ডেস্ক রিপোর্ট : প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবকাঠামো, শিক্ষক, প্রশাসন, পাঠ্যক্রম, পাঠদান, প্রশিক্ষণ, আইন-বিধিসহ প্রায় অর্ধশত চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে প্রাথমিক শিক্ষাস্তর অষ্টম শ্রেণিতে উন্নীত করার উদ্যোগ।
জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ অনুযায়ী, ২০১৮ সালের মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষাস্তর অষ্টম শ্রেণিতে উন্নীত করা নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। নীতি প্রণয়নের সাত বছর হলেও এ বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা বা রূপরেখা প্রণয়ন করতে পারেনি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়।
জাতীয় শিক্ষানীতি অনুযায়ী, শিক্ষার স্তর হবে তিনটি। সেগুলো হচ্ছেÑ প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক, নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত মাধ্যমিক এবং এর পর উচ্চশিক্ষা স্তর। বর্তমানে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক, ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত নিম্ন মাধ্যমিক, নবম-দশম শ্রেণি মাধ্যমিক, একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি উচ্চ মাধ্যমিক এবং তার পরে শুরু উচ্চশিক্ষা।
‘কাজীর গরু কিতাবে আছে, গোয়ালে নেই’Ñ এ কথার মিল পাওয়া যায় শিক্ষানীতি অনুযায়ী প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণিতে উন্নীত করার বিষয়ে। মৌখিক ঘোষণার মধ্যেই সীমাবদ্ধ শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন। বলতে গেলে, প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণিতে উন্নীত করার কার্যক্রম লেজেগোবরে অবস্থা। সাত বছর ধরে রশি টানাটানি চলছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় আর প্রাথমিক গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মধ্যে।
এ প্রসঙ্গে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ড. এএফএম মনজুর কাদির আমাদের সময়কে জানান, ইতোমধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও প্রাথমিক গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত কমিটির বৈঠক হয়েছে। তৈরি হচ্ছে দুই মন্ত্রণালয়ের কাজ হস্তান্তরের কর্মপরিকল্পনা।
তবে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অনেক চ্যালেঞ্জ আছে বলে মনে করেন জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির সদস্য সচিব শিক্ষাবিদ অধ্যাপক শেখ একরামূল কবীর। তিনি বলেন, বড় বিষয় হচ্ছে পাঠক্রম প্রণয়ন। কীভাবে চালানো হবে শিক্ষা প্রশাসন। বর্তমানে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে যেখানে নবম-দশম শ্রেণিও আছে। একটি স্কুলকে দুই মন্ত্রণালয় ও দুই অধিদপ্তরে ছোটাছুটি করতে হবে। এমনিতেই তাদের হয়রানির শেষ নেই, আছে শিক্ষক সংকটও, ক্লাসরুম সংকট। এ অবস্থায় অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত কীভাবে চলবে? শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ কীভাবে চলবে? প্রাইমারি ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের ইনস্ট্রাক্টররা কি অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেবেন? টিচার ট্রেনিং কলেজগুলো তা হলে শুধু নবম ও দশম শ্রেণিতে যারা পড়ান, তাদের প্রশিক্ষণ দেবে? এ বিষয়গুলোর সুরাহা হওয়া দরকার। এ ছাড়া প্রাথমিক শিক্ষা অবৈতনিক।
আর ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা বেতন দিয়ে স্কুলে পড়ে। এ তিন শ্রেণির শিক্ষার্থীদের যদি বেতন দিতে না হয়, তা হলে যে পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন হবে শিক্ষা খাতে সে পরিমাণ বরাদ্দ বাজেটে থাকবে কিনা, তা-ও অজানা। বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত যদি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চলে যায়, তা হলে ওইসব স্কুল কি শুধু নবম ও দশম শ্রেণি দিয়ে চলবে, নাকি দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত উন্নীত করা হবেÑ এরও কোনো রূপরেখা তৈরি হয়নি। আবার যেসব কলেজ শুধু একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণি নিয়ে গঠিত, এগুলোর কী হবে? এগুলো কি কোনো মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সঙ্গে সংযুক্ত হবে, নাকি সেখানে নবম ও দশম শ্রেণি খোলা হবে? আরেকটি চ্যালেঞ্জ হচ্ছে বিদ্যমান শিক্ষক দিয়ে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদান করা। কারণ প্রাথমিকে পুরনো শিক্ষকদের মধ্যে বেশিরভাগ এসএসসি-এইচএসসি পাস। তারা কীভাবে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদান করাবেন?
শিক্ষাবিদ ড. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণিতে উন্নীত করায় নানা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে সরকারকে। এটি বাস্তবায়ন করতে প্রাথমিক, নিম্ন মাধ্যমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকÑ এ চার স্তরের শিক্ষাব্যবস্থায় সমন্বয় আনতে তৈরি হবে জটিলতা। সঠিকভাবে সমন্বয় করতে না পারলে প্রত্যেকটি স্তরের অধ্যয়নরত অর্ধকোটির বেশি শিক্ষার্থী ভোগান্তিতে পড়বে। এর সঙ্গে কয়েক হাজার শিক্ষককে পোহাতে হবে বড় ধরনের ঝামেলা। প্রাথমিকে ১৯৯১ সাল থেকে ২০১৩ সালের নিয়োগ বিধিমালার আগের অনেক শিক্ষকের শিক্ষাগত যোগ্যতা এসএসসি। তারা এখনো চাকরি করছেন। তারা বর্তমান কারিকুলামে ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণিতে পাঠদানের অনুপযোগী। তাদের দক্ষ করতে অবশ্যই প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দক্ষতা প্রসঙ্গে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গণস্বাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, বিষয়টি একটি চ্যালেঞ্জ। যদিও বলা হয় এসএসসি পাস। এখন আমাদের শিক্ষকরা অনেকে গ্র্যাজুয়েট। চাকরির বাজার সীমিত হওয়ায় অনেকে শিক্ষকতায় চলে আসে। সাধারণ শিক্ষার যোগ্যতা আর দক্ষ শিক্ষক দুটোই ভিন্ন। দক্ষতার দিকে অবশ্যই জোর দিতে হবে সরকারকে।
বর্তমানে দেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে ৬৩ হাজার ৮৬৪টি। এ ছাড়া ২ হাজার ৩৮১টি নিম্ন মাধ্যমিক প্রতিষ্ঠান প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে চলে যাবে। এর মধ্যে এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠান হচ্ছে ৫৫৩টি। এসব প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৫ লাখ ১৭ হাজার ৫৫০। আর শিক্ষক হচ্ছেন ১৯ হাজার ২৪০ জন। দৈনিক আমাদের সময়