অনল রায় চৌধুরী, আগারতলা : আগামী ১৮ ফেব্রুয়ারি ভারতের ত্রিপুরা বিধানসভার নির্বাচন। বাংলাদেশের প্রতিবেশি রাজ্য হিসেবে এ রাজ্যের নির্বাচন অনেক গুরুত্ববহন করে। জনমত কার পক্ষে যাচ্ছে তার জন্য অবশ্যই দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করে থাকতে হবে। ১৮ ফেব্রুয়ারি ভোটের পর ৩ মার্চ গণনা হবে। আর এই দিনই কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সব স্পষ্ট হয়ে যাবে পরিবর্তন না প্রত্যাবর্তন। বিভিন্ন দিক থেকে ত্রিপুরার এই বিধানসভা নির্বাচন জাতীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে যথেষ্ট তাপর্যপূর্ণ।
উত্তর পূর্বাঞ্চলের দিকে বিজেপি আরো আগেই তাদের দৃষ্টি নিক্ষেপ করেছে। কারণ সাংগঠনিক শক্তি মজবুত করার ক্ষেত্রে উত্তর পূর্বাঞ্চল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ একটি অঞ্চল। আর এই ক্ষেত্রে ত্রিপুরা সম্ভাবনাময় একটি রাজ্য। উত্তর পূর্বাঞ্চল বিশেষ করে ত্রিপুরা জাতীয় নিরাপত্তা ক্ষেত্রেও একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ফলে বিজেপি যে কোন ভাবেই এই রাজ্যটিকে তাদের নিয়ন্ত্রণে আনতে আগ্রহী।
শুধু তাই নয় জাতীয় রাজনীতিতে সংখ্যা গত দিক থেকে সিপিআইএম তথা বাম মোর্চা অপ্রাসঙ্গিক হলেও মোদি সরকার বিরোধী যেকোন আন্দোলন এবং বিরোধী ঐক্য জোট গড়ার ক্ষেত্রে বামেদের বড় ভূমিকা থাকে। সিপিআইএম নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট বিভিন্নক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকারকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে। আবার রাষ্ট্রতত্ব নিয়েও বিজেপির অবস্থানকে বারংবার এও প্রতিপন্ন করছে বামেরা। ফলে এরাজ্যেটিকে বিজেপির অনুকূলে এলে বামেদের আরো দুর্বল করার চেষ্টা রয়েছে।
অন্যদিকে সিপিআইএম নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্টের জন্যও এই নির্বাচন যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ত্রিপুরা হাত ছাড়া হলে বামেদের ভীত নড়ে যাবে। জাতীয় ক্ষেত্রে পার্টি আরো অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পরবে। এতদিন ত্রিপুরাকে বিকল্পের মডেল বলে সাড়া দেশে প্রচার করেছে বামেরা। আর এক্ষেত্রে বিপর্যয় হলে জাতীয় রাজনীতিতে বড় ধরনের কোন ভূমিকাই নিতে পারবে না বামেরা।
অন্যদিকে এক সময়ে ত্রিপুরার বিরোধী দল হিসাবে থাকা কংগ্রেস জাতীয় ক্ষেত্রের মতই ত্রিপুরাকে অস্তিত্ব সংকটে ভুগছে। কংগ্রেসের সিংহ ভাগ নেতা দল ছেড়ে বিজেপিতে সামিল হয়ে গেছেন। জনাকয়েক নেতা এখন কংগ্রেসের হাল ধরে রেখেছেন। প্রদেশ কংগ্রেসের মূল লক্ষ্য বিজেপিকে ক্ষমতায় আসা থেকে রুখে দেওয়া ফলে সিপিআইএম এর সঙ্গে সে অর্থে এখন বিবাদে নেই বললে চলে।
