ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ
আয়কর ব্যবস্থা যেখানে সামাজিক সুবিচার ব্যবস্থাপনায় রাষ্ট্র ও নাগরিকের মধ্যে পারস্পরিক-পরিপূরক দায়িত্ব পালনের বিষয়, ঔপনিবেশিক শাসনকাঠামোয় সংগত কারণেই যার যথার্থতা অনুসরণ ছিল অনুপস্থিত, আজকের বাংলাদেশ অতীতের ঔপনিবেশিক শাসনামলে যেভাবে ব্যবসা বাণিজ্য বিনিয়োগ নিয়ন্ত্রণ ও পরিপোষণের নামে আর্থ সামাজিক রাজনৈতিক দিক দিয়ে বিপুল বৈষম্যমূলক আচরণের শিকার ছিল তা যেন অব্যাহত না থাকে সেদিকে নজর দিতে হবে।
একথা অনস্বীকার্য থেকে যাবে যে বাংলাদেশের আয়কর আইনের ভাষা হবে সহজবোধ্য, জটিলতা পরিহারী এবং এর প্রয়োগ হবে স্বাচ্ছন্দে সার্বজনীন ব্যবহার উপযোগী। করদাতা যেন নিজেই নিজের আয়কর ফরম পূরণ, কর নির্ধারণ এবং সরাসরি তা দাখিলে সক্ষম হন। অর্থনীতির বিভিন্ন পর্য়ায়ে অবস্থানরত আয়কর দাতাগণ যেন অভিন্ন আচরণে আইনগতভাবে আয়কর প্রদানে দায়িত্বশীল হতে স্বত্বস্ফূর্ততা বোধ করেন। কর আদায় নয় কর আহরণে কর দাতা ও কর আহরণকারীর মধ্যেকার দূরত্ব যত কমে আসবে, যত অধিকমাত্রায় করদাতা কর নেটের আওতায় আসবেন, তত কর রাজস্ব আহরণে সুষম, সহনশীল ও দায়িত্ববোধের বিকাশ ঘটবে। এরূপ পরিস্থিতিতে কর দাতাকে তাড়া করে ফেরার স্পর্শকাতরতার অবসান ঘটবে। তবে এ সব কিছুই নির্ভর করবে আয়কর আইনের ভাষা আর দৃষ্টিভঙ্গিতে কার্যকর ও কল্যাণ পদ পরির্বতন আনয়নের ওপর। আর সে প্রত্যাশা পূরণ প্রয়াসে আইন পরিষদ, নির্বাহী বিভাগ এবং করদাতা নির্বিশেষে সকলের সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ আবশ্যক হবে।
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পরও, একযুগেরও বেশি সময় সেই ১৯২২ সালের আয়কর আইন ভারত স্থলে পাকিস্তান, পাকিস্তান স্থলে বাংলাদেশ প্রতিস্থাপিত ও নামাঙ্কিত হওয়া ছাড়া একইভাবে বলবৎ ও প্রযোজ্য থাকে। আয়কর অধ্যাদেশ, ১৯৮৪ (১৯৮৪ সালের ৩৬নং অধ্যাদেশ) জারির মাধ্যমে বাংলাদেশে নিজস্ব আয়কর আইন প্রবর্তিত হয় ১৯৮৪ সালে। তবে তখন দেশে আইন পরিষদ বিদ্যমান না থাকায় রাষ্ট্র ও নাগরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট ও জনগুরুত্বপূর্ণ আয়কর আইনটি অধ্যাদেশ হিসেবে জারি হওয়ায় এটির প্রণয়ন ও প্রয়োগযোগ্যতা নিয়ে বার বার প্রশ্ন উঠেছে। বারবার দাবি উঠেছে আয়কর অধ্যাদেশ এর স্থলে আয়কর আইন প্রণয়নের। আইনসভার অনুমোদনে প্রণীত না হওয়ায় লক্ষ্য করা যায় অধ্যাদেশের সংশ্লিষ্ট ধারা-উপধারা সমূহ তথা বিধানাবলী মূলত ১৯২২ সালের মূল আইনেরই স্বাভাবিক ধারাবাহিকতায় দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞ প্রণীত প্রেসক্রিপশন মাত্র এবং এটি সে হিসেবেই বিবেচিত হয়ে আসছে। বাংলাদেশে বিদ্যমান আয়কর অধ্যাদেশের ভাষা ও গতিপ্রকৃতি বিশ্লেষণে গেলে এটা প্রতীয়মান হয় যে বছর বছর অর্থ আইনে যে সমস্ত ছিটে ফোটা শব্দগত সংযোজন বিয়োজন এবং মূল ধারণার আওতায় প্রযোগযোগ্যতার মাপকাঠির পরিবর্তন বা পরিমার্জন অনুমোদিত হয়েছে তা ধারণ করা ছাড়া ১৯২২ এর মূল আইনের ভাব ভাষা দৃষ্টিভঙ্গিগত তেমন কোনো পরিবর্তন বা সংস্কার দৃশ্যগোচর হয় না। বরং প্রতিবছর কর নির্ধারণ, শুনানী, বিচার-আচার এ কর কর্মকর্তাদের ক্ষমতা বা এখতিয়ার, কর অবকাশ-নিষ্কৃতি- ছাড় কিংবা বিশেষ সুবিধাবলীর ধারা উপধারা সংযোজন বিয়োজন করতে করতে অনেক ক্ষেত্রেই করারোপ, আদায় ও করদাতার অধিকার, কর অবকাশ নিষ্কৃৃতিও সুবিধা সংক্রান্ত মৌল দর্শন হয়েছে বিভ্রান্ত, বিকৃত ও বিস্মৃত। পক্ষান্তরে, যুগধর্ম এর সাথে সংগতি রেখে কর নির্ধারণ ও আদায় সংক্রান্ত বিধানাবলী সহজিকরণ, সরলিকরণ তথা করদাতা বান্ধবকরণ এর পরিবর্তে ক্ষেত্র বিশেষে আরও জটিল হয়েছে। বাংলাদেশ অর্থনীতর সমকালীন পরিবেশ-পরিস্থিতির আলোকে আয়কর ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ সম্বলিত সংশোধন সংযোজন বিয়োজন প্রয়াস বারবার যেন উপেক্ষিতই থেকে গিয়েছে। বারবার বা বছরবছর করের হার, সুবিধাবলীর পুনর্বিন্যাস চলতে থাকলে তা অনসরণে যেমন জটিলতা তেমনি তা প্রয়োগেও ঘটে নানান বিপত্তি। যেকোনো সংশোধন, পরিমার্জন কিংবা সংযোজন ন্যূনতম পাঁচ বছর কার্যকর থাকলে তা অনুসরণে স্থিতিশীলতা আসতে পারে। নানা মুনির নানা মতপ্রকাশের বা প্রদানের সুযোগ থাকলে আর্থিক বিধি বা আইন যথা অনুসরণ যোগ্য হয়ে উঠতে পারে না।
লেখক : সাবেক সচিব, এনবিআর-এর সাবেক চেয়ারম্যান
সম্পাদনা : আশিক রহমান