আজিজুল বারী হেলাল : আজ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের জন্মদিন। প্রিয় এই ছাত্র সংগঠনটির জন্ম ও বেড়েওঠা নিয়ে লিখতে শুরু করে লেখাগুলো ফুলদানিতে রাখা বাসি ফুলের মতোই মনে হচ্ছে। সবই চর্বিত-চর্বণ, বহুবার লিখেছি কিংবা বহুজন লিখেছেন।
দেশে বিদ্যমান সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করলে ‘কারও পৌষ মাস কারও সর্বনাশ’। রাষ্ট্রক্ষমতায় অবস্থানকারী গুটিকয়েকের জন্য পৌষের মিষ্টি পিঠা-পুলির আনন্দ ভোজন হচ্ছে আর সঙ্গে ওদের মোসাহেবদের কেউ চাটছে, কেউ শুঁকছে, কিন্তু বৃহৎ জনগোষ্ঠীর হচ্ছে সর্বনাশ। লুটপাটের অর্থনীতি, নিবীর্যকরণের গণতন্ত্র, বিরোধী মতের ওপর হামলা-মামলা, গুম-খুন এবং স্বার্থান্বেষীদের দালালিপনার এক নিকৃষ্ট রাজনৈতিক সংস্কৃতি চলছে দেশে।
ক্ষোভে-বিক্ষোভে ফুঁসে উঠছে জনগণ; কিন্তু শাসকগোষ্ঠীর মাফিয়া শাসনে আবার ফেঁসেও যাচ্ছে জনগণ। হোক সে প্রতিবাদী কিংবা নিরীহ। বিরূপ ও বেমানান এই পরিবেশ-পরিস্থিতিতে ছাত্রদলের জন্মবৃত্তান্ত রচনা করা অসময়ে বাঁশের বাঁশির মতোই বেসুরা মনে হবে।
জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের প্রতিষ্ঠাতা শহীদ জিয়া ইংরেজি বছরের ১৯৭৯ সালের প্রথম প্রহরে সংগঠনটি দেশবাসীকে উপহার দিয়ে বলেন, ‘ছাত্রদল অন্যায়ের বিরুদ্ধে চাবুকের ন্যায় কাজ করবে।’ করেছিলও তাই। মুক্তিযুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তানে চাকরির ছল দেখিয়ে কৌশলে পালিয়ে থাকা সামরিক অফিসার, ৮০’র দশকে দেশের প্রধান সামরিক কর্মকর্তা হয়ে বন্দুকের নলের মুখে নির্বাচিত সরকারের কাছ থেকে রাষ্ট্রক্ষমতা কেড়ে নিয়ে বন্দী করে গণতন্ত্র।
জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলই তখন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার আপসহীন ভূমিকায় রাজপথে ভ্যানগার্ড হিসেবে দায়িত্ব পালন করে বন্দী গণতন্ত্র মুক্ত করে। পরবর্তীতে ফখরুদ্দীন-মইনুদ্দিন গংরা গণতন্ত্রের ওপর আটকাদেশ বা ডিটেনশন জারি করে একটি জুজুবুড়ির সরকার তৈরি করে। রাজনৈতিক দল ভাঙা এবং নিজ দলের নেতা-কর্মীর পারস্পরিক বিশ্বাস-অবিশ্বাস, দ্বন্দ্ব-সন্দেহের এক অস্বাভাবিক সংস্কৃতির ইন্ধন জোগায়। বেনিয়া-আমলা প্রভৃতিকে অস্ত্র ঠেকিয়ে অর্থ লোপাট করে বর্গীর শাসন শুরু করে। তখনো প্রতিবাদী ছাত্রদল। ২০০৭ সালের আগস্ট—ছাত্র আন্দোলনের ওপর রাষ্ট্রীয় বাহিনীর নির্যাতনের সব শিকল ছিন্ন করে ছাত্রদলের সহস্র-অযুত নেতা-কর্মী বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের প্রতি অবিচল আস্থা রাখে। ভয়ভীতি ও বিকিকিনির ওই বাজারে যা ছিল সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। ফিনিসীয় সভ্যতার ফিনিক্স পাখির মতো ছাত্রদলই তখন ভস্ম হয়ে যাওয়া দলীয় সংহতি ও দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি পুনর্নির্মাণে বেগম খালেদা জিয়ার মুখ্য সৈনিক হিসেবে কাজ করেছিল।
