেক গুলো ঘটনার মাধ্যমে তার প্রমাণ দিতে হবে। এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য, একথা কি সত্যই দুর্নীতিবাজদের জন্য সতর্কবার্তা হলো নাকি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের রেহাই নেই, এই ধরণের মানসিকতার প্রতিফলন হলো? তা না হলো ফারমার্স ব্যাংক, জনতা ব্যাংকসহ জনগণের টাকা অন্যত্রে সরিয়ে নেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ আছে।
পে-অর্ডারের মাধ্যমে ঘুষ নেওয়ারও অভিযোগ কিংবা আমাদের অর্থমন্ত্রী বলেছেন যে, মেগা বাজেটের প্রজেক্ট মানি হলো মেগা চিটিং-এর সম্ভাবনা। কিংবা আমাদের বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে কেলেঙ্কারী । কিংবা সর্বশেষ যেটা দেখলাম, আমাদের জনতা ব্যাংক থেকে একজনের নামে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা সরিয়ে নেয়া হলো। তা সবই কিন্তু দুর্নীতি ও লুন্ঠণের এক একটি প্রমাণ। আমাদের কেউ কিন্তু এই প্রমাণ গুলো দেয়নি । প্রতিষ্ঠানগুলো কিন্তু নিজেরাই এই প্রমাণগুলো দিয়েছে। প্রচার মাধ্যমগুলো শুধু এগুলো প্রচার করেছে।
এখন আমরা মনে করি যে, আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি দাড়িয়ে আছে সাধারণ মানুষের পরিশ্রমের রক্ত গামে। বাংলাদেশের কৃষকরা তাদের পরিশ্রম দ্বারা তাদের জমিতে কষ্ট করে ফসল ফলান। বাংলাদেশের শ্রমিকরা পৃথিবীর সর্বনি¤œ মুজুরীতে কাজ করে অর্থ যোগায়। তারাই তো আমাদের দেশের উৎপাদন বাড়ায়, জিডিপি বাড়ায়, রপ্তানি বাড়ায়। বাংলাদেশের প্রবাসী শ্রমিকরা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অমানবিক পরিস্থিতিতে নিপিড়ন সহ্য করে কাজ করে আমাদের জন্য অর্থ পাঠায়। তাদের এই টাকার পরিমাণটাও কিন্তু কম না। প্রায় ১৫ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশে আরেক প্রকারের লোক যারা সুদের বিরাট বোঝা মাথায় নিয়ে গ্রামে গ্রামে ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে জীবন যাপন করে, তাদের পরিমাণটাও কিন্তু কম নয়। এই চারটি ধাপের উপরেই মূলত আমাদের অর্থনীতির চাকা দাঁড়িয়ে।
বাংলাদেশের অর্থনীতি একটি লুঠপাঠের অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছে। দেশের অভ্যন্তরে লুটপাটের এক মহা ভয়াবহ চিত্র দেখছি। দেশের বাইরে টাকা পাচার হয়ে যাওয়ার মহা খেলায় মত্ত হতে দেখেছি। আমাদের দেশের টাকা দেশে থাকছে না, বিদেশে পাচার করে দিচ্ছে, এটাতো নিত্যদিনের কাজের মত হয়ে গেছে অনেকটা। বিশ বছর আগে যাদের অর্থ সংকট ছিল তারা এখন বিশাল বিত্তবানে পরিণত হয়েছে। এগুলো দেখার জন্যতো আমাদের দুর্নীতি দমন কমিশনেরও প্রয়োজন নেই। আবার পুলিশি তদন্তেরও প্রয়োজন নেই। আমাদের সবার সাদা চোখেইতো সুস্পষ্টভাবে দেখা যায়। আমাদের সুন্দরবন থেকে শুরু করে রামপাল পর্যন্ত যে ঘটনা ঘটলো তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
ফলে সেতুমন্ত্রীর এই কথা যদি সত্যিকার অর্থেই দুর্নীতিগ্রস্থ নেতাদেরকে উদ্দেশ্য করে বলেন, তাহলে আমরা যারা সাধারণ মানুষের জন্য রাজনীতি করি, তারা দারুনভাবে আশ্বস্থ হবার উপাদান খুঁজে পাবো। কারণ, কিছু দিন আগেও আমরা বিদ্যুতের দাম কমানোর জন্য একটি কমিটি গঠন করেছিলাম। সেখানে দেখিয়েছিলাম, কিভাবে দুর্নীতি ও চাঁদাবাজী কমালে বিদ্যুতের দাম কমানো যাবে। সেখানে দেখানো হয়েছিল বিদ্যুতের দাম তো বাড়ানোর প্রয়োজনই নেই বরং কমানো যাবে।
অতএব, সমস্ত ক্ষেত্রে এই দুর্নীতি, লুটপাট, অর্থপাচার একপ্রকার বিষফোঁড়ার মত কাজ করে। যার জ্বালা আমাদের সাধারণ মানুষকে ভোগ করতে হয়। জনগণ যে এটা কতভাবে ভোগ করছে তার কিছু উদাহরণ দিলে আরো স্পষ্ট হতো। যেমন:- নন এমপিও ভুক্ত শিক্ষকদের আন্দোলন, রেজিষ্টারের জন্য আন্দোলন , জাতীয়করণ করার জন্য আন্দোলন, কেয়ারটেকার সরকার দেওয়ার আন্দোলন, এরূপ অসংখ্য আন্দোলন চলছে। এগুলো সমাধান করতে আর কয় টাকা লাগে? এই টাকা দেয়ার মত ক্ষমতা আমাদের দেশের সরকারের নাই বলে হাহাকার করে অথচ হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হচ্ছে আমাদের। যেখানে অসহায় সাধারণ মানুষ রাস্তার পাশে বসে কাঁদে, সেখানে ভিআইপিদের জন্য আলাদা লেন করার চিন্তা করে সরকার।
সর্বোপরি দেশের একজন গুরুত্বপূর্ণ মানুষের এক কথা যেন কথার কথা না হয়ে কাজে পরিণত হয়। আমাদের এই দেশ এক অপার সম্ভবনার দেশ। এদেশের অভ্যন্তরে যে সম্পদ তৈরী হয়, তাতে যদি চুরি, দুর্নীতি এবং লুটপাট না হয় তাহলে আমাদের দেশকে আরো অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। আর বাংলাদেশে যে দুর্নীতি মামলার শাস্তি হয়েছে, তা যেন রাজনৈতিক কোন কারণে না হয়ে অর্থনৈতিক চালিকা শক্তিকে আরো বিকশিত করার জন্য হয়। আর সাথে সাথে দেশের যেকোন দুর্নীতির ক্ষেত্রেই লড়াই ও বিচার হোক এটাই আমাদের কাম্য।
পরিচিতি : কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, বাসদ
মতামত গ্রহণ : শাখাওয়াত উল্লাহ
সম্পাদনা : মোহাম্মদ আবদুল অদুদ