শিমুল রহমান : আজকের বাংলাদেশের চিত্র আর মাত্র এক দশক আগের বাংলাদেশের চিত্রের ভিন্নতা অনেক। প্রতিটি ক্ষেত্রে সাফল্য-ব্যর্থতার হিসাব-নিকাশ করলে উন্নয়ন ও অর্জনের পাল্লা ভারী। কৃষি, শিক্ষা, কূটনীতি, বিদ্যুৎ, খাদ্য নিরাপত্তা ও অর্থনীতিতে ঘটেছে সরব বিপ্লব। যা ৯ বছর আগের বাংলাদেশ আর আজকের বাংলাদেশ এক নয়। আজকের বাংলাদেশ আত্মপ্রত্যয়ী বাংলাদেশ। গ্রামাঞ্চলের দিকে তাকালে দেখা যাবে, অর্ধাহারে, অনাহারে দিন কাটত অধিকাংশ মানুষের। এখন তারা অনেকটাই স্বাবলম্বী হয়ে গিয়েছে। বিদ্যুতহীন অন্ধকারাচ্ছন্ন ছিল গ্রামের পর গ্রাম। অধিকাংশ ঘরবাড়ি ছিল মাটির দেয়াল অথবা পাটখড়ি বা বাঁশের বেড়া আর খড়ের ছাউনি দিয়ে তৈরি। বর্তমানে গ্রামাঞ্চলের সেই চিত্র আর নেই। অধিকাংশ বাড়িঘর দাঁড়িয়ে আছে ইট-সিমেন্ট অথবা টিনের ওপরে। শতকরা ৮০ ভাগ মানুষের বাড়িতে বিদ্যুত। ক্ষুধা, দারিদ্র্য, অশিক্ষা গ্রামাঞ্চল থেকে প্রায় বিতাড়িত হয়েছে বললেও ভুল হবে না। বদলে গেছে তলাবিহীন ঝুড়ির কথিত ভাবমূর্তিও। মঙ্গা নামক শব্দটি এখন ইতিহাস। নানামুখী চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেই শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার বাংলাদেশকে নিয়ে যাচ্ছে উন্নয়নের মহাসড়কে। টানা ৯ বছর ধরেই উন্নয়ন-অগ্রগতির মহাসোপানে এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ।’
উন্নয়নের ধারাবাহিকতা ধরে রেখেছে সরকার। আছে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গৌরবময় অনেক অর্জন। চলতি বছরের শুরুতেই প্রথম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের মাঝে ৩৫ কোটির বেশি বই বিতরণ করেছে সরকার। বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ৮৫ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে। ৩৫ লাখ সংযোগসহ ৬৫টি নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হয়েছে। বর্তমান প্রবৃদ্ধির হার ৭ দশমিক ২৮ শতাংশ। মাথাপিছু আয় ১৬১০ মার্কিন ডলার। এই ধারা অব্যাহত থাকলে ২০২১ সালে মাথাপিছু আয় দাঁড়াবে ২ হাজার মার্কিন ডলারে। ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। লক্ষ্য ২০৪১ সালের আগেই উন্নত দেশে পরিণত হওয়া। নারীর ক্ষমতায়নে অনন্য অবদানের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘প্ল্যানেট ৫০-৫০ চ্যাম্পিয়ন’ এবং ‘এজেন্ট অব চেঞ্জ অ্যাওয়ার্ড’ এ ভূষিত করেছে জাতিসংঘ। এছাড়া হার্ভার্ড ও ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যৌথভাবে করা ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের ‘দ্য গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্টে রাষ্ট্রক্ষমতায় নারীর অবস্থান বিবেচনায় সবাইকে পেছনে ফেলে বিশ্বের এক নম্বরে উঠে এসেছে বাংলাদেশের নাম।