বর্তমান রাজনীতির পরিস্থিতিতে ত্রিপুরার জনমত প্রকৃতপক্ষে দুটি ভাগে আড়াআড়ি ভাবে বিভক্ত হয়ে গেছে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারনা। ত্রিপুরায় কংগ্রেস অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পরার পর জনমত বাম এবং অবাম দুটি ভাগে বিভক্ত হয়েগেছে। অবাম শিবিরে নেতৃত্বে রয়েছে বিজেপি। আপাতত দৃষ্টিতে এবারই প্রথম নির্বাচনী প্রচারাভিযানে ক্ষমতাসীন সিপিআইএম এর তুলনায় বিজেপি প্রচারে বহুগুণ এগিয়ে গেছে। ইতিপূর্বেই কখনোই রাজ্যে এধরনের পরিস্থিতি লক্ষ্য করা যায়নি।
১৯৭৭ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ত্রিপুরায় বামেদের আধিপত্য বহাল রয়েছে। যদিও ১৯৮৮ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত ৫ বছর কংগ্রেস তৎকালীন আঞ্চলিক দল ত্রিপুরা উপজাতি যুব সমিতির সঙ্গে আঁতাত করে ক্ষমতার স্বাদ ভোগ করে। কিন্তু ১৯৯৩ সালের বিধানসভা নির্বাচনে জোট সরকারের পতন হয়। এরপর থেকে বামেরা প্রতিটি নির্বাচনে তাদের আসন সংখ্যা এবং প্রাপ্ত ভোটের হারে মাত্রা বৃদ্ধি করে নিয়েছে। একেই সঙ্গে সক্রিয় সমাজব্যবস্থা এবং প্রশাসনিক ব্যবস্থা দিতে পার্টির কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।
১৯৯৩ বিধানসভা নির্বাচনের পর পাঁচ বছর মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন দশরথ দেব। তারপর থেকেই মানিক সরকার মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করে আসছে। ক্রমেই ত্রিপুরা বামেদের এক অভেদ্য দুর্গে পরিণত হয়। সমাজে সর্বস্তরে এমনকি সাংস্কৃতিক জগ্য, শিক্ষা সর্বোপরি পারিবারিক জীবনে বামপন্থি আদর্শ বিস্তর প্রভাব পরিলক্ষিত হতে থাকে। কিন্তু ২০১৩ লোকসভা নির্বাচনের পর জাতীয় ক্ষেত্রে বিজেপির উত্থানে ব্যাপক প্রভাব পরে এরাজ্যেও।
ইতিপূর্বে ২০০৩ সালের নির্বাচনে বিজেপি সর্বাধিক ভোট পেয়েছিল। যদিও ৭টি কেন্দ্রের একটিও জামানত রক্ষা করতে পারেনি। কিন্তু দিল্লিতে প্রথম এনডিএ সরকার থাকায় তার স্পষ্ট প্রভাব পরে। কিন্তু ২০১৩ লোকসভার নির্বাচনের পর থেকে ত্রিপুরায় কার্যত বিজেপির ঝড় উঠতে থাকে।
দিল্লিতে মোদি সরকার গঠনের পর বিজেপির সর্বভারতীয় নেতৃত্ব উত্তর পূর্বাঞ্চলের দিকে বিশেষ নজর দেয়। এবং কংগ্রেসের পাশাপাশি কমিউনিস্ট মুক্ত ভারত গড়ার লক্ষে এক যুবনেতাকে দিল্লি থেকে ত্রিপুরাতে পাঠায়।
ত্রিপুরায় শিক্ষা সম্পূর্ণ করে এই যুবক দীর্ঘ সময় ধরে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের দিল্লিস্থিত কার্যালয়ে থাকতেন। পরে বিজেপির পার্টির নেতা গোবিন্দ চারিয়ার সঙ্গে বিভিন্ন রাজ্যে ঘুরতে থাকেন। পরবর্তী পর্যায়ে তিনি বিজেপির বিভিন্ন দায়িত্বও সামলাচ্ছেন। এই যুবনেতা বিপ্লব কুমার দেবকে ত্রিপুরায় পাঠানো হয়। এবং কিছু দিনের মধ্যে তাকে রাজ্য সভাপতিও করে দেওয়া হয়।
২০১৩ লোকসভা নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদীর প্রচার প্রমুখ সুনীল দেওধরকে ত্রিপুরা প্রভারী করা হয়। এরপর থেকেই বিজেপিতে জোয়ার আসে। ইতিপূর্বেই বাম বিরোধী সমস্ত শিবির তছনছ করে দেয় বিজেপি। বহুদলের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যায়। তৃতীয় পর্যায়ে দীর্ঘদিনের ক্ষমতা থাকার ফলে সিপিআইএম সৃষ্ট বিক্ষুব্ধদেরও বিজেপি নিজেদের দলে সামিল করতে থাকে।