যার ফলে জুজুবুড়ি নামক অস্বাভাবিক সরকারের আরোপকৃত গণতন্ত্রের ওপর ডিটেনশন সহজে প্রত্যাহার হয় এবং দেশে নির্বাচনী হাওয়া বইতে শুরু করে। যা ছিল তখন রাজনৈতিক দল, দেশ ও জনগণের একান্ত প্রত্যাশা।
বর্তমানে চলমান বৈরী রাজনীতি ও বুনো শাসনে, শিক্ষা-দুর্নীতি, শিক্ষা-বাণিজ্য, শিক্ষা-ঘুষ নামে নতুন নতুন শব্দাবলীর আবির্ভাব। প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস, এমনকি শিক্ষকদের থিসিস-জার্নাল প্রকাশে জাল-জালিয়াতির খবর, দলবাজির স্বার্থে ইতিহাসের পাঠ ঘষামাজা করে পাঠ্যক্রম রচনা, মুক্তবুদ্ধির চর্চাকেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ থেকে ভিন্নমতের নির্বাসন। সরকারের খয়ের খাঁ হিসেবে পরিচিত শিক্ষক সমিতি, রেজিস্টার্ড গ্রাজুয়েটদের সিনেট, কিংবা কর্মচারী সমিতির নির্বাচনও হয় ফি বছর। কিন্তু দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ কর্ণধার ছাত্রছাত্রীর মেধা-মনন, নেতৃত্ব বিকাশের এবং সব মত ও পথের ভিন্ন ভিন্ন স্রোতধারা একই মোহনায় মিলনের কমন প্লাটফর্ম হিসেবে বিবেচিত ছাত্রছাত্রীর কাছে সবচেয়ে জনপ্রিয় ‘ছাত্র সংসদ’ নির্বাচন জাদুঘরে স্থান পেতে যাচ্ছে। অস্থির সময়ে হ-য-ব-র-ল এই শিক্ষা ব্যবস্থায়, পালন করতে হচ্ছে ছাত্র রাজনীতিতে পরাশক্তিসম এই ছাত্র সংগঠনটির প্রতিষ্ঠার ঊনচল্লিশতম বার্ষিকী। ফুলে ফুলে বরণ করে সংগঠনের ইতিহাস, ঐতিহ্য তুলে ধরাই ছিল চিরায়ত ও স্বাভাবিক প্রথা। ভিন্ন এই বাস্তবতার নিরিখে, শিক্ষা, ঐক্য, প্রগতির অপূর্ব সমন্বয়ে, ‘উৎপাদনমুখী শিক্ষা ব্যবস্থাই আমাদের লক্ষ্য।’ স্লোগানে এবং বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে চলমান গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে আরও বেগবান করাই শহীদ জিয়ার সূর্য সৈনিক হিসেবে খ্যাত জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের এ মুহূর্তে করণীয়।
বিদ্যমান প্রতিকূল রাজনৈতিক পরিবেশ ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসে পিচঢালা রাজপথ সংকীর্ণ তবুও বিক্ষোভে-মিছিলে ছাত্রদলের বিপুল উৎসাহে সাহসী উপস্থিতি সত্যিই প্রশংসনীয়। কিন্তু আন্দোলন-সংগ্রামের সুতিকাগার কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ইট-পাথর কংক্রিট ঢালাই পথে ছাত্রদলের উপস্থিতির সংকট গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা আন্দোলনের পালে যথাযথ হাওয়া পাচ্ছে না। সূর্যের প্রখর আলোর দিকে তাকিয়ে সূর্যমুখী ফুল যেমন নিজেকে সম্পূর্ণ মেলে ধরে দর্শককে আনন্দ দেয়। জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল নামক সূর্যের প্রবল অঙ্গীকারে উজ্জীবিত হতে তেমনি দেশের কোটি জনতাও ছাত্রদলের দিকে সূর্যমুখী ফুলের মতো তাকিয়ে আছে। গুম হয়ে যাওয়া গণতন্ত্র ফিরিয়ে এনে, শহীদ জিয়ার উন্নয়ন-উৎপাদনের বাংলাদেশ বিনির্মাণে। এটাই হোক এবারের জন্মবার্ষিকীর অঙ্গীকার!
লেখক : তথ্য সম্পাদক, বিএনপি; সাবেক ছাত্রদল সভাপতি।
সূত্র : বিডি প্রতিদিন