সাফল্য-ব্যর্থতার হিসাব-নিকাশ করলে গত চার বছরের এ সরকারের পাল্লা সফলতায় ভারি, তবে ব্যর্থতার পাল্লা কম হলেও গুরুত্বহীন নয়। অনেক সাফল্যই ব্যর্থতার কালো ছায়ায় আড়ালে পড়েছে। কিছু ব্যর্থতা বিশাল সাফল্যকে কালো মেঘে আড়াল করে দিয়েছে। হলমার্ক, বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারির ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই ২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের ৮০৮ কোটি টাকা রিজার্ভ চুরির ঘটনায় স্তম্ভিত হয়েছে জাতি। আইপিআরসির জরিপ অনুযায়ী, যেসব ক্ষেত্রে সরকার ব্যর্থ হয়েছে তার মধ্যে প্রথমেই আছে দুর্নীতি দমন। ৪১ ভাগ উত্তরদাতা দুর্নীতি দমনে, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিকে ২৩ ভাগ, প্রশ্নপত্র ফাঁসসহ শিক্ষার অধঃগতিকে ২১ ভাগ, বিরোধী দলের কণ্ঠরোধ করাটাই সরকারের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা মনে করেন ৬ ভাগ উত্তরদাতা। এছাড়া, গুম-খনের বিষয়টি গত ৪ বছরে বারবার বিব্রত করেছে সরকারকে। কোনো কোনো ব্যক্তির হঠৎ নিখোঁজ হয়ে যাওয়া, কিছুদিন পর কারো কারো ফিরে আসা আবার কারো কারো একেবারেই হারিয়ে যাওয়া বিচলিত করেছে দেশবাসীকে। এ ক্ষেত্রে সরকারের ব্যর্থতা সমালোচিত হয়েছে বিভিন্ন মহলে।
কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর দৃঢ়, সাহসী ও বুদ্ধিদীপ্ত নেতৃত্ব দিয়ে দেশে স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনার বিশাল চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার অগ্নিপরীক্ষায় শুধু উত্তীর্ণই হননি, দেশের মানুষকে শান্তি-স্বস্তি প্রদানের পাশাপাশি গত চার বছরে ধ্বংসস্তূপ থেকে দেশ টেনে তুলে প্রগতি ও অগ্রগতির মিছিলে শামিল করতে সক্ষম হয়েছে। গণতন্ত্র ধ্বংসের সকল ষড়যন্ত্র-বেড়াজাল ছিন্ন করে দেশ স্থিতিশীল ও শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক পরিবেশ রেখেই বর্তমান সরকার মেয়াদের পঞ্চম বর্ষে পদার্পণ করল।
অতীত সরকারগুলোর বছর পূর্তিতে ব্যর্থতা ও অভিযোগের ঝাঁপি খুলে বিরোধী পক্ষ দেশব্যাপী ঝড় তুললেও এবারের চিত্র একেবারেই ভিন্ন। দ্বিতীয় মেয়াদের বর্তমান সরকারের চার বছরের হিসাব মেলাতে গিয়ে চরম বৈরীবিরোধী পক্ষও বড় ধরনের ব্যর্থতার দালিলিক প্রমাণ হাজির করতে পারেনি দেশবাসীর সামনে। বরং অধিকাংশ মানুষের মূল্যায়নে বেরিয়ে এসেছে, বর্তমান সরকার প্রথম থেকেই সঠিক পথেই এগোচ্ছে। চার বছরে ব্যর্থতার চেয়ে সরকারের সাফল্যের পাল্লা অনেকগুণ ভারি। জনগণের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির ব্যবধানও কমেছে উল্লেখযোগ্য হারে।
এ দেশে সাধ ও সাধ্যে, চাওয়া ও পাওয়ার মধ্যে সেতুবন্ধ রচনা খুব সহজ নয়। তবে দেশবাসী খোলা মনে প্রথম চার বছরের ভাল কাজের প্রশংসা এবং মন্দ কাজের সমালোচনা করলেও সরকারের ওপর তাদের আস্থা এতটুকুও কমেনি, বরং বেড়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অসম সাহস, দক্ষতা, দূরদৃষ্টি ও অসীম ধৈর্যের সঙ্গে দেশ পরিচালনার প্রতিটি পদক্ষেপকে যেমন দেশের মানুষ এখনও অধিকমাত্রায় সমর্থন করছেন, ঠিক তেমনি চার বছরে দেশী-বিদেশী সকল রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের বিচার সম্পন্ন হওয়া, একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীসহ সকল রাজনৈতিক হত্যাকা-ের বিচার ও রায় কার্যকরের দৃঢ় ও সাহসী পদক্ষেপকেও নিরঙ্কুশভাবেই অনুমোদন দিয়েছেন।