এই পরিস্থিতিতে বাম বিরোধী জোট বিভাজনের সম্ভাবনা শূন্যের কোঠায় পৌঁছে যাওয়ায় সিপিআইএম বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পরে। অন্যদিকে বিজেপি এমন সাংগঠনিক কাঠামো তৈরি করে যা ত্রিপুরায় ইতিপূর্বে কখনই কোন বিরোধী দলের পক্ষে সম্ভব হয়নি।
তবে দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতায় থাকার ফলে সিপিআইএম এর শক্তি এখনো যথেষ্ট বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা। কারণ সিপিআইএম এর কাছে প্রশাসনিক ক্ষমতা রয়েছে। আর এই ক্ষমতা জনগণের ভোটের নিদর্শনে যথেষ্ট সহায়ক বলে মনে করা হয়।
দীর্ঘ শাসনে প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরের আধিকারিক নিয়োগ তাদের কর্মস্থল নির্ধারণে ক্ষেত্রে পার্টি বড় ধরনের ভূমিকা নিয়েছে। আর নির্বাচনে এর প্রভাব কোন ভাবেই কাটিয়ে উঠা সহজ নয়। ফলে বিগত পাঁচটি বিধানসভা নির্বাচনে তৎকালীন বিরোধী দল কংগ্রেস ক্রমাগত তাদের শক্তি হারিয়েছে। বর্তমানে পরিস্থিতি অবশ্য কিছুটা আলাদা। আর সিপিআইএম নেতারাও সরাসরি এবিষয়টি স্বীকার করে নিচ্ছেন।
তবুও দেশের শীর্ষের বাম নেতারা রাজ্যে আসতে শুরু করেছেন। সিপিআইএম প্রচারের মুল বিষয় রাজ্যে শান্তি সম্প্রীতি বহাল রাখা। তারা সর্বোপরি কেন্দ্রীয় সরকারের সমালোচনাই নির্বাচনী প্রচারাভিযানে মুল ইস্যু। কিন্তু বিজেপি নির্বাচনে উন্নয়নকে হাতিয়ার করেছে। ত্রিপুরায় গরিবি, আইনি শৃঙ্খলার ‘অবনতি, মহিলাদের উপর অত্যাচার, বেকারত্ব এবং সিপিআইএম এর তথাকথিত ক্যাডার সন্ত্রাসকেই নির্বাচনের মূল ইস্যু করেছে।
ইতিমধ্যেই নির্বাচনের প্রচারে সিপিআইএম সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি এবং বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহ ত্রিপুরা ঘুরে গেছেন। ৩১ জানুয়ারি প্রথম দফা সফরে রাজ্যে আসছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। আসবেন বিজেপি শাসিত প্রত্যেকটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী।
অন্যদিকে সিপিআইএম এর পলিট ব্যুরো সকল সদস্য ত্রিপুরার নির্বাচন প্রচারে নামছেন। ফলে আগামী কয়েকদিনে রাজনৈতিক উত্তেজনা আরো বৃদ্ধি পাবে বলে ধারনা করা হচ্ছে। যদিও রাজনৈতিক সন্ত্রাসে বেশ কয়েকটি ঘটনা সংগঠিত হয়েছে। সাংবাদিক হত্যাকা- এবং বিজেপি কর্মীদের খুনের পর আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতিও যথেষ্ট চ্যালেঞ্জের মুখে এসে ঠেকেছে।
ফলে ইতিপূর্বে কখনই সিপিআইএম ত্রিপুরায় এত বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েনি। চিটফান্ড ‘কেলেঙ্কারি সহ একাধিক কেলেঙ্কারি পার্টির জন্য সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু সাংগঠনিক ভিতের উপর দাড়িয়ে সিপিআইএম প্রত্যাবর্তনের বিষয়ে ইতিবাচক রাখছে। কিন্তু দুর্নীতি, খুন, সন্ত্রাস, বেকারত্ব, নারী নির্যাতন ইত্যাদিকে সামনে রেখে কেন্দ্রের সরকারে থাকা সব সুযোগ নিয়ে বিজেপি পরিবর্তনের ঝড় তুলছে সাড়া রাজ্যে।