কেমন গেল এই চার বছর? অনেক বিচক্ষণ ব্যক্তি, দল ও গোষ্ঠী বলেছিল, ২০১৪ সালের নির্বাচন হলে কী হবে, শেখ হাসিনার সরকার এই দফায় এক বছরও টিকবে না। সৌভাগ্য শেখ হাসিনার, সৌভাগ্য দেশের মানুষের। শত বাধা-বিপত্তি ও প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলা করে শেখ হাসিনার সরকার শুধু টিকেই যায়নি, এই চার বছরে দেশকে অগ্রগতির পথে অনেক দূর নিয়ে গেছেন। শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে শেখ হাসিনার বৃহস্পতি গত বছরও ছিল তুঙ্গে। শুধু বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নন, শেখ হাসিনাকে অনেকেই উন্নয়নশীল দেশের ‘উন্নয়নের রোলমডেল নেতা’ হিসেবেও মনে করেন। তাঁর সরকারের অর্জনের কথা এখন যুক্তরাষ্ট্রসহ শক্তিশালী দেশগুলোর সরকারপ্রধানদের বক্তৃতাতেও নিয়মিত উঠে আসছে।
তাই সরকারের মেয়াদের শেষ বছরে দেশবাসীর মনে একটি প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে- আগামী জাতীয় নির্বাচন কীভাবে হবে? একাদশ জাতীয় নির্বাচন অন্তর্বর্তীকালীন, দলীয়, নাকি নির্দলীয় সরকারের অধীনে হবে? সকল দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন হবে নাকি বিএনপি-জামায়াত জোট আবার নির্বাচন বয়কট করবে?
এছাড়া সরকারের শেষ বছরে বেশ কয়েকটি স্পর্শকাতর ইস্যু এবং বেশকিছু বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। দ্রব্যমূল্যের লাগাম শক্ত হাতে টেনে ধরতে হবে। জনগণের বহুল আকাঙ্ক্ষিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন করতে হবে। রাজনৈতিকভাবে সরকারবিরোধী আন্দোলন মোকাবিলা করে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন উপহার দিতে হবে।
বিশ্লেষকদের মতে, শেষ বছরে সরকারের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হবে ছাত্রলীগ ও যুবলীগ নামধারী কিছু দুর্বৃত্তের লাগাম টেনে ধরা। সারা দেশে এমপি-মন্ত্রী ও ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের আত্মীয়-স্বজন পরিচয় দিয়ে ক্ষমতা অপব্যবহারকারীদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি দিতে হবে।
দেশের খ্যাতনামা ইতিহাসবিদ ও কলামিস্ট অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনও এ প্রসঙ্গে সরকারকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, একাত্তরের পাকিস্তানপ্রেমী বাঙালীরাই আজ বিএনপিসহ সাম্প্রদায়িক দলে ভিড়ে দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। মনে রাখতে হবে আগামী নির্বাচন অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতির পক্ষের শক্তির জন্য অস্তিত্বের প্রশ্ন। বর্তমানের উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে হলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পুনরায় নির্বাচিত করা ছাড়া জাতির সামনে আর কোন বিকল্প নেই। জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে তাঁদের ব্যালটের মাধ্যমে বিএনপি-জামায়াত নামক পাকিস্তানীপ্রেমীদের আবারও পরাজিত করতে হবে। তবে মনে রাখবেন গ্রামে-গঞ্জের মানুষ বলাবলি করছে যে, আওয়ামী লীগ হারলে আওয়ামী লীগের জন্যই হারবে। কেননা প্রতিটি আসনে আ’লীগের অসংখ্য প্রার্থী। তাই নব্য আওয়ামী লীগারদের সম্পর্কে সজাগ থাকতে হবে। ষড়যন্ত্র হচ্ছে তাই ষড়যন্ত্র প্রতিহত করতে হবে। আমাদের মধ্যেই ষড়যন্ত্রকারী আছে, তাদেরও শনাক্ত করতে হবে।